জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধুসর স্মৃতি - ৪
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৮ অক্টোবর,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:৪৬ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
মাত্র তিন মাস। আবার অনেকেই আঙ্গুল গুনে বলেন তিরাশি দিন। এই ক'টা দিনে প্রশাসনের অন্দর মহলে অনেক কাঠখড় পুড়েছে। ঐ যে বলেছিলাম ছাত্র যুবাদের মহা দেশপ্রেমিকের দল, যারা সাধারন তরুন যুবাদের যেমন তাদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র দিয়ে তন্দ্রাতাচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, পাশাপাশি সেক্টর কমান্ডারের একটি অংশকে অতি উৎসাহী করে তাদেরকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তাছাড়া দেশ শাসনের ছড়ি হাতে মহান নেতার বিশ্বস্ত খন্দকার সাহেব নিজের পথ পরিস্কার রাখার চিন্তাতেও কিছুটা উদ্ভ্রান্ত ছিলেন। ফলে সর্বক্ষেত্রে একটা অরাজক অবস্থার ফাঁদে পড়ে আমরা পরবর্তীতে নেতৃত্বের অবশিষ্ট সবেধন নীলমনি হিসাবে জীবিত চার বড় নেতাকেও হারালাম। শুধু তাই নয় বখে যাওয়া শক্তি হিসাবে সংক্রমিত সেই পক্ষটির অদূরদর্শিতায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সেক্টর কমান্ডারকেও আমরা হারিয়েছি সেইসব দিনগুলিতে।
ক্রান্তিকালের চুড়ান্ত সময়ে আবারো সেই ধুমকেতুর উদয় হোল। যেমন করে একাত্তরের ২৭ শে মার্চ কালুরঘাট বেতারে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে সাত নভেম্বরের সিপাহী জনতার মুক্তির নি:শ্বাস নেয়ার দিনটিতে সেদিন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের খবরদারি ও উচ্ছ্বাসের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে কিছুটা হলেও সাধারন মানুষ শঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু যে মানুষটি মহান নেতার আদর্শে বলীয়ান হয়ে সেদিন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নেতা ঘোষিত স্বাধীনতাকে ঘোষনা পাঠের পুষ্টতায় সমগ্র বাঙালী জাতির মননে যুদ্ধ জয়ের নেশা জাগিয়েছিলেন, তিনি কেমন করে এসব হটকারী বৈজ্ঞানিক টৈজ্ঞানিক ইত্যাদি নিয়ে ভাববেন! একজন দেশপ্রেমিক সিপাহশালার হিসাবে দেশকে অখন্ড ও শত্রুমুক্ত রেখে জনতার মর্জি মাফিক এগিয়ে যাওয়াই তো তার কাজ। এই ক'টা দিনে রাজনীতির অদূরদর্শিতায় যে ক্ষতি দেশের জন্য অশনির শঙ্কা ডেকে এনেছিল তাকে নির্মুল করার কাজেই তিনি হাত দিলেন। রাজনীতিশুন্য বাংলাদেশ আস্তেধীরে সামরিক প্রশাসনের করতলে নিমজ্জিত হোল।
ব্যারাকের পোষাকী মানুষ হলেও তিনি একজন বাঙালী সন্তান। বাংলার সুর্য সন্তান হয়ে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করা একজন সফল সিপাহশালার তিনি। দেশের প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে রেখে তিনি নিজস্ব আঙ্গিকে সহকর্মী মুক্তযোদ্ধা কমান্ডারদের নিয়ে দেশের রাজনীতি ও দেশ শাসনের SWOT analysis করেছিলেন কিনা জানি না। তবে একজন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর মানুষ যখন তার গায়ের উর্দি ছেড়ে সাধারন জনগনের কাতারে এসে দেশ ও জাতির সমগ্রতার কল্যানে রাজনীতির মাঠে নেমে পড়েন তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এর পিছনে নিগূঢ় কোন চিন্তা চেতনা রয়েছে। পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তর সালের এই দুই বছরে সমাজে যারা আপার হ্যান্ড এবং রাজনীতি সচেতন ছিলেন, তারা হয়তো এসব আলামত কিছুটা হলেও লক্ষ্য করে থাকবেন। এই দুই বছরে তৎসময়ের সেনাপ্রধান, প্রকারন্তরে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া দেশের বুদ্ধিজীবি এবং বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষজনের সাথে বৈঠক করেন। জেলায় জেলায় ঘুরে রাজনীতি সচেতন এবং সমাজের প্রভাবশালী লোকজনকে নিয়ে ব্যক্তিগত আলাপ চারিতা করেন।
পরবর্তীতে তিনি স্বাধীন দেশের মানুষের সমগ্রতার নিরিখে পুর্ব পুরুষদের স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মানে দেশে রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তিনি শেরে বাংলা, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান এমনকি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সমন্বয় ঘটিয়ে সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশে বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিরোধী পাকিস্তান পন্থীদের সঙ্গেও রাজনীতির শলা-পরামর্শ করে তাদেরকেও দেশ সেবার কাজে এগিয়ে আসার সুযোগ দেন। এভাবেই দেশের সামষ্টিক সমন্বয়তার কথা ভেবে একজন সামরিক প্রশাসক জনতার রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেন। তার সময়ে অর্থনৈতিক সামাজিক স্বাস্থ্য শিক্ষা শিল্প কৃষি ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই মজবুত ভিত তৈরীতে এগিয়ে যায় দেশ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সার্ক, ওআইসি ও আল কুর্দ কমিটির সদস্যসহ আরব দেশ সমূহের বিষয়েও তার নেতৃত্বে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পায়। জন সংখ্যা নিয়ন্ত্রন, কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, গ্রাম সরকার প্রবর্তন, পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডসহ একাধিক যুগান্তকারী উন্নয়ন মুলক ব্যবস্থাদির প্রচলনে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়শীলতার ব্যপকতা পায়। প্রচলিত বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর শৃংখলা আনয়নের লক্ষ্য তাকে প্রচুর শ্রম দিতে হয়। এক সময় ঘরের শত্রু বিভীষনের রূপ নিয়ে বিশৃংখল ও উচ্চাভিলাষী সামরিক বাহিনীর কতিপয় দুষ্টু চক্রের হাতেই তাকে অকালে প্রান হারাতে হয়। ১৯৮১ সালের মে মাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়া অধ্যায়ের শেষ হয়। তবুও তিনি রয়ে যান সাধারন মানুষের মনে। তাঁর গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ব্যানারে তিনি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার কাজে সাধারন মানুষকে সম্পৃক্ত করে তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিকে একটি শক্তিশালী জনভিত্তিক দল হিসাবে রেখে যান।
দেশে গনতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে। সাধারন নির্বাচন করে বাংলাদেশ আন্দোলনের একজন পোড় খাওয়া দেশপ্রেমিক মানুষ বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ড নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়ে দেশের উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বিশৃংখলা এবং পারিপার্শিক রাজনীতির প্ররোচনাসহ ভিন্নধর্মী ক্ষমতা ভোগের উচ্চাভিলাষীদের কারনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কিছুটা অসহিষ্ণুতা পরিলক্ষিত হয়। ক্ষমতার উচ্চাভিলাষী ব্যারাকের মনুষটি হয়তো সে অপেক্ষাতেই ছিলেন। বিশ্লেষকেরা বলেন, রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও সামাজিক বিপর্যয়ে সামরিক বাহিনী পরোক্ষভাবে সেসময় কলকাঠি নাড়িয়েছে। রাজনীতির ধারাকে ন্যুনতম সুযোগের সম্মানে না রেখে পরবর্তীতে তিনি অর্থাৎ পাকিস্তান ফেরত জেনারেল, সেনাপ্রধান হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ দেশের সর্বময় ক্ষমতা একপ্রকার বিনা রক্তপাতে নিজের হাতে তুলে নেন। জেনারেল এরশাদের হাতে এদেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার পদচ্যুত হন ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে।
জনগনের সামনে সামরিক শাসনের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়। একজন ধুর্ত সামরিক প্রশাসক জনগনের বন্ধু সাজার ভান করে দেশকে আপাদমস্তক ধর্মীয় মোড়কে আচ্ছন্ন করার প্রয়াসে মধ্য প্রাচ্যীয় পেট্রোডলারের দেশ সমূহের চাকচিক্যে মানুষকে মোহবিষ্ট করে রাখেন। ইসলামী বিশ্বের সাথে সখ্যতার বিনিময়ে তিনি তাদের ব্যবসা বানিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। তাদের উন্মুক্ত সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে দেশে ইসলামী চলন বলনের জোশ লক্ষ্য করা যায়। ফলে আরব দেশীয় শান শওকাত ও তাদের ইসলামী মতবাদের প্রভাবে কিছুটা হলেও দেশে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির পসার লক্ষ্য করা যায়। তিনি দেশের স্থানীয় প্রশাসনে গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার উপর জোর দেন। উপজেলা পদ্ধতির প্রবর্তন করে স্থানীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন এবং সফলতা অর্জন করেন। সরকারী ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সেবা সমূহ দেশের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানোর ফলে গ্রাম বাংলায় উন্নয়নের সুষম অগ্রযাত্রা সূচিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকান্ডের স্বত:স্ফুর্ত কর্ম চাঞ্চল্যে স্থবিরতা থাকার ফলে রাজনীতির উঠান ও সাধারন জনগনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় মেকানিজমে একঘেয়ে সামরিক উর্দিপরা প্রশাসকদের অটোক্র্যাটিক পথচলায় মানুষ অতীষ্ট হয়ে পড়ে। গনতন্ত্রমনা বাঙালী মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। যদিও রাজনীতির কিছু অংশ সে সময় শৈর শাসনের এই সময়টাকে রাজনীতির সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনায় রেখে সামরিক লেবাসের এরশাদ সরকারকে সহয়তা করে ব'লে মনে করার যথেষ্ট কারন রয়েছে। তবে সময়ের বহমানতায় জনপ্রিয় দুটি বড় দলের বংশ পরম্পরার উত্তরাধিকারী দুই নারীর অকুতোভয় এবং অবিচল নেতৃত্বে বাংলার জনগন তাদের কাংখিত গনতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক সামষ্টিকতা প্রাপ্তির মানসে রাজপথে সচল হতে থাকে। তাছাড়া গনতন্ত্র ও রাজনীতির অক্সিজেন বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কেন্দ্রিক ছাত্র সমাজের অকুন্ঠ সমর্থন ও তাদের রাজপথ দখলে ১৯৯০ সালে শ্বৈর শাসনের বিরুদ্ধে গন আন্দোলন চুড়ান্ত আকার ধারন করে। নব্বইয়ের গন অভ্যুত্থান নামে খ্যাত সেই আন্দলনের ত্রিমুখী তোড়ে সামরিক লেবাসের সেই তথাকথিত গনতান্ত্রিক(!) শাসক লেজেহোমো এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
(চলমান)