জালাল উদ্দিন আহমেদ
মোটা দাগের ভুল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ আগস্ট,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
রাজনীতি আদর্শের জায়গায়। রাজনীতি মানুষকে পরিশীলিত করে। রাজনীতি সমাজকে আলোকিত করে। জীবনবোধের পথ দেখায়। রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্রগাঁথায় বলিষ্ঠ হয়। এসব বস্তাপচা কেতাবী কথা শুনার মানুষ বোধ হয় সমাজ থেকে আস্তেধীরে কমে যাচ্ছে। চোখে সোনালী ফ্রেমের বাই-ফোক্যাল চশমা, গায়ে দামী শিল্কের পাঞ্জাবীর উপর হাতা কাটা কাল কোট পরিহিত চেতনার স্বপক্ষ শক্তির পরীক্ষিত নেতাটি স্বগোক্তি করে বলে উঠবেন, আরে ধুর! এসব কাগুজে কাথাবার্তা বহু শুনেছি। এগুলো নিয়ে বহু অনুশীলন করেছি। নিজের জীবন যৌবন উৎসর্গ করে বাংলার জন মানুষের জন্য রাজনীতির ভাল ভাল উপসর্গ নিয়ে উঠান বৈঠক করেছি, জনসভা করেছি, মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বৈঠকি আলোচনায় বসেছি। এসব করে কি হবে? আজকের রাজনীতিতে এরকম কর্মী বা রাজনীতির ব্যক্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে কি? আজকের রাজনীতির চরিত্রগুলো এই ধারাপাতে আছেন কি? পাড়া মহল্লা সামাজ এমনকি রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে রাজনীতির এই অনুশীলন আছে কি? মহাশয়ের মাটির দিকে তাকিয়ে এই বিড় বিড় করা বাক্যগুলিই আজ বাংলার রাজনীতির আহাজারি। কিন্তু যখন দেখি এই রাজনীতির বাঁশির সুরে এখনো গ্রাম বাংলার অজুত সহস্র আনপাড় খেটে খাওয়া মানুষ নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে নেতা নেত্রীদের পিছনে দিনরাত এক করে গলদঘর্ম হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে বাঙালী তার হারিয়ে যাওয়া বুনিয়াদী উচ্ছ্বাসের সেই দিনগুলি এখনও ভুলেনি। রাজনীতির তঞ্চকতায় নেতা নেত্রী ও তাদের পাটাতন যতই বাংলার মানুষকে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার যাত্রাপথে বঞ্চিত করুক না কেন, বাঙালী সব সময় রাজনীতি সচেতন থেকেই তাদের কাংখিত লক্ষ্যপথে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজেছে।
ক্ষমতা এমন এক জিনিস যা ক্ষমতা বলয়ের পাশে বিচরন করা মানুষগুলিকে এবং সামনে থাকা ক্ষমতাসীন মানুষটিকে মহান করে, উদার করে, সহনশীন এক পরিশীলিত প্রতিষ্ঠানে পরিনত করে। ক্ষমতা মানুষকে উদার, মহৎ এবং ক্ষমাশীল হওয়ার অনুভূতিতে উৎসাহ যোগায়। ক্ষমতা মানুষকে ক্ষমা করবার সাহসে উজ্জীবিত করে। রাজনীতির মানবিক মূল্যবোধ, সহনশীলতা, ধৈর্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহমর্মিতার অনুশীলন সাধারন মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে। গনতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর রাষ্ট্রে রাজনীতির স্বচ্ছতা, নির্লোভ ও নিরহংকারী আচনের অনুশীলন জনপদে সুষ্ঠ ও সমতা নিয়ে জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দেয়। সেরকম আশা আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন নিয়েই রচিত হয়েছিল আমাদের পূন্যভূমি এই সোনার বাংলার পথচলা। সেক্ষেত্রে রাজনীতির পথে হেঁটে রাজনীতিবিদ যখন দেশ শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন তখন তিনি একটি সুনির্দিষ্ট রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে না থেকে রাষ্ট্র কাঠামোর কর্ণধার হন। ফলে তাকে রাজনীতির উর্ধে উঠে রাষ্ট্রনীতির সার্বিক সমন্বয়ক হিসাবে কাজ করতে হয়। আমাদের এই ভূখন্ডে হয়েছে তার উল্টোটা। গনতান্ত্রিক অভিযাত্রায় হেঁটে চলা রাজনীতির মানুষগুলো যখন গনমানুষের ভালবাসা নিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন তখন তাদের চলার চিত্রপটে নতুন সংলাপ লেখার এন্তেজাম শুরু হয়। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে তখন তারা প্রবল প্রতাপশালী প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তবে সমস্যাটা হয় তখন যখন গনমানুষের পছন্দের সেই মানুষটি প্রশাসকের ভূমিকায় থেকে একপেশে রাজনীতির কান্ডারী হয়ে যান। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির শো-কেশে এটাই বোধহয় সবচেয়ে আলোচিত এবং অভিশপ্ত ঠিকুজি।
যে কথাটি বলার জন্য আমার এত এত কথা বলতে হলো তার মূল প্রতিপাদ্য হোল রাজনীতির প্রয়োগ। যে মেধা ও শ্রমের বিনিময়ে গনমানুষের কাছের মানুষ হয়ে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষে চলে এলেন তিনি সর্বক্ষেত্রেই যে চৌকস হবেন সেটা মনে করার কোন কারন নেই। সেক্ষত্রে সেই মানুষটিকেও বুঝতে হবে তার পারঙ্গমতার দৌড়। এ পর্যায়ে তাকে একটি শক্তিশালী দেশপ্রেমিক প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য মনোযোগী হতে হবে। আমরা দেখেছি মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীকে। দেখেছি সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীকে। একজন ভারত আন্দোলনের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা। নিম্নাঙ্গ জরাজীর্ণ ধুতি মুড়ানো আর নাঙ্গা শরীরের সেই মানুষটির তেজে পরাক্রমশালী বৃটিশ শাহী মাথা নত করে ভারত ছেড়েছিল। দেখেছি ধর্মীয় নেতা খোমেনীকে যার রুহানী নেতৃত্বে গোটা পরস্য জাতি একট্টা হয়ে ইরানের ২৫০ বছরের রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। অথচ রাষ্ট্র শাসনের ধারে কাছেও তারা বিচরন করেন নি। রাষ্ট্রীয় মুরব্বী হিসাবে তাদের বিচরন রাষ্ট্র ও জাতিকে আলোকিত করেছে। বাংলার অপামর জনসাধারন তাদের মহান নেতাকে সেই আসনেই বসাতে চেয়েছিল। তিনি একটি দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্থপতি, স্রষ্টা এবং সেই জাতির পিতা। সেক্ষেত্রে কোন্ বীরবল বা গোলাম হোসেনদের পরামর্শে তিনি পার্থিব চাহিদার সামান্য প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন সেটাই বোধে আসেনা। ওই পদে বসে তিনি কি ধন্য হয়েছেন? নাকি, তিনি ওই পদে বসেছিলেন বলে বাংলার ওই পদ দুটি ধন্য হয়েছে। যারা গবেষক তারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো কোনটা সহি আর কোনটা সহি নয়। মহান নেতার স্পর্শে উজ্জ্বল হওয়া ঐ দুটি চেয়ারের ঔজ্জ্বলতা কি আমরা রক্ষা করতে পেরেছি?
রাজনীতির যে ভুল দিয়ে আমাদের স্বাধীন ভূখন্ডের যাত্রা শুরু সেই রাজনৈতিক ভুলটাই সেদিন আমাদের জাতির হৃৎপিন্ডে আঘাত করেছিল। একজন গনমানুষের দেবতুল্য মানুষ যখন চোরা গাজী বা গুপ্তঘাতক খন্দকারদের নিয়ে প্রশাসনিক প্রধান হবেন তখন কোন ক্ষমতাবলে তার চলার পথে তিনি সাবলীল হতে পারবেন! শুনেছি পচা শামুকে পা কাটলে সেই পা কেটে ফেলতে হয়। আমাদের তো সেই পচা শামুকের ছোবলে মাথাটাই কাটা গেল। যাহোক, রাজনীতির ঝড় ঝঞ্জায় পিতা যখন শাসক হয়ে সবকিছু সামালে নিচ্ছিলেন তখন কোন্ ঘাতক পোঁকার দংশনে তাঁর সারাজীবনের সাধনার গনতান্ত্রিক আন্দোলনের সাজানো মাঠকে তিনি একনায়ক সমাজতান্ত্রিক সার্কাসের মাঠ বানাতে চাইলেন! যে গণতন্ত্রের অনুশীলনে তিনি তাঁর জীবন যৌবনের পঞ্চান্নটি বছর কৃচ্ছ্বসাধন করলেন সেই তিনিই তাঁর প্রিয় জনমানুষের ম্যান্ডেট না নিয়ে এক ফরমানের মাধ্যমে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সরকার কাঠামোর আদলটাই বদলে ফেললেন! অতিভক্তির ক্ষমতা লোভীরা হয়তো আমার এই কথাগুলি শুনে হারে রে রে করে তেড়ে আসবেন। কিন্তু বন্ধুরা, যা হারিয়েছি তা কি ফেরত পাব। আর পিতার বসা সেই পবিত্র চেয়ারে বসে এখন আমরা যা করছি তাতে পিতা কি সম্মানিত হচ্ছেন! মনে নেই, সেই ভুলের প্রায়:শ্চিত্যের ২১টি বছর। মনে রাখবেন ওই প্রায়:শ্চিত্য কিন্তু কোন দল বিশেষের নয়। ওই কালিমালিপ্ত প্রায়শ্চিত্য ছিল গোটা বাঙালী জাতির। বাংলাদেশের চলমান গণতান্ত্রিক ধারাকে হঠাৎ করে বাকশাল সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ধারনাকে পালটে ফেলার সেই ভুলটি ছিল বাংলার রাজনীতির প্রথম ভুল।
আমরা আবারো কি সেই ভুল পথের ঘোড়ায় সওয়ার হয়েছি? হয়তোবা তাই। নইলে এত এত চিৎকার চেঁচামেচি আন্দোলন রক্তপাত জীবনহানি, তারপরেও একবিংশের এই আলো ঝলমল ডিজিট্যালের যুগে পিতৃ পরম্পরার সুযোগ্য কন্যা ক্ষমতা ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা পুরনে আবারো সেই রাজনৈতিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাইলেন কেন? জাতীয় আকাঙ্ক্ষার চলমান ধারাকে বদলে ফেলার সেই আটচল্লিশ বছর আগের ফরমান জারির মতই নতুন এক ফরমানের জন্ম দেয়া হোল সংবিধান নামক দেশের পবিত্র গ্রন্থে। এক রাজনৈতিক ভুলের খেসারতে আমরা আমাদের পিতৃব্য জাতির স্থপতিকে হারিয়েছি। কারন সেদিনের অতিভক্ত একদল চামচের কু-পরামর্শে তিনি যে রাজনৈতিক ভুলটা করেছিলেন তার মাশুল তিনি যে তাঁর জীবনের বিনিময়ে দিয়ে গেছেন তা কিন্তু নয়। তাঁর সেই নৃশংশ অপমৃত্যু একটি জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সেই অতিভক্ত চামচাদের কিছু জীবিত আদম এবং তাদের উত্তর পুরুষেরা আবারো সেই ভুল রাজনীতির ধারাপাত নিয়ে বংশ পরম্পরার সবেধন নীলমনি পিতৃকন্যা জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে অতি উৎসাহী করে তুলছেন। ফলে দেশ এক ঝঞ্জাময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি চলমান সুষ্ঠ ব্যবস্থার নির্বাচন পদ্ধতিকে হঠাৎ করে পাল্টে ফেলে চলমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ক্লজ সংবিধানে সংযোজন করার বিষয়টি প্রতিপক্ষ রাজনৈতক দল সমুহ এমনকি সাধারন আম জনতা সন্দেহের চোখে দেখতেই পারে। ক্ষমতা হারানোর আশংকা থেকেই এই আইনি পদক্ষেপ বলে বিজ্ঞজনেরা বলাবলিও করছেন। বর্তমান সময়ে রাজনীতির সহনশীলতা, গনতন্ত্রের সহমর্মিতা এবং জনগনের ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বচ্ছ্ব নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যেভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাদা ছুড়াছুড়ির সুত্রপাত হয়েছে এবং তার গতি বেগবান হচ্ছে তা কি ওই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফসল নয়?
স্বাধীন বাংলার চলমান হাফ সেঞ্চুরির বয়সকালে মোটাদাগে এই দুটি রাজনৈতিক ভুল ভূখন্ডের স্থিতিশীলতা নস্যাতের প্রধানতম কারন হয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে - এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
পাদটীকা:
রাজনীতির বর্তমান গনতান্ত্রিক চর্চা স্বাস্থ্য সম্মত নয়। নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই এই আহাজারি সমানে চলেছে। কিন্তু কি আর করা। গনতন্ত্র পাগল বাঙালী তার জন্ম সূত্রের উত্তরাধিকারে গনতন্ত্রের ন্যুনতম চাহিদায় প্রানখুলে মনের কথাগুলো বলা, ভোটের অধিকারে শতভাগ নিশ্চিত থাকা, প্রয়োজনে নিজেদের দু:খ দুর্দশার কথা জানাতে মিছিল অবরোধ অবস্থান কর্মসূচি ইত্যাদির আয়োজনে সব সময় উচ্চকণ্ঠ। সেক্ষেত্রে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পাঁচ বছর পর মুক্ত বিশ্বাসে বাঙালী তার উৎসবের ভোটাধিকার প্রয়োগে গনতান্ত্রিক রীতির পুর্ন মর্যাদায় বিচরন করতে চায় - এটা আজকের দিনের মূল প্রতিপাদ্য। আমরা ওয়েষ্ট মিনিস্টার ও ভারতীয় গনতান্ত্রিক চর্চার কথা বলি। কিন্তু কথিত ওসবের কোনটিই কি আমরা মেনে চলি? পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যখন পনের বিশ পার্সেন্ট ভোট নিয়ে হাউজে যান তখন এই ভোটের নিম্নহারই তাকে জবাবদিহিতার পর্যায়ে না রেখে একজন জনশোষক বানাতে উদবুদ্ধ করে। আর নেতা কেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতার শিখরে থাকা মানুষটিকে তখন জনতার সেবক না বানিয়ে একজন স্বেচ্ছাচারী শাসক বানিয়ে ফেলে। এসবের পদ্ধতিগত পরিবর্ধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন আবশ্যিকভাবে আশু কর্তব্য বলে মনে করি।