জালাল উদ্দিন আহমেদ
পুরনো সেই দিনের কথা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
অধ্যাপক এলতাস উদ্দিনের 'দাদির আমলের কথা' নামক বইটি কোন এক সময় পড়েছিলাম। তিনি তার বইটিতে পঞ্চাশ ষাটের দশকে তার বেড়ে উঠা এবং তৎসময়ের গ্রাম বাংলার সংসার সমাজ ও প্রকৃতি নিয়ে বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় বাঙালীর কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাশাপাশি নিজের বর্নাঢ্য কর্মজীবনের স্মৃতি কথাও সেখানে সবিস্তারে উপস্থাপন করেছেন তিনি। আবার আহমদ ছফার অরাজনৈতিক প্রবন্ধের একটি নিবন্ধ কাঞ্চনপুরের বর্ননায় যেভাবে গ্রাম্য জীবন ও জীবিকাকে প্রানবন্ত করে উপস্থাপন করেছেন সেটি এক বিরল রচনা। আসলে এসব রচনা সমূহ পড়লে অজান্তেই নিজের শৈশব ও কৈশরের জীবনচিত্র চোখের পাতায় চিকচিক করে। কোন্ সময় যে কলমের খোঁচায় দু'চার পাতা লিখে ফেলি তা টেরই পাই না। তবে হ্যাঁ, ছোটবেলার সেই হৈ হুল্লোড়ময় জীবনের কথা মনে পড়লে মনটা শুধু প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে ভরা দিনগুলিকেই স্মরন করিয়ে দেয়।
গ্রামের ছেলে বিধায় গ্রাম বংলার শৈশব ও কৈশর জীবনের সেই স্মৃতি মধুর দিনগুলি মনে পড়লে মনটা বড় এলেবেলে হয়ে যায়। যখনকার সময়ের ফ্রেমে নিজেকে উপস্থাপন করতে চাই, মাঝে মাঝে মনে হয় এইতো সেদিন। হয়তোবা আমার অগ্রজরা মুচকি হেসে বলবেন - তুমি তো বাচ্চা হে, আমাদের কাদামাটির শিশুকাল তুমি তো দেখনি। সত্যিই তাই। তারপরেও আর কতকাল শিশুভাব নিয়ে থাকবো! সত্তর পেরিয়েছি। ঘর থেকে বেরুলেই দাদু, আঙ্কেল, চাচা, নানা - সালাম আসতে থাকে দশ বিশ হাত পর পর। হয়তো আধুনিকতা ও টেকনোলজির আশীর্বাদে জোরে ছুটছি, কিন্তু যে ছেলেরা একবিংশের তেইশে এসে কর্পোরেট হাউজের এক্সিকিউটিভ বা কাষ্টমস হাউজের এসিস্ট্যান্ট কমিশনার হয়েছে তাদের দুই প্রজন্মের আগে তো আমার আগমন। তারা সিংহভাগ গ্রামের ছেলে হলেও 'বাবুদের তাল পুকুরে/হাবুদের ডাল কুকুরে/ সেকি বাস করলো তাড়া/ বলি থাম একটু দাঁড়া''র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ নয়। রাতের বেলায় বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে তাদেরই বাড়ির মুরগীর খুল্লা থেকে মুরগী ধরে নিয়ে দূরে অন্য বন্ধুর বাড়িতে সেই শিহরনের পিকনিক করার অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তারা কি সবেবরাতের রাতে বালতি চাঙ্গারি নিয়ে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি রুটি মাংস সগ্রহ করে সেইসব খাদ্য চাঁদনী রাতে মাঠে সারিবদ্ধভাবে বসে খেয়ে তার তৃপ্তি নিয়েছে! এরকম হাজারো স্মৃতি যখন চোখের পাতায় চিক চিক করে তখন শ্রদ্ধেয় এলতাসউদ্দিন সাহেবের 'দাদির আমলের কথা' স্মরন করে আমারও মনে কিছু লেখার অনুপ্রেরনা জোগায়।
মাছ ধরা
ছোট থেকেই ছিপ ফেলে মাছ ধরার একটা নেশা আমার ছিল। গ্রামে পুকুর দিঘি সবই আছে। তবে দিঘির বিশালত্ব ও তার গভীরতার কথা ভেবে ওপাশে ভুল করেও যেতাম না। গোটা পাঁচেক বড় সাইজের পুকুর গ্রামের ভিতরেই ছিল। ছিপ ফেলে মাছ ধরার অবাধ অনুমোদন আমাদের মত ছোটখাট ছেলেদের জন্য ছিল। বাঁশের কঞ্চিকে ছিপ বানিয়ে তাতে নাইলনের সুতা বেঁধে ছোট বঁড়শির ছিপ ফেলে মাছ ধরতাম। পুঁঠি মাছ ও ছোট জাতের রাইকোড় এবং খুব জোর আধাকেজি সাইজের মিড়ক্যা বা মৃগেল মাছ ধরার সেই নেশাই ছিল আলাদা। পুকুরে সাঁতার কেটে গোসল করতাম। এ সময়ে ডুব দিয়ে কাদা হাতড়িয়ে চিংড়ি মাছ ধরার সে অনুভূতি ভুলি কেমন করে। চৈত্র বৈশাখ মাসে পুকুর ডোবায় পানি শুকিয়ে যেত। তখন গ্রামবাসী সবাই মিলে একটি নির্দিষ্ট দিনে মাছ ধরার আয়োজন করতো। কাদাপানির মধ্যে গাবা পুকুরে মাছ ধরার সে অভিজ্ঞতা এখনো মনে শিহরন জাগায়। আশ্বিন কার্তিক মাসে মাঠের জমিতে ধানে পাক ধরা শুরু হয়। জমির পানি নামতে শুরু করে। সেই জমিতে প্রচুর মাছ থাকে। সুতরাং আড়া পেতে মাছ ধরার সে আয়োজন বলার মত ছিল। আশ্বিন কার্তিক মাসে ক্ষেতের জমির নামা পানিতে শোল বোয়াল থেকে শুরু করে কই মাগুর পুঁঠি টেংরা কাচকি সব মাছই আড়াতে জমা পড়তো। ফলে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে সেসময় মাছ খাওয়ার ধুম পড়ে যেত।
উৎসব মুখর সবে বরাত
ছোটবেলায় সবে বরাতের সন্ধ্যাটি আমাদের মত কিশোর বয়সের ছেলে মেয়েদের জন্য বেশ আবেগঘন এক আনন্দ মিশেলে ভরপুর থাকতো। সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির উঠান এবং কার্ণিশ ও জানালার চৌকাঠে এমনকি গাছের গুড়ি বা আনাচে কানাচে চেরাগ জ্বালিয়ে ঘরকে আলোকিত করার ব্যবস্থা করতাম। তখন তো আর মোমবাতির প্রচলন ছিলনা। বিদ্যুতের ব্যাপারটাতো ছিল অলীক স্বপ্ন। সবেবরাতের পাঁচ সাতদিন আগে থেকে মাটির চেরাগ বানাতাম। ছেঁড়া সুতির কাপড় দিয়ে চেরাগের ফিতা বানাতাম এবং রেড়ির তেল সংগ্রহ করে রাখতাম। রেড়ি বা castor oil সংগ্রহ করতে না পারলে সরষের তেল দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতাম। প্রচলিত ধারনা ছিল সবেবরাতের রাতে বাতি জ্বালিয়ে ঘর আলোকিত করলে বাড়ির পুর্ব পুরুষের আত্মারা সহজেই নিজের ঘর চিনতে পারে। এবং সে রাতে তাদের আত্মা নিজ নিজ বাড়িতে এসে তাদের উত্তর পুরুষদের এবাদত বন্দেগী করতে দেখে প্রশান্তি পান। এ তো গেল ঘর আলোকিত করার ঘটনা। সবেবরাত একটি উৎসবের রূপ নিয়ে আমাদের মত ছেলে ছোকরাদের কাছে ধরা দিত। প্রতিটি বাড়িতে হালুয়া রূটি মাংস পোলাও রান্না হোত। গরীব দুখীদের দেয়া হোত, এবাড়ি ওবাড়ি দেয়া নেয়া হোত। আমরা গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেরা সবেবরাতের মাগরিবের নামাজ শেষে একত্রিত হতাম। দলবেঁধে ইসলামী গানের কোরাস গেয়ে প্রতিটি বাড়ির দরজায় যেতাম। হাতে থাকতো একটি ঝুড়ি, তিনটি বালতি এবং একটি বড় পাত্র। ঝুড়িতে রুটি, তিনটি বালতির একটিতে গরুর মাংস অন্যটিতে খাসির মাংস, তৃতীয়টিতে মুরগীর মাংস এবং বড় পাত্রটিতে হালুয়া জাতীয় খাবার সংগ্রহ করতাম। প্রত্যেক বাড়ি থেকে যে যার মত আমাদের সন্তুষ্ট করতেন। এটা উৎসবের একটি অংশ হিসাবে সবাই গন্য করতেন। হালুয়া রুটি সংগ্রহ শেষে আমরা সবাই গ্রামের বাইরে মাঠ বা হাইস্কুলের খেলার মাঠে চলে যেতাম। শাবান মাসের ভরা পুর্নিমার আলোকিত রাতে আমরা দলবেঁধে সেসব খাবার খেতাম। দলে মোটামুটি চল্লিশ পঞ্চাশ জনের মত হোত। গ্রামের মুরুব্বীরা এই বিষয়টিকে একটি ইয়াং জেনারেশনের ইন্টিগ্রিটি হিসাবে উৎসাহ দিতেন। বেশ এনজয় করতাম এসব।
গ্রামের উৎসব
গ্রামে উৎসবের উপলক্ষ অনেক থাকে। যেহেতু মুসলিম প্রধান গ্রামে বড় হয়েছি, সেক্ষেত্রে বাঙালীর সেই বারো মাসে তেরো পার্বনের তোড়জোড় আমাদের ছিল না। তবে সার্বজনীন দুর্গাপুজা এবং স্কুলের স্বরস্বতী পুজার বিষয় দুটো নিয়ে আমাদের উৎসাহের কমতি ছিলনা। সবচেয়ে মজার আয়োজন ছিল দুর্গাপুজার দশমীর দিনে দশেরা উৎসব। আমাদের গ্রামে মাত্র তিনটি ঘর হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল। তাদেরকে মোহান্ত বলে জানতাম। সেই তাদেরকে নিয়ে আমরা কিশোর যুবারা দশমীর বিকেলে দশেরার গরু ছুটাতাম। গ্রামের গৃহস্থ ঘরের গরুকে স্নান করিয়ে তাদের গায়ে বিভিন্ন রংয়ের নক্সা এঁকে গ্রামের মোড়ে জড়ো করা হোত। সন্ধ্যা নামার আগ মূহুর্তে ঢাক ঢোল পিটিয়ে বোম ফুটিয়ে ঐসব গরুদের দোড়ানো হোত। গগন বিদারী চিৎকার এবং ঢাক ও বোমের শব্দে গরুগুলি দিকবিদিক দোড় দিত। দুর্গা পুজা উপলক্ষে দশেরার সেই গরু ছুটানো (দোড়ানো) আমার স্মৃতিপটে লেপ্টে আছে। স্বরসতী পুজোটা ছিল একান্তই স্কুল কেন্দ্রিক। গ্রামেই হাইস্কুল। আশেপাশের গ্রাম ও শহরতলীর ছেলে মেয়ে মিলে ঐ সময় স্কুলের ছাত্র সংখ্যা মোটামুটি তিন'শ এর মত। মুসলমান ছাত্র সংখ্য বেশী হওয়ায় আমরাই দায়িত্ব নিয়ে পুজার সমস্ত আয়োজন করতাম। শহর থেকে স্বরসতী মুর্তি কিনে আনা, মন্ডপ তৈরী করা, পুজোর প্রসাদ তৈরী ইত্যাদি সমস্ত কাজ আমরাই করতাম। স্বরসতী পুজোর ওই কয়েকটা দিন আমরা বেশ আমোদেই থাকতাম।
ঈদ বকরীদের কথা নাইবা বলি। কারন এগুলো নিয়ে ইদানীং পত্র পত্রিকায় 'পুরনো দিনের ঈদ' হেডলাইনে অনেক লেখালেখি হয়। তবে মহররম বা আশুরা নিয়ে কিছু বলার লোভ সামলাতে পারছি না। আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামটি হিন্দু মুসলমান আধাআধি। তার পাশেই অন্য একটি গ্রাম, সেটা পুরোটাই হিন্দু সম্প্রদায়ের। তবে ওই দুই গ্রামের সবাই বৈশ্য শুদ্র গোত্রের হিন্দুদের বসবাস। পাশের গ্রামের নাম বাধা। সেখানে পশুপতি ডোম এবং পুন্যা ডোম এই দুজন ছিল আমাদের মহররম উদযাপনের মূল অনুসঙ্গ। পশুপতি কাকা ঢুলি এবং পুন্যা কাকা বংশীবাদক। এই দুজনের সমন্বয়ে মহররমের ঢোলের বাড়ি আর বাঁশির সুর গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বণিতাকে চনমনে করে দিত। লাঠি খেলা ও মুর্শিয়া গান হোত। আমরা ছোটরাও তাতে অংশ নিতাম। মহররমের ঐ দশটা দিন গ্রামে গ্রামে উৎসব ও শোক পাশাপাশি অবস্থান করতো। মা-বোনরা আশুরায় রোজা রাখতেন। ভিন্ন গ্রাম থেকে আশুরার শোভাযাত্রা এলে বাড়ি বাড়ি তৈরী করে রাখা শরবত ও খিঁচুড়ি খাইয়ে তাদেরকে আপ্যায়ন বা সম্মানিত করা হোত।
গ্রামে যাত্রাপালা হোত। আমার বন্ধু এবং সহপাঠী মফিজের মেয়েলী চেহারা এবং তার গানের গলাও চমৎকার ছিল। সে রূপবান যাত্রার রূপবান এবং সাগরভাষা পালার নায়িকা সাজতো। সে সময় ছেলেরাই মেয়েদের পাঠ করতো। আমার মেজভাই প্রয়াত আব্দুর রশিদ রূপবান পালার উজিরের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। অর্থাৎ গ্রামের ছেলে ছোকরারা এই যাত্রাপালা আয়োজনের পুরোটাই করতো। মনে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামে একটা লটারীর আয়োজন হোত। লটারীর পুরস্কারের ধরনটা বেশ চমকপ্রদ। শাড়ি লুঙ্গি নারিকেল তরমুজ হাড়ি পাতিল চাদর ইত্যাদি। গ্রামের প্রতিটি ফ্যামিলি প্রধানের নাম ধরে ছন্দাকারে ছড়া উচ্চারন করে হাস্যরসের মাধ্যমে পুরস্কার তুলে দেয়া হোত। এই কাজটি হোত গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে। দু'একটা ছড়া আবছাভাবে মনেও পড়ছে। যেমন কদম রসুল নতুন বিয়ে করেছে। তার নামে ডাকা হোল,'নতুন বউ এল ঘরে নারকেল দাও জলদি করে'। ব্যাশ, একজোড়া নারকেল তিনি পেয়ে গেলেন। পাশের বাড়ির ইদ্রিস মিয়ার নামে ডাকা হোল, 'আম পাতা জোড়া জোড়া ইদ্রিস ভাইয়ের লুঙ্গি ছেঁড়া'। সঙ্গে সঙ্গে ইদ্রিস মিয়ার জন্য নতুন একটি লুঙ্গি চলে এল। এভাবেই রাত্রিবেলায় গ্রামের তিন মাথার মোড়ে হারিস চাচার বাংলা ঘরের উঠানে একটি আনন্দঘন মূহুর্তে এই নতুন বছরকে বরন করার অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হোত। গ্রাম্য পরিবেশে মানুষের যুথবদ্ধতা ও একত্র হয়ে মিলেমিশে থাকার সেই বর্ষ শেষের আয়োজনটা সত্যিই একটি মাইল ফলক বলে বিবেচিত হোত। তাছাড়া পহেলা বৈশাখ ও রাম নবমীর হালখাতা উৎসবে মিষ্টি মিঠাইয়ের ধুম পড়ে যেত। সবিস্তারে লিখতে গেলে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থই তৈরী হয়ে যাবে।
ছেলের খাৎনা দেয়া বা মেয়ের কান ফুড়ানোর সেইসব অনুষ্ঠান রীতিমত উৎসবের রূপ ধারন করতো। বিয়ে সাদীর অনুষ্ঠানে খানাপিনা উপলক্ষে ময়রা এনে মিষ্টি জিলাপী বুঁদিয়া ও বিভিন্ন পদের মিষ্টি তৈরীর বাহারী আয়োজন, সারারাত হ্যাসাক জ্বালিয়ে মাছ মাংস সবজি বানানোর সেই মহা এন্তেজাম চোখের কোনে এখনো চিকচিক করে। তাছাড়া বরযাত্রী যাওয়ার মহা আয়োজনে দশ বারটা গরুর গাড়ির বহর সাজিয়ে এবং সামনের গাড়িতে মাইক লাগিয়ে উচ্চ ভলিয়্যুমে হিজ মাস্টারস ভয়েসের রেকর্ড বাজাতে বাজাতে নির্দিষ্ট গ্রামে কনের বাড়িতে যাওয়ার দৃশ্য - সে এক শিহরন জাগানো ব্যাপার। গৃহস্তের পুষ্টতার হেরফেরে ব্যান্ড পার্টির আয়োজনও করা হোত।
গ্রাম বাংলার বাঙালীয়ানার সেইসব দিনগুলি সত্যিকার অর্থে বাঙালীকে তার আপন ঐশ্বর্যে আলোকিত করে রাখতো। জাতপাত ধর্মভেদের কোন কূপমন্ডুকতা বাঙালীকে স্পর্শ করেনি*। গ্রাম বাংলার আদিত্ব নিংড়ানো সেইসব প্রাকৃতিক উচ্ছ্বল জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে ভাবনায় পড়ে যাই। যখন দেখি আমার দ্বিতীয় তৃতীয় প্রজন্মের উত্তর পুরুষেরা ইট পাথরের দালান কোঠায় যন্ত্র প্রযুক্তির পরিপার্শিকতায় এক একটা যন্ত্র দানবে পরিণত হচ্ছে। তবে এই ভেবে সান্ত্বনা পাই, সময় ও স্রোতের অনুকূলে ভেসে চলাই মানব জাতির আচরি ধর্ম। ইশা খাঁর সময়ে টাকায় আটমন ধান পাওয়া যেমন কষ্টি পাথরে ঘষা সত্য, তেমনি একবিংশের এলন মাস্ক বা জুকারবার্গদের এই সময়ে একমন ধান কিনতে হাজার বার'শ টাকার প্রয়োজন হয় - এটাও সত্য। তখনও ধনী গরীব ছিল, এখনও ধনী গরীব আছে। তখনও গ্রামের মেধবী ছেলেটি গ্রামের গৃহস্তের ঘরে লজিং থেকে লেখাপড়া শিখে শহুরে বাবু হোত। এখনও লজিং সিস্টেমটা চালু হয়তো আছে তবে পরিমার্জিত আধুনিকতার কাটছাঁটে তা যন্ত্রাকারে রূপ নিয়েছে। স্বর্নালী বা সোনালী দিনের স্মৃতি রোমন্থন যতই স্পর্শকাতর হোক না কেন, হাতের স্মার্ট ফোনের স্ক্রীনে অভ্র বা বিজয় ফন্টে নিজের ছোটবেলার গ্রাম্য কাদামাটির কথাটিই ব্যক্ত করছি-এটাই বাস্তবতা। কারন নিব লাগানো কাঠের কলম দিয়ে দোয়াতে রাখা কালিতে বার বার ডুবিয়ে চার আনা দিস্তায় কেনা কাগজের খাতাতে লেখার সেই সময়টাও আমরা পার করে ফেলেছি। অর্থাৎ জীবন পাঠের ঘুর্ণিচক্রে রাইন রিভারের সেই সগোক্তি, 'for men may come and men may go/ but I go on for ever'ই শাশ্বত এবং চির ভাস্মর।
*ধর্ম ভেদের কূপমন্ডুকতা ছিলনা কথাটির আপেক্ষিকতা ছিল বৈকি! হিন্দু ব্রাহ্মন্য আচরনের একটি গোষ্ঠী সব সময় জাতপাত ছ্যুৎ অছ্যুৎ এসব নিয়ে খবরদারি দৃশ্যের অবতারনা করতেন। তবে গোটা সমাজের শতকরা পাঁচ ভাগের বেশী তারা ছিল বলে মনে হয়না। ফলে ভারের আধিক্যে হিন্দু-মুসলমানের চাপান উতোর খুব একটা গ্রাহ্যের মধ্যে পড়তো না। এখনো সেই ব্রাহ্মন আছেন কিন্তু ব্রাহ্মন্য দেমাগ আর নেই। কারন নিম্নবর্নের হিন্দু জনগোষ্ঠী এখনকার দিনে জ্ঞানে বিজ্ঞানে সামনের কাতারে চলে আসায় ব্রাহ্মনদের এখন প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হয়। এটাও যুগ পরিবর্তনের ফসল।