জালাল উদ্দিন আহমেদ
ভাইচারা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ আগস্ট,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই এই ভাইচার বা ভাইচারার ব্যাপকতা। সম্ভবত: আমার জন্মকালের বছর সাতেক আগে ইস্টার্ণ টকিজের বোম্বে স্টুডিও থেকে ভাইচারা নাম দিয়ে একটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। ছবির কাহিনী অত মনে করতে না পারলেও নামকরনের সূত্র ধরে বলা যায় কোন্ উপলক্ষকে সামনে রেখে ওই সিনেমাটি তৈরী করা হয়েছিল। আমাদের জীবনে চলার পথে এই ভাইচারার সহজাত প্রবৃত্তি কমবেশী দেখা যায়। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে এই শব্দটির অর্থ খুব ব্যপকতা না পেলেও প্রকৃত অর্থে এই ভাইচারার ব্যপকতায় আজকাল সমাজ এবং রাষ্ট্র বেশ সামঞ্জস্যহীন হয়ে ধরা পড়ছে বলে মনে হয়। আপনত্ব, আত্মীয়তার বন্ধন, বংশীয় টান, গোষ্ঠীতন্ত্র, ধর্মীয় পক্ষাবলম্বন এবং আঞ্চলিকতাসহ জাতীয়তাবাদের বিশালত্বে এই ভাইচারার ব্যপকতা আসলেই বহুল বিস্তৃত এক সাম্রাজ্য। এর পোস্ট মর্টেম করতে গেলে বিশাল এক গদ্য কবিতার জন্ম হবে।
ক'দিন আগেই ইউ টিউবের একটি ভিডিওতে ভাইচারার একটি সুখকর দৃশ্য দেখলাম। আসামের করিমগঞ্জে ঈদুল আজহা উপলক্ষে এক ভাইচারার আয়োজন করা হয়েছে। সম্ভবত: মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছে। রান্নাবান্নার বিশাল আয়োজন। ধর্ম নির্বিশেষে প্রচুর মানুষের ভিড়। বিরাট ডেগ বা হাঁড়ি থেকে রান্না করা খাদ্য থেকে যে যার মত নিচ্ছে এবং খাচ্ছে। একটি আমুদে পরিবেশ। গেরুয়া বস্ত্রের কপালে তিলক দেয়া ভাইটি টুপি পাঞ্জাবী পরা ভাইটির সাথে কোলাকুলি করছে। পাশে গান বাজনার শব্দও কানে আসছে। অবশ্য হিন্দুস্তানী আদলের এই ভাইচারা তাদের দেশীয় সামগ্রিকতার নিরিখে বেশ অর্থপুর্ণ বটে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সুষ্ঠতা এবং অখন্ডতার নিরিখে এই ভাইচারার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। জাতীয়তার সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থেই এসব কর্মধারা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হয়ে থাকে। রাজনীতির বিভিন্ন উঠান থেকেও সৈহার্দ্য ও সম্প্রীতির এসব আয়োজন করা হয়। তবে রাজনীতিতে যখন থেকে ধর্মীয় আদর্শ নিয়ে হাঁটার পথ তৈরী হলো তখন থেকেই এই সামষ্টিক ভাইচারার রঙটা ফিকে হতে শুরু করলো। তারপরেও অনেক ধর্মগুরু, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজ সংস্কারক সামাজকে মানবতার ভাইচারায় সমৃদ্ধ করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। বর্তমান সময়ে সমাজ এমন এক পঙ্কিলতায় জড়িয়ে গেছে যে সুনির্দিষ্ট করে সেসব মহাপুরুষদের নাম নিলে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি নিয়ে অনেকেই ধেই ধেই করে নাচা শুরু করে দেবে। এহেন পরিস্থিতিতে বর্তমান সময়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের এই উগ্র আচরনেই বিশ্ব ভূমন্ডলে ভাইচারার সুখকর বাতাবরন কেন যেন মানব সমাজ থেকে দূরে সরে গেছে। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই - বর্তমান বিশ্বে সম্প্রদায়, সাম্প্রদিকতা, ভাইচারার আয়োজন, ধর্মীয় রাজনীতির দামামা এমনকি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, আইন আদালত কোট কাছারী সব কিছুরই ইজারাদার এখন ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত নামক রাষ্ট্রটি। তাদের সেই ১৯৪৩ সালের ভাইচারা সিনেমা নির্মানের চিত্রই তো বলে দেয় এসব সাম্প্রদায়িক হিংসা বিদ্বেষ কমাতে হলে কথিত ভাইচারা কতটা গুরুত্বপুর্ণ। বিশ্ব ব্রম্ভ্রান্ডের দিকে তাকালে এসব সম্প্রদায়গত ভাইচারের নগ্নতা চোখে পড়ে। তবে তা খুব অল্প পরিসরে। ভাইচারার নগ্নতার কথাটি একারনেই এল যে নিজস্ব জাতিগত অস্তিত্ত্ব মজবুত করার মানসে পাশাপাশি সহাবস্থানের অন্য সম্প্রদায়ের উপর যে স্টীম রোলার চালানো হচ্ছে তা সত্যিকার অর্থেই অমানবিক। তার উত্তাপ খুব বেশী বলেই বৈশ্বিক অসন্তোষে এর প্রভাব প্রকট আকারেই বিরাজমান।
জাতিগত উষ্ণতায় এই ভাইচারের এক নিজস্ব দিক রয়েছে। পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন, একজন বাঙালী তার বিদেশ বিভুঁয়ের নি:সঙ্গতা কাটাতে অন্য এক বাঙালীকেই খুঁজবেন। নিদেনপক্ষে সেটাও যদি না জুটে তখন তিনি আঞ্চলিকতার মোড়কে ভারতীয়, পাকিস্তানী, শ্রীলংকান বা নেপালীকে খুঁজে ফিরবেন। ভাইচারার বিস্তৃত পসার এটি। মনে পড়ে নব্বই দশকের কথা। সম্ভবত: ছিয়াশি সাতাশি সালের দিকে হবে হয়তো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ট্রেনিং এবং স্টাডি ট্যুরের প্যাকেজ প্রোগ্রামের শেষ পর্যায়ে তখন আমি সুজারল্যান্ডের বাসেল শহরে। হোটেল এমবাসেডরে উঠেছি। দশ দিনের অবস্থানে শেষের দিকে রূম সার্ভিস এটেনডেন্ট হিসাবে এক শ্রীলংকান যুবককে পেলাম। মনটা একটু হলেও ভাল হয়ে গেল। তখন শ্রীলংকায় এলটিটিই সমস্যা চলছিল। ফলে শ্রীলংকান তামিলরা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে এসাইল্যাম হিসাবে আশ্রয় পেয়েছিল। মনে পড়ে ছেলেটি বেশ চোস্ত এবং স্বশিক্ষত। ভাল ইংরেজী বলে। কথার ফাঁকে সে আমাকে জানাতে ভুল করেনি যে সে একজন ফ্রিডম ফাইটার। তার এই হোটেল চাকরীর আয়ের একটি অংশ এলটিটিই ফ্রিডম ফাইটিং ফান্ডে চাঁদা হিসাবে প্রদান করে। জাতীয়তাবোধ ও জাতিগত ভাইচারা সহমর্মিতার সেদিনের সেই চল্লিশ বছর আগেকার স্মৃতি আমাকে এখনও আবেগ তাড়িত করে। পুচকে সরকারী কর্মচারী হিসাবে আমি তাকে পঞ্চাশ ফ্রাঁ দিয়েছিলাম এবং হোটেল ত্যাগ করার মুহূর্তে তার সম্মতি নিয়েই আমার পরনের একটি প্যান্ট ও একটি শার্ট দিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে সেই মূহূর্তটা যখন তার হাতে মুক্তি সংগ্রামের চাঁদাটা এবং তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কাপড় চোপড় দিচ্ছিলাম তখন তার চোখ মুখের ইস্পাত দৃঢ় অভিব্যক্তি আমাকে বেশ আবেগ তাড়িত করেছিল। তার নিজের ভাইচারে সে যেমন আবিষ্ট ছিল পাশাপাশি উপমহাদেশের প্রতিবেশীর ভাইচারে আমরা দুজনেই শরীক হয়েছিলাম। ফেরার সময় সে নিজ হাতে আমার লাগেজ নামিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছিল এবং না হলেও পাঁচ থেকে সাতবার আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিল।
এখন যে ভাইচারের কথাগুলো বলবো সেটা নিছকই ব্যক্তি সমাজ রাষ্ট্র জীবনের কথা। রাষ্ট্র জীবনের ভাইচারে বহুজাতিক সমাজ হলে তখন দেশীয় বৃহত্তর স্বার্থে ভাইচারার প্রয়োজনটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই অনুভূত হয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় তখন সামগ্রিক সুষমতার অভিপ্রায়ে ভাইচারার বিষয়ে সজাগ থাকতে হয়। কিন্তু একই জাতি গোষ্ঠীর সমাজবদ্ধতায় রাষ্ট্র গঠিত হলে তখন ভাইচারের গতি প্রকৃতি অন্য আদলে প্রকাশিত হয়। তখন সেটা সামগ্রিকতার বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয়। ধরুন আমি একটা মফস্বলের জেলা হতে উঠে এসেছি। পদাধিকারে অনেক উঁচু পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। সেক্ষেত্রে আমার পদ ও পদাধিকারের বলে আমি হয়তো যোগ্যতার সমন্বয় ঘটিয়ে দু'চার জন আত্মীয় স্বজনকে তাদের রূটি রূজির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু পারবারিক ভাইচারের সর্বোচ্চ অপব্যবহারে আমি যদি গুষ্টিশুদ্ধ যোগ্য অযোগ্য সবাইকে এনে প্রতিষ্ঠানের ভাবমুর্তি ক্ষুন্নসহ সেটিকে দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসাবে অধ:নমিত করি তখন পারিপার্শিক যোগ্যতার অব্জেক্টগুলো আমার পারিবারিক ভাইচারের অপব্যবহারের প্রশ্ন উঠাতে পারে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিন্যাসে এলোমেলো প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এমনি করে ক্ষমতার অপপ্রয়োগের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিকতার ভাইচারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ইদানীংকার রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি আঞ্চলিকতার ভাইচারে জেলা বা বংশের ব্রান্ডে চিহ্নিত হয়ে সমাজ তথা রাষ্ট্রে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ধারনা জন্মাচ্ছে। আবার রাজনৈতিক পরম্পরার ঢালাও ইদানীং প্রশাসনে যে ভারসাম্যহীনতার অশুভ খবরগুলো প্রকাশিত হচ্ছে তাতে করে ভাইচারের এই অপপ্রয়োগ সমাজ তথা রাষ্ট্র বিনির্মানের প্রতিবন্ধকতার আলামত সৃষ্টি করে। কর্ম জীবনের সুষমতায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। ফলে রাষ্ট্রীয় কর্মযজ্ঞের সর্বক্ষেত্রে মৃদু ও প্রকাশ্য অসন্তোষের জন্ম দেয়। দেশীয় উন্নয়নশীলতার অধ:গতিসহ সার্বিক উৎপাদনশীলতায় নিম্নগতি পরিলক্ষিত হয়।
ভাইচারের উষ্ণতায় দেশ অঞ্চল তথা ভূমন্ডলের মানব জীবন একটি সুন্দর এবং বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বকীয়তায় ভাস্মর হয়। কিন্তু ভাইচারার অতি ব্যবহারের বাস্তবতায় তা অনেক সময় বুমেরাং হয়ে মানব সভ্যতার উৎসে কাঁটা হয়ে সর্বদা দংশন করতে থাকে। ভাইচারের আতিশয্যে মানব জীবনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মধারায় অসন্তোষ ও বিচ্ছেদের বিউগল বাজার উপক্রম হয়। জানিনা ভাইচারার নতুন আবহ কিনা! পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপন(প্রথম আলো ১০ আগষ্ট, পৃ: ১৪)। একজন দেশ বরেণ্য শিল্পীর জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন সেটি। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, উদ্বোধক, বিশেষ অতিথি এবং সভাপতি - সবাই আমলা বলয়ের গন্ডিতে বিচরন করা ব্যক্তিত্ব। ভাইচারার এটিও একটি নতুন বলয় কিনা সেটা আপনারাই অনুমান করুন!