জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধুসর স্মৃতি - ১
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৩ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সেই যে বাহাত্তর সালে ঢাকায় ঢুকলাম, বেরোতে আর পারলাম কই? তেজগাঁও পলিটেকনিকের স্টাফ কোয়ার্টার দিয়েই আমার ঢাকা অধ্যায় শুরু। এইচ এস শেষ করেই ঢাকায় আগমন। পড়ালেখা, খেলাধুলা আর রাজনীতি সচেতনতা নিয়ে পথচলা। বাঙালী মানেই রাজনীতি। সেই রাজনীতির ছিটেফোঁটা ধুসর স্মৃতি নিয়েই কিছু লিখতে ইচ্ছে হোল, তাই কলম ধরা। তবে রাজনীতির উঠানে খুব বেশী যে সক্রিয় ছিলাম তা বলা যাবেনা। ফলে অবসরের এই সময়ে নির্মোহ ভাবে মোটা দাগের ঘটনা ও তার রাজনৈতিক বিচার বিশ্লেষন করে নিজেকে স্মৃতিকাতর করা ছাড়া এটাকে আর কিইবা বলা যায়। সব ধুসর আবছা যেন। কুয়াশাচ্ছন্ন ধুসর স্মৃতির ছিটেফোঁটা প্রয়াস। পঞ্চাশটি বছর, কমতো নয়। যদিও বামপন্থার আদর্শে বড় হওয়ার রসদ নিয়ে হাঁটার পথ পেয়েছি, তথাপি শেকড় বিহীন বাম ঘরানায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের প্যারাসাইটিক চলনে কেমন যেন একটা অনীহা ভাব চলে এল। তাছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলায় বাম ছাত্র রাজনীতির ঝলক একটু হলেও মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমদের নেতৃত্বে জেগেছিল বটে, কিন্তু রাজনীতির মাথাদের ক্ষমতার লেজুড়বৃত্তির বেহায়াপনায় সেই তারুন্যের জোশ দেশের বাম ঘরানাকে শক্ত জমাট বেঁধে দাঁড়াতে বাধাগ্রস্ত করে। বামপন্থায় চলমান ইনস্টিটিউট গুলো কখনোই ওভাবে চলে না, যেভাবে সদ্য স্বাধীন দেশের বাম ঘরানার উঠানগুলো ক্ষমতার পিছনে চানক্য হতে চেয়েছে। কি করে মনকে প্রবোধ দিই যখন দেখি বাম নেতৃত্ব একটি নীতিহীন ডানপন্থার রাজনীতিকে তাদের ঘরানার সুহৃদ বানিয়ে নিজেরা লাইম লাইটে থাকতে চেয়েছেন। শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তারা হয়তো ভেবেছিলেন রাষ্ট্র গঠনের স্তম্ভে যেহেতু 'সমাজতন্ত্র' কথাটি লিপিবদ্ধ হয়েছে; সুতরাং সেই সুড়ঙ্গপথে বামপন্থার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগোনোর এটাই মোক্ষম হাতিয়ার। কিন্তু আমার এই সত্তোর্ধ বয়সে রাজনীতির বর্তমান শাসক দলটি সত্যিকার অর্থেই কোন্ প্রজাতির রাজনৈতিক দল তা বুঝতে এখনও অক্ষম। ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনীতির তকমা লাগিয়ে তাদের চলনে বলনে কোন্ স্মৃতি স্মারক এপর্যন্ত তারা রেখেছেন যা নিয়ে প্রত্যন্ত অজ গ্রামের বেওয়া রেনুবালা দাস বা অশীতিপর বদরুদ্দি শেখরা মুক্ত নিশ্বাসে বলবে এটাই তাদের শেষ ঠিকানা।
বাহাত্তরে সংবিধান পেলাম। বলা হয় এমন জনবান্ধব সংবিধান পৃথিবীতে এই প্রথম। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া পক্ষটি ছাড়া এদেশে তখন গুটিকয় শ্লোগান সর্বস্ব বাম ঘরনার রাজনৈতিক দল ছাড়া তেমন কোন জন সম্পৃক্ত দল ছিল না। আওয়ামী লীগের জন্মদাতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাওলানা ভাসানী সাহেব স্বতন্ত্রতা রক্ষার্থে নিজ নামে গঠিত রাজনীতির উঠান বানালেও আমজনতা তার প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগকে সমর্থনের মাধ্যমেই তাকে স্মরন করতেন। ফলে দ্বিতীয় কোন মেজর প্ল্যাটফরম তৈরী হয়ে বাংলার রাজনীতিতে গনতন্ত্রের সুষম এবং প্রতিযোগিতামূলক অনুশীলনে জন সম্পৃক্ততা অর্জন করতে পারেনি। ভূমিষ্ঠ হওয়ার শুভক্ষনে বাংলার জমিনে জগদ্দল পাথরের ন্যায় একটি একপক্ষীয় রাজনীতির প্রতিরোধহীন সংস্কৃতির সূচনা হয়। যতই বামপন্থীরা সে সময়টাকে তাদের রাজনীতির সমাজতন্ত্র ও সামাজিক সুষম বন্টনের মোক্ষম হিসাবে বিবেচনা করুন না কেন, প্রকৃতপক্ষে গনতান্ত্রিক অভিযাত্রায় রাজনীতির প্রতিরোধহীন ফাঁকা মাঠে তৎসময়ের ক্ষমতাসীন দলটি সর্বক্ষেত্রেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। জন্মলগ্ন থেকেই তারা এই ধারনায় আত্মপোলব্ধ হন যে তাদের রাজনীতি ছাড়া এ জমিনে দ্বিতীয় পক্ষের কোন অস্তিত্ব নেই বা থাকতে পারেনা। ফলে জন্মলগ্নের সেই অত্যুচ্চ বাসনায় বেড়ে উঠা প্ল্যাটফরমটি গনতান্ত্রিক আচরনের ন্যুনতম প্যারামিটারে না থেকে বাংলার জমিনে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহিরে বেপরোয়া হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, মাসলম্যান দাদাগিরির রাজনীতিতে বাংলার গনতান্ত্রিক অভিযাত্রা এভাবেই বার বার হোঁচট খেয়েছে।
বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের সময়টুকুকে দুটো শ্লটে ভাগ করলে আমাদের বুনিয়াদী অস্মিতার প্রকৃত চালচিত্র পাওয়া যায়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যখন বিজয় এল, সে সময় একটি আগোছালো এবং বিচ্ছিন্ন পটভূমিতে বাঙালী তার বিজয়োল্লাসে সামিল হয়। প্রকৃত অর্থে যারা বাম ঘরানার বুনিয়াদে থেকে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে যুদ্ধজয়ী বীর হলেন তারা খুব সন্তর্পনে তাদের নিজেদের বাউন্ডারীর ভিতরে থেকেই বাঙালীর মুক্তি মিছিলে সামিল হলেন। পাশাপাশি তৃণমূলের সাধারন কিশোর যুবারা যুদ্ধজয়ীর বেশে আপন আপন ঘরে ফিরে গিয়ে গ্রামের সেই চিরায়ত আবহের অর্থাৎ বেঁচে থাকার সংগ্রামে ঘর গৃহস্তিতে মনোযোগী হলেন। আর যারা একক কর্তৃত্বের অহমিকায় অমুক সেনা তমুক বাহিনী সৃষ্টি করে নিজেদের সুপ্রিমেসী প্রমানে উড়নচন্ডী হয়েছিলেন, তাদের কর্তৃত্ববাদী আচরনেই সে সময় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তারাই ভবিষ্যত বাংলাদেশের সোনার ছেলে। ফলে সদ্য স্বাধীন দেশে খুন জখম প্রতিহিংসা ও সম্পদ লুন্ঠনের অগ্রভাগে বেপরোয়া হয়ে তারা চলাফেরা করেছে। একটি যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশে যুদ্ধ পরবর্তী চালচিত্রে যদিও এসব খুব স্বাভাবিক ঘটনা তথাপি দেশপ্রেমের অগ্নি শপথে সেইসব কিশোর যুবারা মহান নেতার আহ্বানে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেসবে ক্ষান্ত হয়েছে। অথচ তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে দেশের একধনের সম্পদ ও অর্থ লোলুপ ব্যক্তি সমাজে অনাচার মূলক কাজগুলি অতি সন্তর্পনে করে গেছে। ফলে তৎসময়ের নতুন প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছেন। আর সে দায় গিয়ে পড়েছে সদ্য স্বাধীন দেশের আনকোরা সরকারের উপর। আগেই বলেছি একচেটিয়া ও একমুখী রাজনীতির গনতন্ত্রায়নে অটোক্রাটিক শাসকের জন্ম দেয়। সদ্য স্বাধীন দেশের এহেন পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ছাত্র রাজনীতির অগ্রনী সেনারীরা ক্ষমতা গ্রহনকারী শাসকদের কাছে জনগনের অংশগ্রহনের নিশচয়তা ও জবাবদিহিতার প্রশ্ন উত্থাপন করেন। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া সদ্য স্বাধীন ভূখন্ডের আনকোরা সরকার তাদের সহযোগী সংগঠনের সেই আবদার প্রত্যাখ্যান করেন। ফলশ্রুতিতে বিরুদ্ধবাদী শক্তি হিসাবে ছাত্র রাজনীতির মুক্তিযুদ্ধ সংগঠকদের সেই ছাত্রশক্তি জনতার কাতারে নেমে এসে একটি নতুন জনভিত্তিক দল গড়ে তুলেন। বাহাত্তরের শেষের দিকে এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে। মানুষ নি:শ্বাস ফেলার জায়গায় হিসাবে তারুন্যের নতুন শক্তিকে গ্রহন করেন।
পাকিস্তানী মেকানিজমে ম্যান্ডেট নেয়া এমএনএরা স্বাধীন বাংলাদেশের নয়া জামানার শাসক হলেন। এখনকার সময়ে তো সংবিধান, আইন, শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে আমাদের শাসকেরা দিবারাত্রি ঢোল করতাল বাজিয়ে চলেছেন। সেই তাদেরই পুর্ব পুরুষেরা যখন পাকিস্তানী আইন প্রনেতার সীল গলায় ঝুলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আইন প্রনেতার ভূমিকায় দেশ শাসনের পরম প্রতাপশালী সরকার গঠন করেন তখন দেশ, আইন, শপথ এবং সংবিধানের হদিস কোথায় ছিল? ভুলে ভরা গোঁজামিল শুরুর এই বাংলাদেশ যাত্রা আমাদের পরবর্তী যাত্রায় কন্টকপুর্ণ ভুল ছাড়া শুদ্ধাচারনের কোন আচরন কি পাওয়া যাবে? স্বাধীন দেশের উচ্ছ্বাস নিয়ে সুর্যোদয়ের সেই আবীর খেলার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন ছাত্ররা ১৯৭৩ সালের প্রথম দিনে ভিয়েতনাম দিবস পালন উপলক্ষে একটি প্রতিবাদী শোভাযাত্রার আয়োজন করে। পহেলা জানুয়ারীর সেই ছাত্র মিছিলে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন ছাত্রদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কয়েকজন ছাত্রের জীবন কেড়ে নেয়। স্বাধীনতার লাল সুর্য সেদিন কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে গেছিল বলে আমার মনে হয়েছে। ১৯৭৩ সালের সাত মার্চে স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেদিনের সেই বাংলাদেশের গনতান্ত্রিক সূচনা পর্বের নির্বাচন ও ভোটদান পর্ব এমনকি তার ফলাফল নির্ধারনের পদ্ধতি বাঙালীর গনতান্ত্রিক অভিযাত্রার কোন সূচকে হয়েছিল তার পোস্ট মর্টেম করার প্রয়োজনীয়তা কি ফুরিয়ে গেছে? বিরুদ্ধ শক্তির রাজনীতি আসার ফলে দেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতি ও তার যুবশক্তি অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বার ও বেপরোয়া হয়ে উঠে। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির সেদিনের জমিনটা ছিল বড়ই ভয়ংকর ও বেপরোয়া।
আগেই বলেছি বিরুদ্ধবাদী মত ও শক্তির উত্থান দেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কারী দল কখনোই ধর্তব্যে নিতে চায়নি। ফলে তাদেরই উঠানের ভাইয়েরা যখন ভিন্নমতের রাজনৈতিক আকাংখা নিয়ে মাঠে নামলেন তখন তাদের বিনাশ করার লক্ষে রাষ্ট্রীয় মেকানিজমসহ তারা জনপদে রুদ্ররূপ ধারন করেছিল। এহেন পথ পরিক্রমায় দেশ যখন অনিয়ম, অরাজক এবং মজুতদারী সন্ত্রাস ও দুর্বৃত্তায়নে খাবি খাচ্ছিল তখন তারুন্য নির্ভর যুব শক্তির সেই দল জাসদ দেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতি ও অন্যান্য অরাজক অবস্থার নিরসনকল্পে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাসভবনে স্মারকলিপি পেশের লক্ষে মিছিল সহকারে মিন্টো রোডের দিকে গমন করেন। কিন্তু তৎকালীন শৃংখলা রক্ষা বাহিনী সেই মিছিল প্রতিহত করার লক্ষে জনতার মিছিলে পাখির মত গুলি করে জনা তিরিশেক জাসদ কর্মীকে হত্যা করে। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে কোন গনতান্ত্রিক মন্ত্র পড়ে আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশের পথচলা শুরু হয়েছিল। তাছাড়া ভিন্নমত দমনে সে সময়ের সরকার 'রক্ষীবাহিনী' নাম দিয়ে যে দুর্ধষ্য বাহিনী গঠন করেছিল তা তো ইতিহাস হয়ে রয়েছে। রক্ষী বাহিনীর সেদিনের অমানবিক নির্যাতন এবং ভিন্নমতের ছাত্র ও যুব শক্তি বিনাশের লোমহর্ষক চিত্রগাঁথা বাংলার আটষট্টি হাজার গ্রামের প্রতিটি ধুলি কনায় মিশে আছে। পাশাপাশি আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনীর নাকের ডগাই দাঁড়িয়ে সরকার পুষ্ট ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্তৃক সেদিনের সুর্যসেন হলের সাতজন ভিন্ন মতাবলম্বী ছাত্রকে পাকিস্তানী মিলিটারি কায়দায় ব্রাশ ফায়ার করে খুন করার বিষয়টি তো ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে। কুখ্যাত সেভেন মার্ডারের সেই মহানায়ক ছিলেন তৎসময়ের সরকারী অঙ্গ সংগঠন ছাত্র লীগের সাধারন সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান। সেই শফিউল আলম প্রধানকে যখন গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকানো হয় তখন সে সময়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীসহ জাতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদসহ আজকের দিনের সরকার দলীয় সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেররা তার মুক্তির জন্য মিটিং মিছিল ও রাজপথে আন্দোলন করেছিলেন। সুতরাং অনুমান করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কি বিচ্ছিন্ন এলোমেলো পরিস্থিতির মোকাবিলা করে সেদিনের অনকোরা শাসক গোষ্টি একটি সদ্য জন্ম নেয়া দেশের হাল ধরে এগোতে চাচ্ছিলেন। দেখা গেছে প্রশাসনিক অপ্পরিপক্কতার খেসারতে দেশের শাসক শ্রেনী প্রায়শ: ক্ষেত্রে হোঁচট খেয়েছেন।
(চলমান)