জালাল উদ্দিন আহমেদ
বার আউলিয়ার সৈয়দ আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দিন (রহ:)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৫ মে,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:৫১ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
১।
সুহৃদ শ্রদ্ধেয় মুখলেসুর রহমান মন্টু। থাকেন বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন নগর রাজশাহীর ফুদকি পাড়ায়। ব্যবসায়ী মানুষ। তবে চলনে বলনে মিলিটারী মেজাজ। তাকে দেখে মাঝে মধ্যে মনে হয় দেশের সশস্ত্রবাহিনী একজন বিচক্ষন সেনা নায়কের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহীর একটি বিখ্যাত ক্লাবের সদস্য হওয়ার সুবাদে এসব গুনীজনদের সাথে আমার সখ্যতা বেড়েছে। ক'দিন আগে প্রাত:রাশ সেরে লিভিং রুমের লাগোয়া খোলা বারান্দায় মুক্ত বাতাসে বসে পিনাকি ভট্টাচার্যের একটি রিপোর্ট দেখছিলাম। হঠাৎ মন্টু ভাইয়ের ফোন। শাহ্ মখদুম (র:) সমন্ধে কিছু জিগ্যাসা তার। তা আমাকে কেন! সত্যি কথা বলতে কি, আমার সমন্ধে উনাদের অগাধ আস্থা। ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছু জিগাস্য থাকলে আমার শরনাপন্ন হন। আমি লেখালেখি করি। কিছুটা আঁতেলীয় ভাব। সুতরাং আমাতেই ভরসা। যাহোক মন্টু ভাই যে প্রশ্নটি করেছিলেন তা স্বাভাবিক এবং সরল একটি প্রশ্ন। যতটুকু জানি তা দিয়ে উনাকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলাম বলে মনে হয়। তার প্রশ্ন ছিল, শাহ মখদুমের নামের পিছনে রুপোশ অর্থাৎ শাহ মখদুম রুপোশ কেন বলা হয়। এই রুপোশ শব্দের অর্থ বা এর মোজেজা কি।
এত কিছুর পর আমার মনে একটু খটকা লাগলো। বেশ তো! আল্লাহর এই অলিকে নিয়ে সাধারনের জন্য সাদামাটা ভাবে কিছু লিখলে কেমন হয়। তবে ওই যে অজ্ঞতা! সেটাকে অতিক্রম করে কিভাবে এত বড় একজন মহান সাধকের ব্যাপারে কলম ধরি! তাছাড়া বাংলা ভূখন্ডের এই মাটিতে সহস্রাব্দ পূর্ব হতে ইসলাম প্রচারে যে হারে সাধক ও অলি আউলিয়াগন এসেছিলেন তা বেশ তাৎপর্যপুর্ন বটে। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলার পুর্বাঞ্চল অর্থাৎ পুর্ব বাংলা এমন এক জনবসতির ভূখন্ড ছিল যেখানে মানুষের মানবিক মুল্যবোধের কোন ঠাঁই ছিল না। প্রাচীন অসুরীয় প্রথা প্রচলনে দৈত্য দানবীয় আচরনের রাজা জমিদাররা অঞ্চল ভিত্তিক শাসক হিসাবে বিদ্যমান ছিলেন। তারা নিজেরাই দেব দেবীর আচরনে প্রজাকুলকে যাদুমন্ত্রের মোহজালে আবিষ্ট রেখে তাদের মহত্বের জারি রাখতেন। একটা অরাজক ও অমানবিক জীবনধারার অসহনীয় পরিস্থিতে এতদাঞ্চলের জনপদ জর্জরিত ছিল। শুনেছি সেসব খবরের সূত্র ধরেই ইসলামী জাগরনের সেই সময়ে আরব দেশের ইরাক ইয়েমেনের সাধক সুফিগন তাবলিগি দীক্ষার মনোবল নিয়ে ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণী প্রচারে ভারত ও প্রাচ্যের দিকে দলবদ্ধভাবে আগমন করেন। শুধু ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণী প্রচার করেই তাঁরা ক্ষান্ত হননি। সমাজ ও শাসন ব্যবস্থার প্রায়োগিক বাস্তবায়নে ইসলামী জীবনধারায় স্থানীয় জনমনে স্বস্তি ও শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়।
বাংলাদেশকে বলা হয় বার আউলিয়ার দেশ। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন শুধুমাত্র চট্টগ্রামকে বার আউলিয়ার দেশ বলা হোত। এখনও হয়তো বলা হয়। অবশ্য এর সত্যতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারন প্রাচীন পরবর্তী মধ্যযুগীয় সে সময়টায় পুর্ব বাংলার মূল কেন্দ্র ছিল চাটগাঁ বা চট্টগ্রাম। আরাকানীয় সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হিসাবে চট্টগ্রামের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী ছিল। তাছাড়া নৌপথ বা সমুদ্র পথের সংযোগে চট্টগ্রামের ফোকাশটা অপরিসীম ছিল। ফলে আরব দেশ হতে আগত অলি আলেমদের দল স্থল পথের চেয়ে নৌপথেই অগ্রগামী ছিলেন। সম্ভবত: খুরমা খেজুর এবং মসলা-পাতির ব্যবসার সূত্র ধরে এবং ইসলামী পয়গাম বা বার্তা প্রচারের উদ্দেশ্যে তারা এদেশের মাটিতে পা রাখেন। তারা এদেশে যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করতে আসেননি। তাবলিগি আবেশে ইসলামী সাম্য ও শান্তির বাণী প্রচারই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তারা এদেশে এসে মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে গিয়েছিলেন। নামাজ রোজা এবাদত বন্দেগী এবং সামাজিক সাম্যতা শান্তি ও সহবস্থানের নীতিতে তারা বাংলার মানুষের কাছে যেতে পেরেছিলেন। ফলে তৎসময়ে নিপীড়িত ও সামাজিকভাবে অবহেলিত সম্প্রদায়ের লোকজন জাতিভেদহীন ইসলামের শান্তির পতাকাতলে সমবেত হন। বাংলা প্রদেশের পুর্বাংশে ধর্ম বর্ণ ও সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ, দৈত্য দানবীয় যাদুমন্ত্র ও মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার অত্যাচার বেশী থাকায় অলি আউলিয়া ও সাধকদের আগমন এখানেই বেশী ঘটে। ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বানী প্রচারে এই অঞ্চলে বেশী করে সময় ও শ্রম দিতে হয়েছে তাদের। ফশ্রুতিতে এতদাঞ্চলে ইসলাম প্রসারের ব্যপকতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রসঙ্গ বার আউলিয়া। লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বার(১২) কথাটির সাজুয্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানেই এইসব অলি আল্লাহ ও সুফি সাধকদের খোঁজ নেয়া হয়েছে সেখানেই তাদের নমুনা হিসাবে বারজন অলি আউলিয়ার কবর বা মাজারের খোঁজ পাওয়া যায়। যেমন চট্টগ্রামে হজরত আমানত শাহ(র:) হজরত বায়েজিদ বোস্তামী(রহ:)দের কেন্দ্র করে এখানে বারজন আল্লাহর অলির মাজার পাওয়া যায়। যদিও হজরত শাহ জালাল(রহ:) তিন'শ ষাটজন সাধক সুফি ও মুরীদ নিয়ে এদেশে এসেছিলেন। তবুও তিনি এই বার আউলিয়ার প্রধানদের একজন ছিলেন। কারন তিনি যখন বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তখন তার সঙ্গী ছিলেন এগারজন। বিক্রমপুরের কেওয়ার গ্রামে দেখা যায় বারজন আউলিয়ার মাজার। হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের মুড়াইবন্দে এরকম বারজন অলি আল্লার মাজারের খোঁজ পাওয়া যায়। সেইভাবে ফরিদপুরের বোয়ালমারিতে, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে, পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুরে এই বার আউলিয়ার গ্রাম এবং মাজার পাওয়া যায়। আবার রাজশাহীর বাঘা ও রামপুর বোয়ালিয়া বা মহাকাল গড়ের এলাকাতেও শাহ মখদুমের (রহ:) নেতৃত্বে একদল আলেম ওলেমা ও বীর এসেছিলেন এতদাঞ্চলের অনিয়ম ও অপসংস্কৃতির বিনাশ ঘটাতে। একই ঘটনা ঘটেছে খুলনা বাগেরহাটের খান জাহান আলি(রহ:)র. ক্ষেত্রেও। আবার সিরাজগঞ্জের পুর্ণিমাগতি ইউনিয়নের গয়হাটায় শাহ্ সুফি সৈয়দ কুতুব উদ্দিন বাগদাদী(রহ:)কে কেন্স্র করে সেখানেও বারজন অলি আল্লাহর মাজারের খোঁজ পাওয়া যায়। অর্থাৎ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তৎসময়ে ইসলাম প্রচারের ব্যকুলতা এবং স্থানীয় মানুষের ইসলামের প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসায় এতদাঞ্চলে ইসলামের ব্যপকতা বৃদ্ধি পায়। মোটকথা বাংলার প্রতিটি অঞ্চল পীর আউলিয়া ও আল্লাহর অলিদের পদধুলিতে ধন্য হয়েছে। তাদের এই বার বা ততোধিক গুচ্ছ কবর বা মাজারের নমুনা আজ স্মৃতি হয়ে বাংলাকে বার আউলিয়ার দেশে পরিণত করেছে।
বাংলায় বহুল প্রসিদ্ধ এবং মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত কয়েকজন প্রধান অলি আউলিয়া হলেন- হজরত শাহ জালাল(রহ:), হজরত শাহ পরান(রহ:), হজরত আমানত শাহ(রহ:), হজরত বায়েজিদ বোস্তামী(রহ:), হজরত শেখ ফরিদ(রহ:), হজরত শাহ সুলতান হোসেইনী(রহ:), হজরত উড়িয়ান শাহ(রহ:), হজরত বেলায়েত আলি শাহ(রহ:), হজরত শাহ মখদুম রুপোশ(রহ:), হজরত তুরকান শাহ(রহ:), হজরত খান জাহান আলি(রহ:), সৈয়দ কুতুব উদ্দিন বাগদাদী(রহ:) ইত্যাদি। এরকম শত সহস্র অলি আউলিয়ার পদধুলিতে ধন্য হয়ে আজকের মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ তাদেরই দীক্ষার আলোক ছটায় সর্ব ধর্মের বাঙালীর বাংলাদেশ হয়ে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
২।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় ইসলামের জাগরনের সেইসব দিনগুলিতে ইরাক ইরান ইয়েমেন ইত্যাদি আরব দেশ হতে ইসলামী আলেম ওলেমারা ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন। অষ্টম শতাব্দী হতে চৌদ্দ'শ শতাব্দী পর্যন্ত তাদের এই তাবলিগি স্টাইলের ধর্ম প্রচারের সফর অব্যাহত থাকে। শুরুতেই একটি নাম নিয়ে আমার এই নিবন্ধের সূত্রপাত। সেই পবিত্র নামটি হচ্ছে সৈয়দ আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দিন। তিনি বাংলার জমিনে হজরত শাহ মখদুম রুপোশ(রহ:) নামে খ্যাত। বাংলাদেশে বার আউলিয়ার একজন তিনি। শাহ্, মখদুম এবং রুপোশ তার টাইটেল বা উপাধি। শাহ অর্থ শাসক। মখদুম অর্থ সর্বোচ্চ সম্মানিত বুজুর্গ এবং রুপোশ অর্থ আচ্ছাদিত। চিশতিয়া কাদেরিয়া মতাদর্শী বড় মাপের আলেমরা তাদের মুখ একটুকরো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন। এই মুখমন্ডল ঢেকে রাখার কারনে তাদেরকে রুপোশ হিসাবে সম্মান দেয়া হোত। শাহ মুখদুমের পারিবারিক নাম সৈয়দ আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দিন। তিনি হজরত বড়পীর সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী(রহ:)র আপন নাতি। সেই সূত্রে তিনি হজরত আলি(রা:)র বংশধর। বড়পীর হজরত সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানীর(রহ:) পুত্র আযাল্লা শাহ হচ্ছেন হজরত শাহ মখদুমের পিতা। ১২১৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বাগদাদে জন্ম গ্রহন করেন। বংশের পরম্পরা অনুসারে তিনি ইসলামী শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ বাগদাদে সম্পন্ন করেন কৃতিত্ত্বের সাথে। সেখানে তিনি কোরান হাদিস ফিকাহ শাস্ত্র ও সুফি তত্ত্বের উপর জ্ঞানার্জন করেন। আব্বাসীয় শাসকদের উপর তাতারী বা হালাকু খান গোত্রের আক্রমনে ইরাকের বাগদাদ নগরীর পতন ঘটলে আযাল্লা শাহ(রহ:) তার তিন সন্তানকে নিয়ে হিন্দুস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন এবং সিন্ধু প্রদেশে আশ্রয় নেন। সেখানে আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দিন স্থানীয় এক বিখ্যাত মাদ্রাসা থেকে ইসলামের বিভিন্ন ফকিহা ও ইজতেদায়ী শক্তির সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেন। ধ্যান জ্ঞান ও প্রকৃতগত উন্নত যোগ্যতার বলে তিনি কাদেরীয় তরিকার সিদ্ধ পুরুষ হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। সেখানেই তিনি 'মখদুম' উপাধিতে ভুষিত হন। মখদুম কথাটির অর্থ হচ্ছে সর্বোচ্চ সম্মানিত। ১২৬২-৬৩ সালের দিকে তিনি দিল্লিতে চলে আসেন। এর কিছুদিন পর ইসলাম প্রচারের তাগিদে তিন
ভাইসহ তারা বিহারে ঠাঁই নেন। তাদের পিতা পারিবারিক কারনে সেসময় বাগদাদে ফিরে যান।
১২৭৭-৭৮ সালের কথা। দিল্লির সুলতান তখন গিয়াস উদ্দিন বলবন। বাংলার বিদ্রোহী শাসক তুঘরিল খানকে পরাস্ত করার জন্য তিনি বাংলায় গমন করেন। তখন শাহ মখদুম সুলতানের যুদ্ধ বহরের সঙ্গী হয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন। গৌড়ে অবস্থান নেয়ার পর তিনি তার বড় ভাই মিরান শাহের সঙ্গে নৌকাযোগে নোয়াখালী পর্যন্ত আসেন। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির শ্যামপুরে দলবলসহ তারা আস্তানা গাঁড়েন। সেখানেই মিরান শাহ(রহ:) স্থায়ী হন। কিন্তু শাহ মুখদুম তার শিষ্য তুরকান শাহের মৃত্যু সংবাদ শুনে রাজশাহীতে ফিরে আসেন। রাজশাহীতে ইসলাম প্রচারের সময় শত্রুর হাতে শহীদ হন তুরকান শাহ। রাজশাহীতে ফিরে শাহ মখদুম বাঘা নামক স্থানে থিতু হন। সেসময় রাজশাহীর নাম ছিল মহাকাল গড়। মহাকালগড়ের শাসক ছিলেন দুই তান্ত্রিক ভাই অংশু দেও ধর্মভোজ এবং অংশু দেও গুজ্জভোজ। তারা খুব অত্যাচারী ছিল। তাদের অত্যাচারের একটি অংশ ছিল হজরত তুরকান শাহের হত্যা পর্ব। এটা নিয়েও বেশ বড় কাহিনী রয়েছে। যাদুমন্ত্র, ভুতপ্রেত, দৈত্য দানবের ভীতি ছড়িয়ে এবং নিজেদেরকে দেবতা বলে প্রচার করে দেও রাজারা রাজ্য শাসন করতো। ষাটোর্ধ আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দিন অর্থাৎ শাহ মখদুম(রহ:) তখন একজন পাকা সিদ্ধ পুরুষ, একজন যোদ্ধা এবং প্রশাসক হিসাবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতার অধিকারী। তিনি বাঘার স্থানীয় মানুষজনদের ইসলামের পতাকাতলে সামিল করে অপশক্তির বিনাস করার শপথে তাদেরকে যুদ্ধকৌশলে পারদর্শী করলেন। তিনি তার ঐশ্বরিক শক্তিবলে অত্র এলাকার মনুষের আস্থা অর্জন করলেন। তার ঐশ্বরিক শক্তির মধ্যে ছিল কুমিরকে বাহন করে নদী পারপার এবং স্থলপথে বাঘের পিঠে চড়ে যোদ্ধাবেশে শত্রুদের আক্রমন করা। তাছাড়া মহাকালের রাজাদের অমানবিক অত্যাচারের নরবলি ইত্যাদির ধরনে তিনি বেশ মর্মাহত হয়ে তার ইমানী শক্তির জোশে তদাঞ্চলের সাধারন মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় দ্রুত তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন বলে ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন। দেও রাজাদের সঙ্গে তিনি তিনবার যুদ্ধ করেন। অবশেষে তাদের পরাস্ত করে, আহত দেও রাজাদের নিজ হাতে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ্য করেন। হজরত শাহ মখদুমের মানবতা ও ইসলামী শিক্ষার মহানুভবতা দেখে রাজাসহ পুরো পরিবার সেসময় ইসলাম ধর্মে দিক্ষা নেয়। ফলে মহাকাল গড়ের প্রজারা দলে দলে ইসলামের পতাকা তলে সামিল হন। হজরত শাহ মুখদুম রুপোশ(রহ:) ইসলাম ধর্ম প্রচারে এভাবেই রাজশাহী অঞ্চলে বিখ্যাত হন। ১৩১৩ সালে আল্লাহর এই অলি অকৃতদার হজরত সৈয়দ আব্দুল কুদ্দুস জালালুদ্দিন ওরফে হজরত শাহ মুখদুম রুপোশ রহমতুল্লাহি আলাইহি দরগা পাড়ার বর্তমান মাজার কমপ্লেক্সে ইহলোক ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন!)।
*কিছু তথ্য:
১। রাজশাহীর দরগা পাড়ায় হজরত শাহ মখদুমের মাজার রয়েছে। রাজশাহী কলেজের পশ্চিম পাশে প্রমত্ত পদ্মার পাড় সংলগ্ন এলাকায় এই পবিত্র দরগা শরীফ বা মাজার রয়েছে।
২। মাজারের একই কম্পাউন্ডে হুজুরের বাহন হিসাবে ব্যবহৃত কুমিরের কবর আছে।
৩। দেউ রাজারা যে স্থানে নরবলি দিত সেই নরবলির স্থানটিও মাজার সংলগ্ন এলাকায় সংরক্ষিত রয়েছে। প্রতি অমাবস্যায় এই মানুষ হত্যা বা নরবলি দেয়া হোত।
৪। যে পুকুরে স্নান করিয়ে মানুষদের বলি দেয়া হোত সেটাও দরগা কম্পাউন্ডে সংরক্ষিত হয়েছে।
৫। নরবলি দেয়ার সময় যে খোলা জায়গায় মানুষজনের সমাগম হোত সেখানে মসজিদ নির্মিত হয়েছে। অর্থাৎ তৎসময়ের মহাকালের তান্ত্রিক দেও রাজাদের অমানবিক অত্যাচারের নমুনাগুলির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজকের রাজশাহীর বিখ্যাত দরগা পাড়ার 'দরগা শরীফ' বা শাহ মখদুমের মাজার।
৬। ঘোড়ামারা এলাকায় দেও রাজাদের সাথে হজরত শাহ মুখদুমের যুদ্ধের সময় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে সে যুদ্ধে ব্যবহৃত অনেক ঘোড়া মারা যায়। এজন্যই এই এলাকার নামকরন করা হয়েছে ঘোড়ামারা।
৭। রাজশাহীর আগের নাম ছিল মহাকাল গড়। পরে রামপুর বোয়ালিয়া মিলিয়ে এর নামকরন হয় রামপুর বোয়ালিয়া। পরে রাজা গনেশের পুত্র যিনি ইসলাম ধর্মে দিক্ষিত হয়ে জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ্ নাম ধারন করে বাংলার শাসক হয়েছিলেন, তিনি হিন্দুদের 'রাজা' এবং পার্শী 'শাহী' এই দুটোকে মিলিয়ে রামপুর বোয়ালিয়ার নাম রাজশাহী রাখেন। ১৪১৮ থেকে ১৪৩৩ খীষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলার সুলতান ছিলেন। পরবর্তীতে রাজা গনেশও মুসলমান হয়েছিলেন বলে আমরা জেনেছি। তারা ব্রাহ্মন ভাদুড়ি বংশের মানুষ ছিলেন।