জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধুসর স্মৃতি-৩
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ অক্টোবর, বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৭ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দেশে ঘটে যাওয়া এক দেশ এক নেতা এক দল আচরনের নতুন পথচলায় রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরনে শাসক শ্রেনী ও অঙ্গ সংগঠনের লোকজনের মধ্যে একটি সাজ সাজ রব পরিলক্ষিত হয়। পাশাপাশি সাধারন জনপদের মধ্যে একটা অবদমিত ও শাসিত শ্রেনীবিন্যাসের ভাব স্পষ্ট হয়। স্বত:স্ফুর্ততা তো দূরের কথা, একটি প্রচ্ছন্ন সংশয়ে ও নিজেদের অধিকার হরনের এক অজানা আশংকায় তারা দিনাতিপাত করতে থাকে। টালমাটাল এই অবস্থায় দেশের রাজনীতি বলতে শুধুমাত্র আওয়ামী ঘরানার বাকশাল উঠান ছাড়া আর কিছুই রইলো না। ফলে শাসক দলের অঙ্গ সগঠনের তরুন যুবারা যেন আরো বেপরোয়া হয়ে গেল। তাদের একছত্রীয় চলাফেরার রাজনৈতিক স্বীকৃতি তাদেরকে অতি উৎসাহী করে তুললো। ওদিকে রাজনীতির প্রথম ক্রস ফায়ারের খুন (সিরাজ শিকদার) এবং রক্ষীবাহিনীর ওপেন লাইসেন্সের জাসদ নির্মুলের বেপরোয়া আচরন জনপদে এমনিতেই মধ্যযুগীয় প্রজার রূপ ধারন করেছিল। যখন সরকারী সমস্ত প্রতিষ্ঠানে বাকশালে যোগদানের ফরম পাঠিয়ে তা অঙ্গীকারনামার আদলে সমস্ত সরকারী কর্মচারীদের কাছ থেকে দস্তখত নেয়ার কার্যক্রম শুরু হলো, সেসময় লক্ষ্য করা গেছে ঐ শ্রেনীর মানুষের মধ্যেও একটা ধুমায়িত বিরক্তির ভাব। বাকশাল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কিছু সৌভাগ্যবান ক্যাডার ও পছন্দের লোককে জেলা গভর্নর পদে নমিনেট করার পর দেখা গেছে সেইসব মানুষ ও তাদের পার্শ্ব অনুচরদের লম্ফঝম্ফ ও রাজকীয় চলন বলনের উটকো প্রতিক্রিয়া, যা সাধারন জনগনের কাছে ভাল পুর্বাভাষ বলে মনে হয়নি। মহান নেতা হয়তো চারিদিকের অসন্তোষ ও অরাজক পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য একটা ইউনিক ধারনার চিন্তায় সেসব করেছিলেন, কিন্তু নেতার সহকর্মীদের ভাবখানা - যেন তাদেরকে শাসক হিসাবে এলিট শ্রেনীতে উন্নীত করার জন্যই এই আয়োজন। সেক্ষেত্রে ঘোষনার অব্যাবহিত পরেই যদি নেতা কর্মীরা বাকশালের উপকারিতা ও এর সূদুর প্রসারী ভাল দিকগুলো নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়তেন, তাহলে সাধারন মানুষের মধ্যে একটা স্বস্তির বাতাবরন তৈরী হলেও হতে পারতো। মোটকথা মাঠ তৈরী না করে একটা আমদানী করা ধারনা সে সময় সাধারন জনগনকে স্বস্তি দেয়নি। ফলে নেগেটিভ ধারনা নিয়ে দেশ নেতার সেই উদ্যোগ একটি ছাই চাপা অসন্তোষের মধ্যে পথচলা শুরু করে।
ধারনায় যদি ভুল না হয় তবে বলতে দ্বিধা নেই যে জাসদের মধ্যে দুটি সক্রিয় গ্রুপ ছিল। এক গ্রুপ নিয়ম তান্ত্রিক পথে হেঁটে রাজনীতির অনুশীলনকে প্রাধান্য দিয়ে গনতান্ত্রিক রাজনীতির চলমান পথকেই শ্রেয় মনে করেছেন। অন্য একটি যুদ্ধংদেহী গ্রুপ কিছুটা কমিউনিস্ট আদলের 'বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস' ধ্যানে জ্ঞানে নিজেদের পথ চলার রাস্তা তৈরী করেছিল বলেই মনে হয়েছে। তাদেরই সাগরেদ মুক্তিযোদ্ধাদের অতি উৎসাহী একটি গ্রুপ যারা সেনাবাহিনীতে থিতু হয়েছিলেন, তারা একটি চাপা অসন্তোষ নিয়ে দেশের ক্ষমতা বদলের কথা ভাবতেন বলে মনে করা হোত। শোনা যায় গনতান্ত্রিক রীতির রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে জাসদের সেই অতি উগ্র গ্রুপ তাদের রাজনৈতিক কর্ম চাঞ্চল্য বিকল্প পদ্ধতিতে এগিয়ে নেয়ার পথে হেঁটেছিল। ফলে তাদের ষড়যন্ত্রের গতিপথ দেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন পয়েন্টেও আস্তানা গেঁড়েছিল বলে শোনা যায় বা সেখানেও সর্ষের ভূত ছিল কিনা সেটাও গবেষনার বিষয়। সেক্ষেত্রে তাদের ভাবনাটা এত আত্মঘাতী ও নৃশংশ পর্যায়ের হবে তা শাসক শ্রেনীর কোন নেটওয়ার্কে ধরা পড়েনি। এমনকি সাধারন আমজনতা এসব নিয়ে কোনদিন ভাবতেও পারে নি। তাছাড়া গোয়েন্দা বলুন, আমজনতা বলুন বা আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর কথা বলুন, সবার মনেই একটা অন্তিম আস্থা বদ্ধমূল ছিল, তা হোল শ্রদ্ধা ভক্তি ও বিশ্বাস যোগ্যতায় দেশের মহান নেতা হলেন সবকিছুর উর্ধে। বাঙালী তার যাত্রাপথে শত ঝড় ঝঞ্জা বিরোধিতা ও অসহিষ্ণুতা থাকা সত্বেও কোন দিনই তাদের মহান নেতার বিনাশ সাধনের চিন্তাকে পাপ বলেই মনে করেছে। এব্যাপারে তারা সর্বোতভাবে নিটোল ছিল। কিন্তু শত সহস্র আস্থা ও উচ্চাশার ফাঁক গলে কোন্ দুষ্টুক্ষত বাঙালীর বাড়া ভাতে ছাই দিল সেটাই অযুত সহস্র প্রশ্ন। আগেই বলেছি পচা শামুকে পা কাটার কথা। সেই পচা শামুক যদি নিজের হেঁসেলেই অবাধ থাকে তখন রাজনীতি ও প্রশাসনিক দক্ষতা এবং দূরদর্শিতার কথাটিই সামনে আসে সর্বাগ্রে। রাজনীতির আবেগঘন সেইসব দিনগুলিতে প্রশাসন ও রাজনীতি যখন এক অন্তরাত্মা হয়ে রাষ্ট্র কাঠামোয় সবকিছু গুলিয়ে ফেলেছে তখন কে আপন কে পর, এই বাস্তবতায় দেশ কোন্ অবস্থানে ছিল সেটিও হাজারো প্রশ্নের জন্ম দেয়। তবে আর যাই হোক না কেন, পচা শামুকের ক্ষমতা পা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। মাথা কাটার ধার বা শক্তি তার ঝুলিতে থাকার কথা নয়।
সালটি ১৯৭৫। দিনগুলি ছিল অগ্নিগর্ভ। চারিদিকে ছমছমে ভাব। একদিকে রাজকীয় উত্থানের বিয়ে, পদক, পদ-পদবী, মিষ্টি মন্ডা ও পাইক পেয়াদা স্টাইলে আমত্য পরিষদের দৌড়ঝাঁপ আর অন্যদিকে মন মরা আমজনতার, গৃহস্থ বাড়ীর বিয়ের হাঁড়ি বারনের দাওয়াত খাওয়ার প্রস্তুতির আয়োজন। সাজ সাজ রব চারিদিকে। আগষ্টের পনের তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চল্লিশতম সমাবর্তনের অনুষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে বিশাল তোরন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম সমাবর্তনে মহান দেশনেতা সেখানে প্রধান অতিথি। জনমুখে চাউর হয়ে গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে নেতা দেশকে পার্শ্ববর্তী দেশের অঙ্গরাজ্য ঘোষনা করবেন। নিজের ছেলেকে সেনাবাহিনী প্রধান বানাবেন। এধরনের আরো সব বিদখুঁটে, আত্মঘাতি এবং অরুচিকর খবর মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চারিদিকে সবকিছু লাগামহীন অবস্থা। মানুষ একটি অশনির দশা নিয়ে চৌদ্দ আগষ্টের দিন শেষ করে রাত্রে ঘুমাতে গেল। সে রাত আর সকাল হোল না। ভোরের আযান বিউগলের সুর হয়ে বাঙালীর কানে বজ্রপাত ঘটালো। বাঙালী কালা ও বোবা হয়ে গেল।
যে বাঙালী রেসকোর্সের সেই তর্জনী উচানো মহান নেতার কাব্যময় বজ্রকন্ঠের অগ্নিমন্ত্রে দেশমুক্তির শপথ নিয়েছিল, সেই বাঙালী আজ বোবা-কালা হয়ে গৃহবন্দী যেন। তাদের মহান নেতা পরিবার পরিজনসহ ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে লাশ হয়েছে। জনপদে টু-শব্দটিও নেই। একদিকে বুটের দপদপানি আর অন্যদিকে একটা বোবা কান্নায় গোটা বাংলা গুমরে গুমরে ফোঁফাচ্ছে। বিভ্রান্ত জনপদের সামনে কেউ নেই। যাদের থাকার কথা ছিল তারা ঠিক একাত্তর স্টাইলেই গা ঢাকা দিল, পালিয়ে গেল। বোধ হয় তৎসময়ের মূল একাদশের সেরা স্ট্রাইকাররা দিল্লির আকবর রোডের '১০ নম্বর জনপথের' দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু আকাশবাণীর নীলিমা স্যানাল বা দেবদুলালদের আকাশ তরঙ্গ আর তোমাদের জন্য আর সেই বাণী নিয়ে এগিয়ে আসবেন না, যা তারা একাত্তরে করেছিলেন। সে পথ তো তোমরা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছ। তোমাদের নেতাকে তোমরাই মেরেছ। তোমাদের যুদ্ধকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষনা দিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ঘাতকদের ইন্ডিমিনিটি দিয়েছেন। বিদেশী মিশনে পদায়ন করে দেশের বাইরে পুনর্বাসন করে দিয়েছেন। আর কি চাই। এমন এক নারকীয় ও দুর্ধষ্য কায়দায় দেশের স্থপতিকে পরিবার পরিজনসহ হত্যা করার পর প্রকৃত অর্থে বাঙালী স্তম্ভিত ও বোবা হয়ে গিয়েছিল। মুখে ইন্না লিল্লাহ পড়ার কথাটিও ভুলে গিয়েছিল যেন। চোখের পানি ফেলতে ভুলে গিয়েছিল তারা। অনেকে এটা নিয়েও ট্রল করে, রাজনীতি করে। অশ্রাব্য কথা বলে। কিন্তু বুঝতে হবে এর আসল মোজেজা। বাঙালী তখনও বুঝেনি বা বিশ্বাস করতে চাই নি যে তাদের মহান নেতাকে এভাবে বিনাশ করা যায়। দেশের মহান স্থপতিকে এভাবে বিদায় দেয়া যায় না। এটা ঘৃন্য কাজ, পাপ। পনের আগষ্টের পরের ক'টা দিন মানুষ একটা বোবা কান্নার ঘোরে দিনাতিপাত করেছে। পিতার সাহচর্যে বেড়ে উঠা সেইসব পঁচা শামুকের দল মুখিয়া হয়ে দেশ শাসনের দন্ডটি হাতে নিল। বাংলার চলার গতিপথ নতুন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করলো।
(চলমান)