জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাংলা ভাষা সাহিত্যের এপার-ওপার
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৪ জুন,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনার ঝোঁক গড়ে উঠেছিল। অবশ্য পারিপার্শ্বিকতাই আমার এই ঝোঁককে এগিয়ে নিয়েছিল। বড় ভাইয়া বাংলা সাহিত্যের মানুষ। চোখ মেলে বিদ্যাবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই তাঁকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসাবে দেখেছি। পরবর্তীতে অধ্যাপক এবং অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শেষ করেছেন। তো, সেই ভাইয়ের সর্বকনিষ্ঠ ভাই হিসাবে তাঁর ছায়ায় বেড়ে উঠা আমার। বাড়িতে বই পুস্তক ম্যাগাজিনে ঠাসা পরিপাশ। সুতরাং আট নয় ক্লাসের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বড় বড় মনীষীর নিবন্ধ প্রবন্ধ এবং নাটক নভেল পড়ার হাতে খড়ি হয়েছিল বলা যায়।
আমার শৈশব এবং কৈশর কেটেছে বৃহত্তর বাংলার পশ্চিমাংশে। সুতরাং বাংলার শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি পাঠের কোন্ জলাশয়ে সাঁতার কেটে আমাকে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তা নিশ্চয় অনুধাবন করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল সিলেবাসের বাধ্য বাধকতায় পুর্ব বঙ্গের সৈয়দ মুজতবা আলীর ছোট গল্প বা জসিমউদ্দিনের কবিতা আমাকে পড়তে হয়েছে। এটা যেমন হতাশার কথা নয়, তেমনি আশাব্যঞ্জক যে নয় তাও বলা যায়। সেক্ষেত্রে বলা চলে শিক্ষা সাহিত্য ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটা পৃষ্ঠা পাঠ করে আমি আমার বেড়ে উঠার বুনিয়াদকে বিনির্মান করেছি। পাতার অপর পৃষ্টা পাঠ করার জন্য প্রকৃতিই হয়তো আমাকে বাংলার পুর্বাংশে ঠেলে দিয়েছে। প্রান্ত বদল করেছি হয়তো কিন্তু ভূমন্ডলের প্রাচ্য প্রতীচ্যের প্রবাসী হয়ে থাকতে হয়নি আমাকে। স্বাধীনতার স্বাদ নিয়ে বাংলার বাঙালী হওয়ার গর্বে গর্বিত হতে পেরেছি।
টুকটাক লেখার অভ্যেস আমার আছে। তবে ভাষা সাহিত্য নাটক নভেল - এসব নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। তারপরেও মনটা কেন যেন উসখুস করতে থাকে। কারন আমার বেড়ে উঠার সময়টাতে বাংলা নিয়ে যা পড়েছি জেনেছি সেখানে পুর্ব বাংলা ও বাঙালীকে নিয়ে একটি লাইন পড়েছি বলে মনে হয় না। শুধু এটুকু মনে আছে, ক্লাস এইটে ইতিহাস পাঠে বাংলার বার ভুঁইয়াদের সমন্ধে জানতে গিয়ে তাদের বীরত্ব মহত্ব ও দৌরাত্মের কথা পড়ানো হয়েছে। যেটুকু জেনেছি তা হোল বার ভুঁইয়ার ইশা খাঁ, চাঁদ গাজী, সোলেমান গাজী ও শের খাঁরা ছিল ক্ষমতাধর হিংস্র পরায়ন ও প্রজা নিপীড়ক জমিদার। পাশাপাশি বার ভুঁইয়ার হিন্দু জমিদার কেদার রায়, মাধব রায়, এরা ছিলেন প্রজা বৎসল এবং প্রতিপত্তির অধিকারী মহানুভব জমিদার। অকপটে বলতে ও লিখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি তাই হয়তো সোজা সাপ্টা ভাবেই লিখলাম। অবশ্য মেকি নিরপেক্ষতার আঁতেলরা ও ফোর্ট উইলিয়ামের তৃতীয় চতুর্থ পুরুষেরা আমার এই বয়ানকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইবেন। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে পুর্ব বাংলার কোন কথা স্কুল পর্যায়ে আমি পড়িনি।
শুধু কি ইতিহাস! শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির গলিপথে হেঁটে যখন বাংলার আদিত্ব খুঁজতে চেষ্টা করি তখন ওইসব ফোর্ট উইলিয়ামের ডিভাইড এন্ড রলস এর ফন্দি আঁটানো একপেশে কোলকাতা পাটনা কেন্দ্রিক বৃহত্তর বাংলার বাদ্যগীতি আমার কাছে পানসে মনে হয়। আর ঊনবিংশ হতে বিংশের প্রথমকাল পর্যন্ত যারা বাংলার শিল্প সাহিত্যের নৌকা বাইচ করেছেন তাদের তো একটাই মটো( Moto) ছিল তা হোল 'নেড়ের বাচ্চাদের মাথা তুলতে দেয়া যাবে না'। আর এ পথের মূল সারথি ছিলেন devide and rules এর master piece নর্দামটনশায়ারের বৃটিশ পাদ্রী মিস্টার উইলিয়াম কেরী। বৃটিশ শাসকদের নিয়োগ প্রাপ্ত এই ইংরেজ পাদ্রী বাংলা ভাষার উন্নয়নের নামে যে তরজা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেসেল থেকে শুরু করেছিলেন তার ফসল তো সেই সাম্প্রদায়িক জরায়ুর সদ্যজাত কয়েকজন হিন্দু ব্রাহ্মন্য পন্ডিত এবং তাদের কলম ও মুখ থেকে নিসৃত সংস্কৃত মাখানো বাংলা ভাষার নতুন সংস্করন। সেখানে বিদ্যাসাগর মশাইও ছিলেন। চৌদ্দ'শ শতকে রাজা গনেশ পুত্র জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহের হাত ধরে যে বাংলা গদ্যরীতির প্রচলনের সুত্রপাত হয় তার ফলশ্রুতিতে সে সময়ে বাংলায় প্রথম কৃত্তিবাস কর্তৃক রামায়ন রচিত হয়। সেই বাংলা ছিল সাধারন বাঙালীর কথ্য ভাষার রূপ। তাছাড়া মুসলিম প্রভাবের আরবি ফার্সীর ব্যবহারও সেখানে লক্ষ্য করা যায়। ঊনবিংশ শতকে ফোর্ট উইলিয়ামী হিন্দু পন্ডিতেরা বাংলার সেই আদি রূপ বাংলা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে সেখানে একচেটিয়া ভাবে ব্রাহ্মন্য বেদের ভাষা সংস্কৃতের সংযোজন ঘটালেন। এবং ইংরেজদের নি:শর্ত সমর্থনে ও আর্থিক প্রযোজনায় বই পুস্তক ম্যাগাজিন পত্রিকা মুদ্রনের ব্যাপ্তি ঘটিয়ে বাঙালীর সমগ্রতায় তা গ্রহনযোগ্য করে ছাড়লেন।
সেক্ষেত্রে মুসলমান বুদ্ধিজীবি ও প্রভাশালীরা সামনে এসে এসবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে বা করতে পারেন নি তার একমাত্র কারন হচ্ছে বৃটিশ ভারতে সে সময় মুসলমানেরা ছিল ইংরেজদের শত্রুপক্ষ। কেননা ভারতের মুসলিমদের সিপাহী বিদ্রোহ ইংরেজদেরকে বেশ বিব্রত করেছিল। পরবর্তীতে ফকির ও সাধুদের সমন্বয়ে যে ফকির বিদ্রোহ হয়েছিল সেটাও ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ফ্রন্ট লাইনে থাকারই ফসল। যতই নিজেদের যোদ্ধা পরিচয়ের সুবিধা নেয়ার লক্ষে বঙ্কিম বাবু তার অনন্দ মঠে সন্যাসী বিদ্রোহের মাহাত্ম্য ফুলিয়ে ফাঁফিয়ে বলুন না কেন আসলে ওটা ছিল হিন্দু মুসলমানের যৌথ সংগ্রামের ফকির বিদ্রোহ। মোটকথা ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু হতে এযাবতকাল হিন্দু বাঙালীরা মুসলমান বাঙালীদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এভাবেই বহুমাত্রিক বিষয়ে দোষারোপের বোঝাটি চাপিয়েই রেখেছেন। রেনেসাঁ তৈরীর মচ্ছবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যেভাবে সংস্কৃতায়ন করা হোল তাতে করে হিন্দু ব্রাহ্মন্য গোষ্ঠীর একটা মনোবাঞ্ছা পুরন হয়েছিল বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন। বেদের ভাষা সংস্কৃতের সংশ্রবে বাংলা যেন একটা সম্প্রদায়ের ভাষা বলে তাদের প্রচারে ঠাঁই পেল। ফলে হিন্দু ব্রাহ্মন তথা নেতৃস্থানীয়রা সমগ্র হিন্দু বাঙালীদেরকে বুঝাতে চাইলো যে বাঙালী মানেই হিন্দু সম্প্রদায়। বাঙালীজাত হলেও মুসলমানেরা ভিন দেশী ও ভিন জাতি। এই মন্ত্রগাঁথার সূচনা সেই ফোর্ট উইলিয়ামের প্রেস থেকে মুদ্রন হলেও এর মূল মাস্টার মাইন্ড হিসাবে নিবেদিত প্রান হয়ে কাজ করেছেন ঋষি বঙ্কিম চ্যাটার্জী। যদিও বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাসিক হিসাবে তিনি সম্মানিত কিন্তু হিন্দু বাঙালীকে সাম্প্রদায়িক উড়নচন্ডি করার মূল রূপকার ছিলেন তিনি। এজন্যই তো তিনি হিন্দু বাঙালীর কাছে ঋষি বঙ্কিম নামে আখ্যায়িত।
বৃহত্তর বাংলায় বাঙালী হিসাবে হিন্দু সম্প্রদায় লেখাপড়া ও বিদ্যা শিক্ষায় অগ্রনী ছিলেন। এটা সেই ইংরেজী কাহাবতের survival of the fittest এর সাযুজ্যেই হয়েছিল। এবং সে স্পেসটা বৃটিশরাই হিন্দু বাঙালীদের জন্য করে দিয়েছিল তাদের ক্ষমতার দন্ডটি মজবুত করে রাখার খায়েসে। ওদিকে বৃটিশ ভারতের মুসলমানরা বিশেষ করে বাঙালীরা কায়দা, আমপারা, পুঁথি, মিলাদ, নটের গান এসব নিয়েই তৃপ্ত থেকেছে। ফলে কর্ম ও কার্যক্ষেত্রের যোগ্যতা অর্জনে মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে ফোর্ট উইলিয়ামের ছত্র ছায়ায় হিন্দু ব্রাহ্মন্য গোষ্ঠীর একঝাঁক সংস্কৃত পন্ডিত বাংলা ভাষা সাহিত্যেকে তৎসম-তদ্ভব এবং ণত্ব-ষত্ব বিধানের গোলকধাঁধায় সংস্কৃত ভাষার ঔরসজাত সন্তান বানিয়ে ফেললেন। সংস্কৃতির বহমানতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এখন সেই পাটাতনেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা আসমুদ্র হিমাচলের বাঙালী সন্তানেরা ঊনবিংশের ফোর্ট উইলিয়াম এন্ড গং প্রসবিত সেই বাংলাতেই সাঁতার কেটেছি। হয়তো ধর্মভেদের চন্ডালিকায় ভর করে এখনো জলকে পানি, আকাশকে আসমান, স্বপ্নকে খোয়াব, অতিথিকে মেহমান বা মাংসকে গোস্ত বলে তৃপ্তি পাই। তবে হাঁ, ইদানীং কলকাতা কেন্দ্রিক কলেজ স্ট্রীটের বাঙালী বাবুরা যেভাবে বাংলা ব্যবহারে কাটছাঁটের আশ্রয় নিচ্ছেন তাতে বাংলা ভাষার আবেদন যে কবে পাটনা হয়ে লক্ষৌ ঘুরে দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে ঠাঁই নেবে সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত দিদিকে দি, ঠাকুর মাকে ঠাম্মা ক্যাপ্টেনকে কাপ্তান, একাডেমিকে আকাদেমি ইত্যাদি আরো বহু শব্দ চয়নের কাটছাঁট ও বিকৃত রূপ এবং ক্রিয়াপদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন মোড়ে বাঁক খাওয়াচ্ছেন তা ব্রাহ্মন্য আভিজাত্য কিনা জানিনা তবে এসব শব্দ চয়ন অতি স্মার্টনেসের ফসল হিসাবে বাংলা গদ্য সাহিত্য ও নাটক নভেলে ব্যবহারের ফলে সাধারন মানুষ বাংলা ভাষা সাহিত্যের লিখিত আঙ্গিনা থেকে ছিটকে যাচ্ছে বলেই মনে হয়। এসব শব্দ কবে কোথায় ছিল এবং আম বাঙালী কোথায় ব্যবহার করে তাও জানিনা। কত পার্সেন্ট মানুষ ব্যবহার করে সেটাই মাথায় আসে না। অর্থাৎ ওরা শব্দ ও তার ব্যবহারের অহংবোধে কাব্য সাহিত্য তৈরী করে বাংলার ঘাড়ের উপর চাপিয়ে দেন। ফলে তাদের সেই সৃষ্টি দশম পাশ করা গৃহবধু বা একজন সচেতন নাগরিকের পাঠের অনীহায় পরিনত হয়। খুব সচেতন ভাবেই তাদের একপেশে সাহিত্য চর্চার মাজন একই কায়দায় চলছে। অথচ পুর্ব বাংলার প্রেক্ষিত আলাদা। এখানকার কবি সাহিত্যিকেরা মাটি ও মানুষের মুখের কথা ব্যবহার করে সৃষ্টি সুখের আনন্দে সোনার বাংলার পাটাতন শক্ত করে। এখানে কোন মেকি অভিনয়ের বাহুলতা নেই। প্রকৃতিতে যা আছে তাই মানুষের মুখের ভাষায় উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ লোকজ সংশ্লিষ্টতায় সম্পৃক্ত থেকে বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকগন বাংলার মাটি নিংড়ানো নির্যাসটা বের করে আনছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইদানীং শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে যুব সম্প্রদায়ের যে সংশ্লিষ্টতা ও জাগরন এসেছে তা অচিরেই বাংলার সমগ্রতায় ঢাকাই হবে বাংলার শিল্প ও সংস্কৃতির মূল পাদপীঠ। সে চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যের কর্মীরা নিবেন এটা আশা করা যায়। বামপন্থী ঘরানার প্রাধান্য দিয়ে এক জাতি এক ভাষা এক সংস্কৃতির যে হেঁসেল তৈরী করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে একটি খয়রাতি মোড়লীর আবহে আচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চলমান রয়েছে, তার সিংহ দুয়ার অচিরেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে - এটা বলার জন্য গনক ডাকতে হয় না।
পরিশেষে একটি কথা না বলেও পারছি না। কলকাতার কলেজ স্ট্রীট কেন্দ্রিক বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা এবং তাদের পৃষ্টপোষক একটি প্রকাশনা সংস্থার একমুখী এবং ক্ষেত্র বিশেষে একচোখা প্রচার ও প্রসারের ফলে ভারতীয় হিন্দি আগ্রাসনের পশ্চিম বাংলা এখন ''এ রুটি তো পোড়া হ্যায় কেমন করে খাব হ্যায়'' এর পর্যায়ে খাবি খাচ্ছে। কারন বাংলা চর্চার কলেজ স্ট্রীটের প্রকাশিত বাংলা বই পুস্তকের মূল ক্রেতা কিন্তু এখন ঢাকা। বলা চলে পুর্ব বাংলার (তাদের ভাষ্যে) পাঠকই এখন তাদের পুস্তক ব্যবসার মুল জীয়ন কাঠি।