জালাল উদ্দিন আহমেদ
নিম পাতার ফুল
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ জুন,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:১৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
হঠাৎ করে টিভি রিমোটের নবটা ঘুরে গেল এক সিরিয়াল চ্যানেলের দিকে। একটা আবেগ ঘন দৃশ্যের মঞ্চায়ন হচ্ছিল। ভাল করে খেয়াল করলাম সিরিয়ালটির নাম 'নিম পাতার ফুল'। ডিজিট্যাল ক্যাবলের যুগে এসব ভারতীয় সিরিয়ালবাজি বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়ও বটে। ঘটনাটি বলি তাহলে। বেশ আবেগঘন একটি ঘটনার উপস্থাপনা। চোখকে ফিরাতে পারলাম না। কোন এক দত্ত বাড়ির দৈনন্দিন খুঁটিনাটি নিয়ে সাজানো আজকের বিষয় ছিল একটি চুরি যাওয়া গনেশ মূর্তি। অবশ্য গনেশ মূর্তি নিয়ে বাঙালী হিন্দু সমাজে এত মাখামাখি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বাঙালী ঘরে মা লক্ষী স্বরস্বতী কালি এবং মা দুর্গার বিগ্রহের কদর বেশী। সম্ভবত: মাড়োয়ারী এবং হাল আমলের মোদি নামার জোশে হিন্দু জাগরনের দাক্ষিণাত্য আমলনামার প্রচলন আজকাল বাংলার ঘরেও ঢুকে পড়েছে। যাক, যেটা নিয়ে বলতে চেয়েছি তার সারমর্ম হল উক্ত দত্ত বাড়ির নাতবৌয়ের সংসারের সাত-পাঁচের হিসাব নিকাশের সামাল দেয়া এবং দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার দক্ষতা ও পারঙ্গমতা একটু বেশীই। সংসারের যেকোন জটিল সমাধান তিনি বেশ সুচারভাবেই সমাধান করার ক্ষমতা ও দক্ষতা রাখেন। তো সেই দত্ত বাড়ির হারিয়ে যাওয়া গনেশ মুর্তি তিনি অর্থাৎ নাতবৌ বেশ সুচতুরতার সহিত উদ্ধারের ব্যবস্থা করবেন এবং তিনি মহান গৃহবধু হয়ে ওই সংসারে তার কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরাবেন এটাই দেখানো হচ্ছে ওই সিরিয়ালে।
নিম পাতার তেতো স্বাদের সাথে আমার এই নিবন্ধের যোগাযোগ কতটুকু তা বলা মুস্কিল। তবে সমাজ জীবনে এখনকার সময়ে নিমপাতা কতটা তেতো হলে এইসব কথাবার্তা শুনতে হয় তা সত্যিই অবাক করার বিষয়। নিমপাতার সাথে সখ্যতা সেই ছোবেলা থেকেই। গ্রামের ছেলে। মনে পড়ে ছোটবেলায় খোস-পাচড়া এসবে প্রায়ই আক্রান্ত হতাম। ফলে নিম পাতা ও চিরতা ভিজানো জল খেতে খেতেই বড় হয়ে এখন বুড়া হাড়ের নানা-দাদা হয়ে কাল কাটাচ্ছি। কিন্তু এই কালের উত্তাপ যে এত তীব্র এবং কষালো তিতা তা জিহ্বায় অনুভব করতে না হলেও ইদানীংকার মিডিয়া সন্ত্রাসে এর তেতো স্বাদ আমাদের নিতে হয় কর্ণ ও চক্ষু যুগলের মাধ্যমে।
জাতি হিসাবে আমরা গর্বিত এবং একটা অহংকারের জায়গায় থেকেই আমাদের এই গর্ব ও অহংকারের ভিত্তিটা গড়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু অশুভ চক্র এবং রাজনীতির ঢালাও হীনমন্যতা সেই অযাচিত নিম পাতার রস আমাদের উঠানে ঢেলে দিয়ে বাঙালী জাতিকে মাঝেমধ্যেই বিব্রত করছে। এবং এজন্যই বলছিলাম আমরা দুর্ভাগা জাতি। কেন এসব হচ্ছে তার পুংখানুপুংখ উচ্চারন করতে না পারলেও দু'একটা কথা এ নিয়ে বলাই যায়। হীনমন্যতা এবং শিক্ষার প্রকৃত অনুশীলনে না থাকা ছাড়াও রাজনৈতিক নীতিহীনতা ও আদর্শচ্যুতির ফলে অস্তিত্বের উপর কলংক লেপনকারী এসব অনৈতিক কথাবার্তা আমাদের শুনতে হয়। সমাজবদ্ধতার সুদৃঢ় কাঠামো তখনই একটি সমাজে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয় যখন সে সমাজ বা রাষ্ট্রে রাজনীতির আদর্শিক আচরনে শাসন ব্যবস্থা সরল রেখায় বিচরন করে। স্পষ্টতই সেক্ষেত্রে আমরা যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছি। রাজনীতির দুর্বৃত্যায়ন ও নৈতিক স্খলনের ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ উইপোকার ঢিপি তৈরী হয়েছে। আর এসব অনিষ্টকারী পোকার খাদ্য যোগানে আজ বাংলা নামের এই সবুজ শ্যামল পুন্য ভূমিটি ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ভুতটা সর্ষের মধ্যেই রয়েছে বিধায় বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতই গিট্টুটা আসলেই ফস্কা বা ঢিলেঢালা হয়ে পড়েছে৷ ব্যক্তি সুরক্ষার ডিজিট্যাল করতে গিয়ে আমরা এখন না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছি। গ্রহন ও বর্জনের দুটো গেরোই আজ প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ফস্কা হয়ে পড়েছে।
সুতরাং আঠার কোটির এই গায়ে গায়ে ঠাসা জনপদে কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা অপ্রয়োজনীয় তা যারা বুঝতে সক্ষম নন তাদের কেন এত শখ হয় দেশ শাসনের ছড়িটি হাত নেয়ার! কোন্ আঙ্গিকে রাজনীতি ও শাসন কর্তৃত্বের এই পক্ষ দুটি নির্ঝঞ্জাট আছে বলা যাবে কি। পরম্পরার উঠানটি এমনই অসহায় হয়ে পড়েছে যে মূল স্রোতের বৈঠাটি নিজ হাতে রেখেও বাকীগুলোকে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। ফলে যুবস্রোত ও ছাত্রস্রোতের ছাতার দন্ডটি পরম্পরার হাতে ধরিয়ে রাখতে হচ্ছে। এটা কি সন্দেহ অবিশ্বাস, না আতংকের আলামত। এ তো গেল রাজনীতির দৃশ্যমান চর্চা গীতি। শোনা যায় প্রশাসন ও আইন শৃংখলার উঠানেও সেই একই কলের গান বাজানো শুরু হয়েছে। এবং সম্ভবত এভাবেই চলতে গিয়ে ওই 'বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো'র বিষয়টি সামনে এসেছে। কেননা চলতি বছরের বাজেট আলোচনায় দেখা যায় দেশের প্রশাসনিক খাতের ব্যয় বরাদ্দ সর্বোচ্চ, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে রাজনীতির স্রোতগুলির সামাল দিয়ে এবং আইন শৃংখলা ও প্রশাসনকে দুধেভাতে রেখে ক্ষমতা নামের রাজদন্ডটি যতটুকু প্রলম্বিত করা যায়। এটা যেন ওই নিরপেক্ষ ভোট নামের মৌলিক অধিকারের উড়নচন্ডি চাহিদার মতই ক্ষমতাধরদের ক্ষমতা ধরে রাখার তাল গাছের গল্প।
এভাবে আর কত? মেঘে মেঘে তো বেলা অনেক গড়িয়েছে। অপরিনামদর্শীর মত তুঘলকি ঘটনা ঘটিয়েই যাবেন আর আইনের পর আইন করে দেশের সাধারন জনগনের উপর ছড়ি ঘুরাবেন, তাতো হতে পারেনা। রাজনীতির দুই পক্ষকেই বলছি - বাহ্যিক উন্নয়নের এই বাড়ি গাড়ি, বড় বড় অবকাঠামো, রাস্তা ফ্লাই ওভার, টানেল, মেট্রো স্কুল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় লিফট ওয়ালা ইমারত দিয়ে কি হবে? যদি না মানুষের মনুষত্বের বিকাশ না ঘটে। রাজনীতির নৈতিক মূল্যবোধে মানুষকে আস্থায় না রাখা যায়। মানুষের আত্মিক উন্নয়নে কতটুকু এগিয়েছি আমরা? বড় কষ্ট লাগে যখন দেখি দেশের স্থপতির ছবি প্ল্যাকার্ড ছিড়ে ফেলে জনতা পা মাড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে(একবিংশের শুরুতে এসব দেখা গেছে)। এই জনতা আমাদেরই লোক। এরা তো পাকিস্থানের লাহোর করাচি থেকে আসে নি। সুতরাং এদের আত্মিক উন্নয়নের কর্মসূচি কই? যখন দেখি পিতার জন্ম ঠিকুজি নিয়ে অরুচিকর বক্তব্য উপস্থাপনায় সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক অনুষ্ঠান করে। সম্ভবত: সরকারী তৈল মর্দনের একটি আঁতেল গোষ্টি যখন বাঙালীর প্রানের নেতাকে অলি আউলিয়ার বংশধরের কাতারে দাঁড় করিয়ে মহান কাজটি করেছেন বলে আত্মতৃপ্তিতে গদগদ হন তখনই তার বিপরীতে মহান নেতার জন্ম রহস্যের অরুচিকর বক্তব্যগুলি তৈরী করা হয়। সম্প্রতি একজন ধর্মগুরু যেভাবে ধর্মসভার জনস্রোতে দাঁড়িয়ে পিতার জন্ম ঠিকুজির চোদ্দ পিতার নাম উচ্চারন করে নিজেকে গর্বিত করলেন, তার এই অসময়ের ফতোয়া ধর্মভীরু মুসলমান বাঙালীর কর্ণকুহরে কতটুকু প্রবেশ করেছে বা কিভাবে প্রবেশ করবে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তাছাড়া একজন কাদামাটির খোকা যখন শেখ মুজিবের অস্তিত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে শেকড়ের স্থপতি হন তখন তাঁকে এভাবে পীর আউলিয়ার অধস্তন পুরুষ বানিয়ে উচ্চকিত করা মানে সাধারনের কাছ থেকে তাঁকে ছিনিয়ে নেয়ার পর্যায়ে পড়ে। মহাত্মা মহাত্মাই। জেলের ঘরে জন্ম নেয়া কাইদে আজমও তাই। কৃষক মাও সে তুং, যোদ্ধা জর্জ ওয়াশিংটন বা পোড় খাওয়া নেলসন ম্যান্ডেলা সর্বক্ষেত্রে তারা নিজ পরিচয়েই এই পর্যায়ে। সেক্ষেত্রে তেলের ভান্ড নিয়ে বিচরন করা রাজনীতির চাঁই থেকে শুরু করে কলেজ স্ট্রীটের সখ্যতায় লালিত তথাকথিত বুদ্ধিজীবিরা একের পর এক পিতা ও পরম্পরাদের উইকেটগুলো এভাবে উপড়ানোর যে মিশন নিয়ে এগোচ্ছেন তা সুখকর নয়। অথচ তাদের তৈল মর্দনের ক্যারিশম্যাটিক চপলতায় এই তথাকথিত পন্ডিত ও রাজনীতির চাঁইরা পিতা ও সুতির প্রকৃত গবেষক ও দেশপ্রেমিক সেজে দেশের শিক্ষা শিল্প সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করছেন - সেতো দিব্যচক্ষেই দেখা যায়। এটা হাল আমলের কিছু বিপদগামী গবেষকের রাণী এলিজাবেথকে মহানবীর(স:) বংশধর আখ্যায়িত করার পরম্পরা নয় কি? বর্তমান সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উপরতলার বুদ্ধিজীবি প্রশাসকরা যেভাবে অনিয়মের পাহাড় তৈরী করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তাদের আচরনে গত শতাব্দীর আইএ বিএ পাশ প্রশাসকের মত আচরন করছেন তাতে করে মিথ্যা থিমের উপর তৈরী করা এই কাঁচের ঘর যেকোন সময় দুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে - এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
নিম পাতা তেতো হতে পারে কিন্তু বৃন্তে ফোটা ফুলটা ফুলই হয়। নির্যাতিত নিষ্পেষিত এবং অবহেলিত বাঙালী উঠান যখন শাসকের অমানবিক আচরনে নিমপাতার রূপ ধারন ক'রে জর্জরিত হলো তখনই সেই গাছে ফুটেছিল এক সম্মোহনী ফুল। সেই ফুলই ছিল আমাদের গোকুলের পদ্ম। সেতো আমাদের গর্বের ধন। আমাদের জাতীয়তার রূপকার, স্থপতি। এই ধন বা সম্পদ নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত নেই। ফুল ফুলই। এর অন্তর্নিহিত সুবাস পরিপাশে ছড়িয়ে যেমন জনপদ লোকালয়ে বিশুদ্ধ প্রশান্তির আবহ ছড়িয়ে দেয় তেমনি অতিমর্দনের আতিশয্যে তা যেন চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে না যায় - সে সতর্কতা তো আমাদেরকেই নিতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, গোলাম হোসেন মোহাম্মদী বেগ এবং মীরজাফর চরিত্র কিন্তু বাংলা থেকেই উদ্ভুত। একবিংশে দাঁড়িয়ে এটা বলতেও দ্বিধা নেই, অমিত তেজের বীর বাঙালী সুভাস বোস আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। পাশাপাশি শিক্ষা জগতের কথিত বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জীর ব্রাহ্মন্য কৌলিন্যের অভিশপ্ত পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীও একজন বাঙালী, যিনি মানুষের বর্ণ বৈষম্যের উদগাতা হয়ে হিন্দু-মুসলিম রেখা টেনে বাঙালীকে দু'ভাগ করিয়েছিলেন। সুতরাং নিমগাছে মৃদুমন্দ দোদুল্যমান পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফোটা ফুল তার নিজস্ব স্বকীয়তায় জগৎ সংসারে শোভা বর্ধন করে, কেউ পঞ্চ পান্ডব হয়ে, কেউবা দুর্যোধন দু:শাসন হয়ে।