জালাল উদ্দিন আহমেদ
ভিসা জুজু
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ জুন,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৩৯ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
'তাল গাছটা সুরক্ষিত রেখেই সব কিছু মসৃণভাবেই এগোচ্ছে'। একজন বিদগ্ধ নাগরিকের মুখ ফস্কে বেরিয়ে যাওয়া এই মন্তব্যটি কি ফেলে দেয়া যায়! চিন্তার বিষয় বটে! কথাটির মধ্যে চিন্তার সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম গলিপথ রয়েছে যা বিচার বিশ্লেষনের দাবি রাখে। ভদ্রলোক এক নাগাড়ে গড় গড় করে তার মনের কথাগুলি উগরে দিলেন। ''সব বেনিয়া ধনাঢ্য গনতন্ত্রের প্রেস্ক্রিপশন। অসহায় তৃতীয় বিশ্বের হাড়-হাভাতে মানুষদের তথাকথিত চায়ের পেয়ালায় তুফান উঠানোর নয়া নয়া এন্তেজাম। মানুষজন খাবে কি, পরবে কি, শুবে কোথায় - এসবের নিত্য চাহিদার কথা বার্তা নেই। আছে শুধু নির্বাচন নির্বাচন আর ক্ষমতা বদলের কথা। কি হবে এই নির্বাচন দিয়ে বা ক'রে। কারা সামনে আসছেন এসব তামাশা করে! সাধারন মানুষের সম্পৃক্ততা কোথায় এখানে। একদল লুটেরা মাসলম্যান গদিতে বসে আছেন। আর অন্য একদল লুটেরার দল সামনে আসার জন্য ছটপট করছেন। মানুষের জীবন যাচ্ছে, সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। সাধারন মানুষের কোন্ সম্পৃক্ততায় এসব রাজনীতি চলে?'' এধরনের হাজারো প্রশ্নবোধক কথাগুলি ভদ্রলোকের মুখ থেকে অনর্গল বেরিয়ে চলেছে।
মানুষ খাবে কি? পরবে কি? শুবে কোথায়? এই বেসিক তিনটি প্রশ্নই তো ঝুলে আছে যুগ যুগান্ত ধরে। আর এই প্রশ্নের ভিতরেই গিজগিজ করছে অজুত সহস্র প্রশ্ন। সমস্যা কি একটা? নির্বাচন কি বাংলা বাঙালীর মূল সমস্যা? এই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা কি কোনদিন নিশ্চিত হয়েছিল? রাজনৈতিক দলগুলো সবাই মিলে সামরিক শাসনের পতন ঘটিয়ে জোট বেঁধে সুপ্রিম কোর্টের একজন সম্মানিত প্রধান বিচারপতিকে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করেছিলেন। তারপর কি ঘটেছিল! ভোট চুরি, নির্বাচনে কারচুপি ইত্যাদির কথগুলো কি সামনে আসে নি? এটা নিয়ে হরতাল মিটিং মিছিল অশান্তি কি হয় নি? কোন্ শক্তিবলে পরাজিত পক্ষ সরকার গঠন করা বিজিত পক্ষকে উঠতে বসতে নাস্তানাবুদ করেছিল তা কি আমরা দেখি নি! তাদের মুখে কেবল ভোটের কথা। ওটাই নাকি গনতন্ত্র। ভোট নাকি মৌলিক অধিকার। সংবিধানে তাই বলে। কি সব আজব কান্ড কারখানা। আর কি কোন মৌলিক অধিকারের কথা সংবিধাবে বলা নেই? পেটে নেই ভাত, গায়ে বস্ত্র নেই, মাথা গুঁজার ঠাঁই নেই- এই নেই এর মধ্যেই তো হাবুডুবু খাচ্ছি আমরা। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ শত সহস্র মৌলিক চাহিদার কি অবস্থা! ভোটের সুষ্ঠতা এলেই কি সবকিছুর সুষ্ঠতা আসবে! একানব্বইয়ের পর কি সবকিছু ঠিকঠাক চলেছিল! ছিয়ানব্বইয়ের পর? দু' হাজার একের পর? নয়, চৌদ্দ, ঊনিশে নাইবা গেলাম। তাহলে একবাক্যে স্বীকার করতে অসুবিধা কোথায় যে কুখ্যাত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সেই সত্তরের নির্বাচনটাই ছিল ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন! মোটকথা, গোড়াই গলদ। এই গলদটা কি? এটারই তো পোষ্ট মর্টেম করতে হবে। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে মতিউল কাদেররা এমনি এমনি মরেনি। বিপ্লবী মেধাবী শিরাজ শিকদার, তার মৃত্যুও হঠাৎ করে হয়নি। রক্ষী বাহিনী গঠন করে হাজার হাজার তরুন-যুবার গুলিবিদ্ধ লাশের লাল রক্ত বাংলার জমিনকে খামাখা রঞ্জিত করেনি। দুর্ভাগা বাঙালী তার আপন স্বত্ত্বার মহানায়কের লাশ সামনে রেখে হাত তুলে দোয়াটুকুও করতে পারেনি। অথচ মহান নেতার গুলিবিদ্ধ লাশ বত্রিশের বঙ্গবধু ভবনের সিঁড়িতে পড়ে থাকা অবস্থায় তাঁরই বিশ্বস্তরা হাতাকাটা কাল কোট পরে বঙ্গভবনে খুনী মোস্তাকের মন্ত্রী হয়ে শপথ নেন। স্বাধীনতার মহান সংগঠকসহ চার নেতার জেলখানায় হত্যা, এমনকি মহান মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মুশারফসহ কর্নেল তাহের ইত্যাদির অকাল প্রয়ান সব একসুতোয় বাঁধা। মহান সিপাহসালার এবং সফল রাষ্ট্রনায়কের ঝাঁঝরা হওয়া লাশ নিয়ে আমরা যখন লক্ষ জনতা মানিক মিয়ায় বিষন্ন বদনে জানাজা পড়েছিলাম, তখন আজকের রাজনীতির ইজারাদারেরা কেউ কি একবার ভেবেছিলেন এধরনের নির্মম হত্যাকান্ড বা অপমৃত্যু কেন? কেন দেশ সেবার ব্রত নিয়ে সামনে আসা বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তনরা এভাবে হত্যার শিকার হচ্ছেন?
আজকে আমাদের রাজনীতির গন্তব্য কোন পথে? ভাগ্য ভাল যে আমরা দুজন মহান বাঙালী সন্তানকে আমাদের জাতির কান্ডারী হিসাবে পেয়েছিলাম। অনেকে হয়তো ভ্রু কুচকাবেন। কি বলে এসব। কার সঙ্গে কার তুলনা। কোথায় আগরতলা কোথায় চৌকির তলা। কিন্তু মহাজ্ঞানী মহাজন, আপনাদেরই বলি - আপনারা দেখানতো একটি মাথা-একটি মুখ, যিনি তার সারা জীবনের রাজনীতি করে কি কামিয়েছেন। এখানে কামিয়েছেন বলতে টাকা পয়সা বাড়ি গাড়ি সম্পদ কামানোর কথা বলছি না। বলছি রাজনৈতিক অর্জনের কথা। বলছি বাঙালীর সমগ্রতায় তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা ও ঔজ্জ্বল্যতার কথা। সবাইতো লেজুড়বৃত্তির রাজনৈতিক কেউকেটা। জনতার ভালবাসায় সিক্ত মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি তো আমাদের পিতা, বাঙালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। অপরদিকে পোষাকী মানুষটি জনতার কাতারে এসে যে ভালবাসায় গনমানুষের আপনজন হয়ে বাঙালীর নেতা হয়েছেন, আছে কি তেমন কোন তৃতীয়জন যিনি আমাদের গর্বের এই দুই শ্রেষ্ঠ সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারেন? অবশ্য রাজনীতির তৈল মর্দনের অতি চামচের একটি দল এটা শুনে খ্যাঁক ক'রে উঠবেন।। বলে কি এই আহম্মকের ছাও। পিতার সাথে পুত্রের তুলনা! নাহ্, তুলনা করছি না। তুলনা করার স্পর্ধাও দেখাচ্ছি না। অপরজনকে পিতার পাদদেশে রেখেই বলছি, আপন অস্তিত্বের উঠান তৈরীর পর আমরা পেয়েছি কি কোন তৃতীয় উঠান বা মাথা যার নামে দাঁড়িয়ে কোটি বাঙালী উত্তাল উন্মাদনায় সোনার বাংলা বা প্রথম বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে বিনি সুতো গাঁথবেন! কিংবা তাকে নিয়ে বাংলার জনপদে নতুন স্বপ্নের উন্মাদনা তৈরী হবে। যাদেরকে দিয়ে হোত তারা নেই। যারা আছেন তারা পরম্পরার সুবিধাভোগী উত্তরাধিকার। আর পাশে যারা আছেন, তারা রবি ঠাকুরের 'দুই বিঘা জমি'র 'পারিষদ দল' এর ডিজিট্যাল সংস্করন। এই তিপান্ন বছরে কতজন প্রেসিডেন্ট পিএম এফএম আমরা পেয়েছি! পরম্পরার দুই শিরোমনিকে বাদে দেখান তো তৃতীয়জন! একজন স্পর্ধা দেখেছিলেন এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোতে চেয়েছিলেন কিন্তু 'ওয়ান টু কা' করতে গিয়ে সেটাও 'বল হরি' হয়ে গেছে। সুতরাং শুভংকরের গ্যাঁড়াকলেই আমাদের বসবাস। পারা যাবে কি প্রি-যুগের ভাসানী শের ই বাংলা বা সোহরাওয়ার্দীদের মত কাউকে উপস্থাপন করতে যাকে নিয়ে বাঙালী আশায় বুক বাঁধবেন। সেক্ষেত্রে বাংলাকে গড়তে হলে, বাঁচাতে হলে, উচ্চকিত করতে হলে শিরোমনিদের সামনে রাখতেই হবে। কিন্তু ক্ষমতা বদলের রাজনীতির খেলায় পরম্পরার সুতা ধরে গনতন্ত্রায়নের এই মাজন আর কতদিন চলবে? পরম্পরায় রেখে ক্ষমতার দন্ডটি তাদের হাতে দিয়ে কেন রাজতন্ত্রের বহমান স্রোতধারায় দেশ শাসনের নৌকাটি বার বার ভাসানো হচ্ছে! ফলশ্রুতিতে আমরা কি পাচ্ছি। তঞ্চকতা ব্রুট্যালিটি আর মধ্যযুগীয় আচার আচরনের সামাজিক বিন্যাস। আর এসবের ইজারা তো তারাই নিয়ে রেখেছেন যারা কোনদিন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে চান নি। তারা মাথা নুইয়ে জমিদারী পাইক পেয়াদার ভূমিকায় কাটিয়ে দিলেন তথাকথিত এই রাজনীতির বর্ণাঢ্য(!) জীবন। তারা পক্ষ বিপক্ষের বলয় তৈরী করে শিরোমনিদের নাম সংকীর্তন করেই রাজনীতির মহা মহিম হয়েছেন। কি চমৎকার আয়োজন। কোন দায় দায়িত্ব নেই। ভাল হলেও ওরা, মন্দ হলেও ওরা।
আবারো সেই ভদ্রলোকের কথায় আসা যাক। তিনি বলছেন, ''কি হয়েছিল আমাদের একাত্তরে! আমরা কি ভুলে গেছি সেই একাত্তরের কথা। সেই সেভেন্থ ফ্লিটের কথা, সেই তলাবিহীন ঝুড়ির কথা। সুতরাং ক্ষমতা যার হাতে, তালগাছটিও তারই হাতে। সামাজিক মিডিয়ায় এতসব বাঘা বাঘা আয়োজন। গেল গেল রব। কিন্তু সবইতো ঠিকঠাক। উনি বহর সাজিয়ে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটোছুটি করছেন। মিটিং করছেন, সংবাদ সম্মেলন করছেন। বড় বড় মিডিয়ায় সহাস্য সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। আর ওদিকে মোড়ল রাষ্ট্রটির মন্ত্রী পাতিমন্ত্রী আমত্য পারিষদ ঘন ঘন আসছেন আর বসছেন। আচ্ছা, কি এমন ঠেকা পড়েছে ওদের? ওরা বেনিয়ার দল। নিজের স্বার্থ ছাড়া ওরা একচুলও নড়ে না। সুতরাং এই নাটকের সমাপ্তি ঘটবে ওই একাত্তরের কিসিঞ্জারীয় সপ্তম নৈবহরের কেচ্ছা দিয়ে''। ভদ্রলোক থামতেই চান না। এক নাগাড়ে তার মনের কথাগুলি বলেই চলেছেন। তিনি বলছেন, "ওই যে পরম্পরার ওরা! বছরের পর বছর বিদেশে থাকছেন। বছরের পর বছর উন্নত বিশ্বে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। কেউ ডিজিট্যালের উদ্ভাবক হচ্ছেন, কেউ বৃহৎ একটি পার্টির সর্বসেরা হয়ে ওখান থেকে বাঙালীকে নসিহত করছেন। কিন্তু তাদের ওখানকার বিলাসী জীবনের রসদ কোথা থেকে আসছে?এর মূল উৎসটি কি? স্রেফ দুর্নীতি, টাকা। এত টাকা ওদের আসে কোত্থেকে? এত এত স্যুটকেস রহস্য ব্রীফকেস রহস্য দেখা গেল। খবর হোল। কিন্তু কেউ কি সামনে এসে এসব বাক্স বা স্যুটকেস খুলার সাহস দেখিয়েছে? ওরা যে আমাদের দেশটাকে ফোঁকলা করে দিচ্ছে - কেউ কি এসব নিয়ে ভাবছে? জনতা কি রাস্তা ব্লক করে, এয়ারপোর্ট ঘেরাও করে এসবের জবাব চেয়েছে?" কত কথাই তিনি বললেন। আরো বলতে চান। সবশেষে তিনি যা বললেন তা সত্যিই এক পিলে চমকানো ভবিষ্যত বাণী বলেই হজম করতে হলো। "আরে ভাই এসব স্যাংশান ফ্যাংশান কিংবা ভিসা নীতিটিতি সবকিছু আই ওয়াশ। জুজুর ভয় দেখিয়ে নিজেদের হাতের মুঠোয় পৃথিবীটাকে কাবু করে রাখা। পাশাপাশি ক্ষমতা ও ঔজ্বল্যতার ভারিক্কি দিয়ে তৃতীয় বিশ্বের সাধারন আম জনতার চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলা আর কি! অর্থাৎ আমাদের অবস্থা সেই গ্রাম্য কাহাবতের ''যেই শান কি তেই শান শুটকি কা বাইগুন"।
আসলে সেটাই দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি নিউজ পোর্ট্যাল দিনরাত গলদঘর্ম হয়ে- গেল গেল রব তুলে তোলপাড় করে ফেলছে। একজন রিটায়ার্ডকে তো গত কয়েক বছর থেকে দেখছি অন্য মহিমায়। তিনি নাকি কমান্ডো তৈরী করে রেখেছেন, ছায়া সরকারের রূপরেখাও দিয়ে রেখেছেন। কি সব আজগুবি বোলচাল। আরেকজনের মুখ খিস্তি শুনে তো মনে হয় তার মত জ্ঞানী ও সফেদ মানুষ ইহজগতে একটিও নেই। আবার নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাসই বেশী। কিন্তু আমরা যারা মূল জমিনে আছি তারা তো নিরীহ আমজনতা। আর কত ছিনিমিনি কুট ক্যাচালী চলবে আমাদের মত পান্তা ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ ড'লে খাওয়া বাঙালীর উপর। আমাদের ভিসা টিসা লাগে না। আমরা দিন আনি দিন খাওয়া মানুষ। আমাদের পেটে লাত্থি পড়ে এমন কাজ আমাদের চালক বা শাসকদের কাছে আশা করি না। তবে জুজু তো বটেই। যারা অপকর্ম করে পাহাড়সম সম্পদের মালিক হয়েছেন বা হয়েই চলেছেন, মাথাব্যাথা তো তাদের। তাদের সম্পদ, সন্তানেরা - সবই তো ওদের জিম্মায়। সুতরাং কানমলা বা নাক খতের জন্য প্রস্তুত হন মহা মান্যবরের দল। সেরা বাঙালীকে আর কত সেরদরে বেঁঁচবেন! আমরা আম জনতা যে সততা ও স্বত:স্ফুর্ততায় মুজিবের মন্ত্র কিংবা জিয়ার কর্মধারা ধারন করি সেরকমটা যদি আপনারা একটু আধটুও করতেন তাহলে তো এই নাকানির দশায় পড়তে হোত না। আপনারা বলেন বেশী কিন্তু ধারন করার ক্ষমতা আপনাদের নেই। সেরাদের সেরদরে বিক্রি করে নিজেরা সোয়া সের হচ্ছেন। ফলে সেই ওজনের ভার বইতে না পেরে এখন টল টলায়মান হচ্ছেন স্যাংশন ভিসা ইত্যাদি জুজুর ফাঁদে পড়ে। আল্লাহ আপনাদের হেদায়েত করুন। আ'মীন!