জালাল উদ্দিন আহমেদ
চক্রব্যুহ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ জুলাই,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কিসের কি! পান্তাভাতে ঘি। এরকম একটি প্রবাদ বোধ হয় প্রচলিত আছে। অর্থাৎ মহাশয়ের যদি ইচ্ছে হয় তবে তিনি পান্তা ভাতে ঘি মাখিয়েও খেতে পারেন। এই পারা না পারার বিষয়টি নির্ভর করে ক্ষমতার শেকল তৈরী হওয়ার শেকড় এবং তার শক্তপোক্ত গাঁথুনীর গিঁটটা কতটুকু মজবুত তার উপর। আমরা বটগাছের ঝুরি দেখেছি। কিন্তু এই বটের ঝুরি সেই বটেশ্বরের বুনিয়াদ তৈরীতে কতটুকু শক্তি যোগায় তা বোধ হয় খেয়ালে আনি না। ছোটবেলায় পড়েছিলাম কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেই শতবর্ষীয় বটবৃক্ষের কাহিনী। শত একর জায়গায় জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কালের সাক্ষী ইতিহাস তৈরী করে আমাদের মনের প্রশান্তিতে স্থান করে রেখেছে। অথচ তার বেড়ে উঠার আগ্রাসী সময়গুলি কি আমরা মেপে দেখেছি! এই বটবৃক্ষের বটায়ু(রূপক অর্থে)হওয়ার সেই জটিল প্রক্রিয়া কি কোন এক পৌরানিক মহারাজার আধিপত্য বিস্তার কিংবা বাংলায় ঘটে যাওয়া সেই মাৎস্যন্যায় যুগের সঙ্গে মিল রেখে হয়নি? মোটকথা গাছের রাজা বট, পশুর রাজা সিংহ আর মানুষের রাজা মহারাজ। আর বংশের রাজা শেখ না সৈয়দ সেটাই বিবেচ্যে এনে আমার এই প্রয়াস।
ছোটবেলায় গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বংশ পরম্পরার জৌলুষ বা তা নিয়ে হিংসা বিদ্বেষ রেশারেশি দেখেছি। দেখেছি যুদ্ধংদেহী লাঠালাঠি কুপাকুপি। একটি গ্রামে দুটি পাড়া আছে। হয়তো দেখা গেল এক পাড়ায় তালুকদার বংশের আধিক্য তো অন্য পাড়ায় হাওলাদার বংশের প্রভাব। সেক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি জাহির করতে গিয়ে তাদের এই এপাড়া ওপাড়ার নটখট প্রায়শই ঝগড়া বিবাদে রূপ নেয়। গ্রাম বাংলায় এসব চেনা চিত্র। কিন্তু চালচিত্রের সেই চেনা কাহিনীর পুনরুত্থান যখন গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাজধানীতে এমনকি তার বিস্তার যদি দেশীয় আঙ্গিকের প্রেক্ষিতে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে কিচিরমিচির করে তখন সেটা তো রাজা রাজড়ার সেই মধ্যযুগীয় ছবির পুনর্জন্ম বলেই মনে হয়। সেক্ষেত্রে প্রাচীন বা মধ্যযুগের সেই রাজ পরিবারের ব্যপ্তি বা জৌলুষ একটি গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। অর্থাৎ রাজ প্রাসাদের বাউন্ডারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তার হিসাব নিকাশ। তারা মহা প্রতাপশালী শাসক থাকতেন ঠিকই কিন্তু তাদের বিচরন ক্ষেত্র ছিল নিজেদের বাউন্ডারীর ভিতর। সাধারন জনগনের প্রতিবেশ পরিজন হওয়ার ধারনার বাইরে তাদের অবস্থান সুষ্পষ্ট ছিল। কিন্তু ইদানীংকার শাসক শ্রেনীর বংশ পরম্পরার ব্যপ্তি এবং তার শেকড় বাকড় বিস্তারের যে ব্যপকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটা মোটেই শুভ লক্ষ্মন বহন করে বলে মনে হয় না। পরিবার পরিজনের শাখা প্রশাখার ব্যপ্তি এখন বংশ পরম্পরার সুক্ষ্ম লক্ষ্মন রেখাকে ছাড়িয়ে নতুন মেরুকরনের রূপ নিয়েছে। এমনকি বন্ধু বান্ধব চাকর বাকর ও তাদের আত্মীয় পরিজনরাও আজকাল বংশ পরম্পরার সংজ্ঞা বদলে দেয়ার প্রত্যয়ে কোমর বেঁধে নেমেছে। ঠিক যেন সেকালের পাইক পেয়াদা, নকর নফর, দেওয়ান খাজাঞ্চি, উজির নাজিরের তকমা লাগানোর স্টাইলে। আমার এক কর্মজীবনের বন্ধুকে জানি। নাম মাহবুব শেখ। তিনি বেশ চৌকস এবং উচ্চ শিক্ষিত। সাধারন পরিবারের ছেলে। প্রেম করে বিয়ে করেছেন এক বনেদি চৌধুরী পরিবারে। বিয়ে করার পর তিনি হয়ে গেলেন মাহবুব চৌধুরী। তো, এই হচ্ছে আমাদের জাতে উঠার ছোট্ট একটা ক্লিপ।
কেন এতসব লিখছি, তাও জানি না। তবে বংশ পরম্পরা ছাপিয়ে ওই উঠানটি যখন বন্ধু বান্ধব চাকর বাকরের সবাইকে নিয়ে এক স্বর্নলতার মত পরজীবি আবহের পরম্পরা তৈরী করে, তখন আদিরাই যে এক সময় ওই স্বর্নলতা পরম্পরারদের দ্বারা কুপোকাত হয়ে অঘোরে প্রান হারান তার ভুরি ভুরি নমুনা ইতিহাস দিতে পারে। কাউকে হেয় করার জন্য নয়। শুধুমাত্র সতর্কতা অবলম্বনের উদ্দেশ্যেই আমার এই কালির আঁচড়। হয়তো রিন্টু তার চলন বলনে সেরকম থিতু হতে পারেননি বলে আধা রাস্তা থেকে ছিটকে গিয়ে চমক জাগানিয়া একটি অখাদ্য পুস্তক রচনা করে তার ঝাল মেটালেন। কিন্তু এরকম রিন্টু ঝাঁকে ঝাঁকে রয়েছে ঐ বংশ পরম্পরার উঠানে যারা মোষ তাড়ানোর নিরঙ্কুষতায় হয়তোবা মোষ উৎপাদন করার মিশনেও আছেন। বাঙালী তো! এই যে এত এত ঝকমারি চমক জাগানিয়া উন্নয়নের ছড়াছড়ি, তারপরেও কেন মুখ ঘুরিয়ে আছে এই জনপদের মানুষ! কেন এত ফিসফাস, উসখুস আর সমালোচনা পথে ঘাটের সাধারন জনপদে। আগেই বলেছি বংশ পরমপরার কথা। এটাতে আপত্তি থাকার কথা নয়। জনপদের প্রয়োজনে, রাষ্ট্র গঠনের উদগ্র চিন্তায় মহা পুরুষদের বংশ পরম্পরার আলোক রশ্মি একান্তভাবেই অপরিহার্য। কিন্তু সেই পথের চোরাগলিতে যখন স্বর্নলতাদের আধিক্য প্রকৃত রক্ত প্রবাহের মূল ধারাকে ছাপিয়ে ক্ষমতার দন্ড হাতে জনপদে ডায়ার বেন্টিং বা মীর জাফর আলি খানের রূপ ধারন করে তখন গনেশ উল্টাতে বেশী সময় লাগে না।
তথাকথিত গনতান্ত্রিক আবহ ও চেতনা তৈরীর প্রথম থেকেই দেখছি সেসব ক্ল্যাসিফাইয়েড পরম্পরার ঝলক। বাঙালী বরাবরই উদার এবং 'ও কিছু না' মনোভাবের ঐশী শক্তির মনোবলে বলীয়ান। তাছাড়া হাজার বছরে তৈরী হওয়া বার আউলিয়ার ইসলামী শিক্ষার মশাল হাতে তারা বরাবরই সহমর্মী, বন্ধু বৎসল ও বিশ্বাসী। কিন্তু সেই হাজার বছরের চলার পথে বাঙালীর সমগ্রতা ও একাত্বতার পায়ে কুড়াল মেরে একটি শ্রেনী যখন তাদের সুপ্রিমেসী প্রমানে ধর্ম পরিচয় নিয়ে জাতীয়তার বিভাজনে এগিয়ে এল তখন বাঙালীর বাঙালীয়ানার সমগ্রতা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। বর্ণ প্রথার হাজারো অসহিষ্ণুতা ও অসামঞ্জস্যতা থাকার ফলে তারা নিজেদের বাঙালী একাত্মতায় অবিচল রাখতে পারে নি। সেটা তো ইতিহাস। সেই ইতিহাসের বলি হয়েই তো আজকে আমরা বিভক্ত বাঙালী। অথচ আজকের দিনে উন্নয়নের উর্বর ভূমিতে সেই তারাই আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাপ্যতায় সোনার বাংলার অলিগলিতে বিচরনের সুযোগ করে নিচ্ছেন। সেটাও হচ্ছে সেই পরম্পরার নতুন সংজ্ঞার ভাব সম্প্রসারনে। ফলে জনপদের সিংহভাগ মানুষ তাদের আজন্ম বেড়ে উঠা সাম্য ও শান্তির উঠানে কোথাও না কোথায় মানসিক ও বাহ্যিক চলনে হোঁচট খাচ্ছে বলেই মনে হয়।
ক্ষমতার পরম্পরা তৈরী করতে গিয়ে আরও যেসব শিকড় বাড়ক আজকের বাস্তবতায় এই বাস্কেটটাকে বারোয়ারী করে ফেলেছে সেটাও বেশ চমকপ্রদ। একজন সিভিল সার্ভেন্ট তার কর্মজীবন শেষের বিদায় বেলায় শাসকের মন তুষ্টিতে দু'এক বছর চুক্তিভিত্তিক পদায়ন পেতেই পারেন। তাছাড়া প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদের অভিজ্ঞতায় তার অপরিহার্যতা অনুভূত হতেও পারে। সেটা কোন ক্রমেই পরমপরার সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না। তবে এই চুক্তি সম্পর্কীয় আধিক্য যখন পার্টিজান শাসকের সিভিল প্রশাসনে গড্ডালিকায় প্রবাহমান থাকে তখনই সেই শেকড় বাকড়ের পরম্পরার প্রশ্নটি ফিসফাসের জন্ম দেয়। আবার সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্র পরিসেবার অলিগলিতে নিয়োগ ও ব্যবসা বানিজ্যেও এই পরম্পরার বিস্তার প্রকট আকার ধারন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাষ্ট্র পরিসেবার এক অত্যাবশ্যকীয় উঠানে এক মহা মহিমের আবির্ভাব ঘটেছে। শোনা যায় তিনি দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কয়েকগুন বেশী বেতনে বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়েই তার কর্মকাল অরিবাহিত করছেন। শাসক শ্রেনীর পরম্পরার দৌড়ে তিনি কোন্ গ্রেডে অবস্থান করছেন তা অন্তর্যামীই জানেন। আবার রাজনীতির ক্ষমতায়নেও এই পরম্পরার দৌড় বেশ বিস্তার লাভ করেছে বলেই দৃশ্যমান হয়। রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে আজকাল পরম্পরার পরিচর্যা ঈর্ষনীয় ভাবে গতি লাভ করেছে। সেক্ষেত্রে এই বাছ বিচারহীন গড্ডলিকায় যে হারে এর স্ফীতি বাড়াচ্ছে তাতে করে পরপম্পরার এই অব্জেক্টগুলোর জন্য এক সময় হয়তো আটষট্টি হাজার গ্রামেই তাদের জন্য গ্রাম পরিষদ সৃষ্টি করতে হবে। আর গ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান পদ অলংকৃত করতে গিয়ে তারাই হয়তো একসময় পরম্পরার ঢিপি (প্রকৃত অর্থে উইপোকার ঢিপি) বানিয়ে গোটা বাংলাকে বিরান ভূমিতে পরিনত করবে।
জানিনা নীতি নৌতিকতার পরিচর্যায় আমাদের চলার গ্রাফ কতটুকু উন্নত হয়েছে। তবে মধ্যযুগীয় আচার আচরনের চর্চিত উপাদানগুলি আমাদের উঠানে ফের উঁকি মারছে বলেই মনে হয়। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের কথা বলতে পারবোনা। তবে সমাজে বাস করি বলেই হয়তো সামাজিক বিবর্তন বা বিলি বন্টনের হালচিত্র যে সুখকর নয় তা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। ইহজগতের এই সামান্য ক'টা দিনে রাষ্ট্র তৈরীর বিভীষিকায় নিজে সিক্ত হলাম। সাধারন জনগনের উঠান থেকে উঠে আসা মানুষগুলোর রাজা হয়ে আত্মপ্রকাশের সেই চিত্রনাট্যও দেখলাম। পরিবর্তনের নাট্যশালায় নতুন রাজার আবির্ভাব হলে সেখানেও সেই পরম্পরা তৈরীর সহজাত প্রবৃত্তিতে বাঙালীকে উড়নচন্ডী হতে দেখলাম। কিন্তু স্তুতিবাক্য আওড়ানো বা গুণকীর্তন করা মানুষগুলো যখন সেরাদের সের দরে বিক্রি করে সোয়া সের হওয়ার উন্মত্ততায় জনপদে গুমোট কান্নার কারন হন, তখন পরম্পরার সেই চক্রব্যুহ নির্মুল করা ছাড়া আর কি কোন গতি আছে?