জালাল উদ্দিন আহমেদ
মহামারী না অতিমারী
প্রকাশ: ১০:৪৯ পিএম, ১৬ নভেম্বর,সোমবার,২০২০ | আপডেট: ১২:২৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
অতিমারী শব্দটি অভিধানের কোথাও খুঁজে পেলাম না। এটা কি আমার দুর্বলতা নাকি সেই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মহোদয়ের অসচেতনতা! শব্দটি আমি তার মুখ থেকেই শুনেছি। ভাল কথা। যদি এই অতিমারী একটি বাঙলা শব্দ হয় তবে তা তো খারাপের কিছু নয়। বাংলা শব্দমালায় একটি নতুন শব্দ যোগ হয়ে বরং আমাদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করলোই বলা যায়।
করোনা আমাদের করুনা করছে কিনা তা বলা মুস্কিল। তবে মহামারী বলতে যা বুঝায় করোনার সংক্রমন সেভাবে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করছে বলে মনে হয় না। মহামারীর আরেক নাম মড়ক। সে মড়ক কি লেগেছে বাংলার জমিনে! এই তো এক শতক আগে বাংলা তথা ভারত বর্ষের জমিনে যে কলেরা মহামারী হয়েছিল এবং তার ব্যপকতায় যে প্রাণহানি ঘটেছিল তার ধারে কাছেও তো নেই এই প্যান্ডেমিকের ছোবল। আমরা সিনেমা ডকুমেন্টরীতে সেই মহামারীর প্রকোপে জনপদ বিনাশের চিত্র দেখেছি। সুতরাং করোনার ছোবলে যে মহামারীর দৃশ্যপটে আমরা এখন আমাদের সমস্ত মেকানিজমকে ব্যতিব্যস্ত রেখেছি তা সাধুবাদ পাওয়ারই যোগ্য। আমরা পারি এবং পারছি বলেই হয়তো করোনার মড়কে আমরা মট্কে যাইনি। সেক্ষেত্রে সরকারী যন্ত্রের কার্যকরী ও সময়াচিত তৎপরতা আমাদের অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছে। যাহোক করোনার এই সহনশীল দাবড়ানির মধ্যে থাকলেও বাংলার জমিনে সমাজ ও জনপদে মনুষ্য সৃষ্ট যে সকল অপকর্ম মহামারীর আকার ধারন করেছে তার প্রকোপে আজ সামাজিক বিন্যাস বিপর্যস্ত হতে বসেছে।
আমরা কি শুধু করোনা মহামারী নিয়েই তটস্থ থেকেছি? বোধ হয় না! একটা সময় ছিল যখন এই জনপদে ধর্মীয় গোঁড়ামীর ফেরিওয়ালারা দেশে ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ তৈরী না করে তারা দেশে ধর্মান্ধ মানুষ বানাতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে ধর্মান্ধ মানুষের অবাধ এবং স্বেচ্ছাচারী বিচরণে জনপদে ধর্ম বিভেদের প্রকটতা প্রকাশ পেয়েছে। পাড়া মহল্লা এমন কি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক বিভেদের সুর শোনা গেছে। কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক উস্কানী মূলক ঘটনার সূত্রপাতে দাঙ্গা হাঙ্গামাও হয়েছে। দেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানোর মন্ত্রে বলীয়ান হয়ে এক ধরনের জঙ্গী গোষ্ঠীও তৈরী হয়েছে। এসব গোষ্ঠী তাদের কিলিং স্কোয়ার্ড তৈরী করে দেশের মুক্তমনা কবি সাহিত্যিক ও প্রগতিশীল জনপদে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। এমন কি প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিক ও মুক্তমনা উদীয়মান লেখক ও চিন্তাবিদদের হত্যা করা শুরু করে। ফলে দেশ ও জনপদে তৈরী হয় ভীত ও সন্ত্রস্ত পরিবেশ। আরব দেশ সমূহের অবাধ পেট্রোডলারের যোগানে তারা এদেশে তাদের আদলে ইসলামিক স্টেট গঠনের স্বপ্নে বেপরোয়া হয়ে উঠে। তবে বাংলার মানুষ ধর্ম বিশ্বাসী হলেও ধর্মান্ধতার তকমা লাগিয়ে তারা কোন সময় চলে নি। সর্ব ধর্মের সমন্বয়ে আবহমান সহমর্মিতা ও সুসম্পর্ক নিয়েই তাদের পথচলা। বাঙলা ও বাঙালীর মৌলিক চরিত্রের এই সবলতাকে কাজে লাগিয়ে তাই সরকারী রাষ্ট্রযন্ত্র সেদিনের সেই ধর্মান্ধ জঙ্গী গোষ্ঠীর শিকড়কে উৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছিল। সে সময় ধর্মান্ধতার সেই মহামারী বাংলার জনপদে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করেছিল তা সত্যিকার অর্থেই বেশ ভয়াবহ ও ভীতিকর ছিল। সেটা রীতিমত একটা মহামারী বা অতিমারীর পর্যায়েই ছিল বললে অত্যুক্তি হবে না।
সময়ের আবর্তে কালা ধলা মুরগী মেন্টাল বা বাইনদের আধিপত্যে সমাজে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হোল। সে সময় তাদের দাপটে সামাজিক বিন্যাস এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সন্ত্রাস হত্যা লুন্ঠন জমি দখল মুক্তিপন এধরনের ভীতিকর ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে তারা সমাজে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। মানুষ হত্যা ও খুন খারাবী যেন এক নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই জনপদে। ব্যবসা বাণিজ্যে এবং রাষ্ট্রীয় কর্ম চাঞ্চল্যের সর্বক্ষেত্রে তাদের দাদাগিরি প্রকাশ্য ও প্রকট আকার ধারন করেছিল। একসময় সরকারী রাষ্ট্রযন্ত্রও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। তবে সেক্ষেত্রেও জনমানুষের সচেতনতা ও সরকারী যন্ত্রের তৎপরতায় সে গলিপথের অতিমারী থেকেও আমাদের স্বস্তি এসেছে।
বর্তমানে দেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অঘটনের গ্রাফগুলো যেভাবে বিকশিত হচ্ছে তাতে সেসবের দাপটে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার নাভিশ্বাস উঠেছে। আজকের দিনে যে হারে দেশব্যাপী গণধর্ষনের মহোৎসব চলছে তা কি এই করোনা মহামারীর থেকে কোন অংশে কম! আবার টিন এজার বা উঠতি যৌবনের পাদদেশে পদার্পন করা বাচ্চা ছেলেরা যেভাবে সমাজ জীবনে দাদাগিরির নতুন মসলা নিয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে তাতো রীতিমত আর এক মহামারী। কোন্দিকে যাই। সর্বক্ষেত্রে খানা-খন্দরে ভরা এই বাংলার জমিন। শিক্ষাক্ষেত্রে অযোগ্য দলকানা শিক্ষা প্রশাসন আজ শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। গোল্ডেন এ প্লাসের মূলা ঝুলানো শিক্ষা ব্যবস্থা আজ আমাদের ছেলে মেয়েদের তোতাপাখি বানাচ্ছে। শিক্ষক রাজনীতির দলকানা আচরনে শিক্ষা ব্যবস্থার বুনিয়াদটাই আজ শিকেই উঠে গেছে। ছাত্র রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির ফলে আজ ছাত্রদের প্রতিভা বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির দাদাগিরির তঞ্চকতায় আজ ছাত্র সমাজ নিজেদের ছাত্রত্ব বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক নেতার আচরনে বেড়ে উঠার রসদ খুঁজে নিচ্ছে। এটাও কিন্তু এক ধরনের মহামারী!
দেশের অর্থ ব্যবস্থার দিকে তাকালে যে অরাজকতা দেখা যায় তা এখন মহামারী আকারেই আমাদের চোখে ধরা পড়ে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার একটা সময়ে দেশের শেয়ার বাজারের যে ভিত্ তৈরী হয় তাতে দেশের সাধারন মানুষের স্বপ্রণোদিত আগ্রহ ও অংশ গ্রহনের ফলে সে সময় শেয়ার বাজার একটা শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে যায়। এভাবে শেয়ার বাজার যখন একটা ভাল অবস্থানে নিজেকে দেশের অর্থিক খাতের একটি খুঁটি হিসাবে দাঁড় করানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায় ঠিক তখনই যেন এক অশনির ঢাক বাজা শুরু হয়ে যায়। রাজনীতির লেবাসে ঠাঁই নেয়া যতসব মহাজনদের কারসাজিতে শেয়ার বাজারের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ফোকলা হতে শুরু করে। এক সময় তা নিঃশেষ হয়ে যায়। সে সময় শেয়ার বাজারের তেলেসমাতির কারনে বহু সাধারন মানুষ এমনকি ঘরের গৃহবধুও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়ে নিজেদের হতাশা ও গ্লানি থেকে মুক্ত হতে চেয়েছে। শেয়ার বাজারের সেই মহামারী এখনো আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি এক সময় এমন এক প্রকট রূপ ধারণ করে যার ফলে ব্যাংকের দরজায় যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও মানুষ ভুলতে বসে। সরকার নিয়োজিত ব্যাংক ব্যবস্থায় কতিপয় রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কেউকেটা যেভাবে ব্যাংকের টাকা লুটপাটের মচ্ছব শুরু করেন তাতে দেশের এই খাতের দৈন্যদশা শুরু হওয়ার উপক্রম হয়। শোনা যায় শিল্প ঋণ প্রকল্প ঋণ ইত্যাদির ছত্রছায়ায় দেশের মোটা অংকের টাকা বিদেশে পাচার করা হয়। এবং এটা করা হয় অসাধু প্রভাবশালী রাজনৈতিক লেবাসের মানুষজন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আধিকারিকদের সক্রিয় তৎপরতায়। বাংলার পকেট খালি করে এসব টাকা নিয়ে তারা মালয়েশিয়া কানাডা ইত্যাদি দেশ সমূহে বিনিয়োগ করে সেখানে অভিজাত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে। সেই পরম্পরায় আমরা দেখি বা শুনি সেখানে তৈরী হয় বেগম পাড়া বা বাঙালী পাড়া নামক অভিজাত আবাসিক এলাকা, সেখানে থাকে ওইসব লুটেরাদের বিবি বাচ্চারা। এই গরীব দেশের উঠানে এটা কোন্ মহামারী বলতে পারেন! আমাদের দেশে শিল্প স্থাপনের নামে যেভাবে যেনতেন ভাবে ব্যংকের টাকা লুটপাট করা হয় তা কোন্ পরিমাপে পড়ে? শিল্প স্থাপনের নামে টাকা উঠিয়ে যখন তা দিয়ে বাড়ী গাড়ি বা বিদেশে পাচারের মচ্ছব শুরু হয় তখন তা দিয়ে আর দেশে শিল্প গড়ে উঠে না। সময়ের আবর্তে সেই প্রস্তাবিত শিল্প জন্মলগ্নেই রূগ্ন শিল্প হিসাবে সরকারী হিসাবের খাতায় ঠাঁই নেই।
সুতরাং মহামারী বলুন বা অতিমারীই বলুন – এসব আজ বাংলার পুরো অবকাঠামোর পরতে পরতে। এ থেকে পরিত্রানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সামাজিক ঐতিহ্যের শাশ্বত আবহকে ফিরিয়ে এনে বাংলাকে বাংলার মত করে সাজাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন রাজনীতির সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনীতির শুদ্ধাচারে বাংলার উঠানকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। পারস্পারিক সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধাবোধই এই সকল মহামারীর হাত থেকে আমাদের মুক্ত করতে পারে – এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।