জালাল উদ্দিন আহমেদ
রাজনীতির তঞ্চকতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ মে,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:০২ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ধ্বনি থেকে শব্দ। শব্দ থেকে বাক্য। আর বাক্যের মধ্যেই রয়েছে কিছু কিছু শ্রুতিমধুর বা শ্রুতিকটু ধ্বনিযুক্ত শব্দ যা বিশেষন আকারে ব্যবহৃত হয়। জানিনা তঞ্চকতার মত এত রূঢ় শব্দ কেন আজকাল রাজনীতির বিশেষনে এত বেশী ব্যবহৃত হয়। তঞ্চকতা শব্দটির মধ্যে একটি কবিয়ালী ভাব রয়েছে। মনে হয় বুদ্ধিদীপ্ত একটি আঁতেলীয় উচ্চারন। কিন্তু এর গূঢ় অর্থটা যখন ভাঙ্গতে চাই তখন গন্ধ ছড়ানো ধ্বনি নি:সৃত শব্দগুলো এর থেকে ডালপালা গজায়। প্রবঞ্চনা, প্রতারনা, ঠগবাজির মত যতসব রূঢ় শ্রতিকটু শব্দের সমাহার, এর চারপাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনীতির মত এত মহৎ এবং পরিশুদ্ধ উঠানের নামে আজকাল এইসব উচ্চারন, তা কি মেনে নেয়া যায়! যুগে যুগে শত সহস্র বছর ধরে এই রাজনীতি, ভূখন্ড ও জনপদে আলোক বর্তিকার মশাল জ্বালিয়ে মানুষকে আলোকিত করেছে। মুক্তির পথ দেখিয়েছে। সাধারন মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার মশিহা হয়েছে। তাদেরকে মুক্ত নি:শ্বাসের অক্সিজেন দিয়েছে। এই রাজনীতি জনপদে জাগরনের মশাল জ্বালিয়ে তাদেরকে মুক্ত নি:শ্বাসে বাঁচার অনুপ্রেরনা জুগিয়েছে। শক্তিশালী জাতি গঠনে সংগঠিত করেছে। রাজনীতির মাধ্যমে দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে ভারসাম্য রক্ষার স্থিতিস্থাপকতা সুদৃঢ় হয়েছে।
তারপরেও তঞ্চকতা! তাইতো দেখা যায়। সৃষ্টির আদিকাল হতে এই অর্থবহ শব্দটি বিশেষন আকারে রাজনীতির পিছু ছাড়তে চায় না। যখন রাজা মহারাজা ছিল, তখনো এই রাজনীতির তঞ্চকতা ছিল। কারন রাজ্য থেকেই রাজার উৎপত্তি। আর রাজা পরিচালিত নীতি থেকেই রাজনীতির উৎপত্তি।এখনকার আধুনিক সমাজবদ্ধতায় রাজা হয়তো নেই কিন্তু শাসক তো রয়েছেন।সেই প্রাচীন বা পরবর্তী মধ্যযুগেও এখনকার মত রাজনীতির এতসব প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি না থাকলেও নৈতিকতা মূল্যবোধ সহমর্মিতা - এসবের কদর ছিল। সেক্ষেত্রে এর বিপরীতার্থক বিষয়টিও ছিল। ছিল বংশ পরম্পরার মা খালা চাচা মামা ইত্যাদি। যাদের প্ররোচনা প্রবঞ্চনা ছিল, ছিল বিরুদ্ধবাদিতাও। রাজদন্ডের দাম্ভিকতা এবং ক্ষমতার দৌর্দন্ড প্রতাপে হয়তোবা সেসবের বিনাশ করা হোত। এখনও হয়তো হয়। তবে সেই ব্রুট্যালিটি সেভাবে প্রকাশিত হয় না। আধুনিকতা ও টেকনোলজির আশীর্বাদে এখনকার দিনের তথাকথিত জবাবদিহির শাসকেরা সেসব দম্ভ ও শক্তিমানতার বিষয়গুলি ভিন্ন অমানবিক উপায়ে সমাধান করেন। তবে নিজেদের শাসন ও শোষনের পথকে মসৃণ করার জন্য তারা যে পথে হাঁটাচলা করেন, সেক্ষেত্রেও সেই তঞ্চকতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। আর এই যে প্রজাতন্ত্র, গনতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রকে আমারা মাতামাতি করি,। এই নামগুলির মধ্যেও রয়েছে তঞ্চকতা নামক সর্ষের ভুত।
জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই 'দুই বিঘা জমি' কবিতার লাইনটির কথা নিশ্চয় সবার মনে থাকার কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবি শিরোমনি হলেও বাস্তবতায় তিনি ছিলেন একজন জমিদার। তারপরেও একজন সার্থক কবির ভূমিকায় তিনি লিখে ফেলেন তাঁর সেই বিখ্যাত 'দুই বিঘা জমি' কবিতাটি। গরীব কিষান উপেনের দুই বিঘা কৃষি জমি জমিদার বাবুর খুব চোখে ধরেছে। তিনি তার বাগান বাড়ি সংলগ্ন এই দুই বিঘা জমি নিয়ে তার বাগানের শ্রীবৃদ্ধি করতে চান। এবং ক্ষমতা ও আইনের আশ্রয় নিয়ে তিনি দু বিঘার মালিক উপেনকে সেখান থেকে বাস্তুচ্যুত করেন। ওদিকে বস্তুচ্যুত উপেন সন্যাসীর বেশে দেশান্তরী হন। সময়ের ব্যবধানে মাটির টানে ফিরে এসে তিনি যখন তার পুরনো জমিনে পা ফেলেন তখন সেই জমিনে লাগানো আম গাছের নীচে পড়ে থাকা দুটি আম কুড়িয়ে হাতে নেন। স্বাভাবিক নিয়মে সেখানকার প্রহরী তা দেখে ফেলে এবং উপেনকে না চিনেই জমিদার বাবুর কাছে বিচারের জন্য ধরে নিয়ে যায়। পরিচয় পাওয়ার পরও জমিদার উপেনকে চোর সব্যস্ত করে ভর্ৎসনা করেন। তখন উপেনের অন্তরের এই বক্তব্যটি দিয়ে কবিতার শেষ আঁচড়টি টানা হয়। 'তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে'। এখানে একজন শাসক জমিদারের রাজনীতির তঞ্চকতায় গরীব প্রজা উপেনের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল দুই বিঘা জমি কেড়ে নেয়ার বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
বহু মত ও পথের বিশ্বাসী মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে সমাজবদ্ধ হয়। সেখানে ধর্মভেদের ভিন্নতা থাকলেও জাতিগত সমাজবদ্ধতায় তারা জোটবদ্ধ থাকে। কিন্তু রাজনীতির তঞ্চকতায় তারা হোঁচট খায়।। তঞ্চকতা নামক রাজনীতির বহুমুখী কুটচালে সমাজ তথা রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে হোঁচট খেয়েছে। কখনো ধর্মান্ধতার ধান্ধায় ফেলে মানুষ ও সমাজে বিভেদের দেয়াল তুলে রাজনীতি সামনে এসেছে। সেক্যুলার বা ধর্ম নিরপেক্ষতার ঝান্ডা উঁচিয়ে অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম লঘিষ্ঠ সম্প্রদায়কে বোকা বানিয়ে যুগে যুগে এক অদ্ভুতুড়ে শাসন ব্যবস্থায় রাজনীতি তার ক্যারিশমেটিক পদযাত্রায় সফল হয়েছে। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের মোড়ল মাত্ববরেরা নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মৈলবাদিত্ব নিজেদের মধ্যে পুষে রেখে তৃতীয় বিশ্বের বিকাশমান অন্য ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে হেয় প্রতিপন্ন করার এমন কোন কুটচাল নেই যা তারা ব্যবহার করেননি। ফলে বর্তমান বিশ্বে চলমান অসহিষ্ণুতা ও যুদ্ধ বিগ্রহের সুত্রপাতে এই রাজনীতির তঞ্চকতাই প্রধান হাতিয়ার হয়ে কাজ করে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। আবার রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি যখন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তখন কোনটা সরকার আর কোনটা রাজনীতি সে গোলক ধাঁধায় জনগন তখন হতবাক হয়ে যায়। আজকাল তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি তঞ্চকতায় থাকতে পছন্দ করে না বলেই হয়তো এরকম ডাইরেক্ট একশ্যানের বিষয়গুলি প্রকাশ্যেই বলবৎ হয়। সেক্ষেত্রে রাজনীতির মাসলম্যান দাদাগিরি রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক আচার আচরনের অংশ হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে সাধারন জনগনের মাথার উপর চাপিয়ে দেয়া সেসব রাজনীতির একতরফা প্রেস্ক্রিপশন তখন না গিলে উপায়ও থাকে না।
আগেই বলেছি রাজিনীতি একটি মহান ব্রত, একটি প্রতিষ্ঠান, জনগনের আশা ভরসার আশ্রয়স্থল। রাজনীতির শুদ্ধাচারে জনপদের বিচরনে শুদ্ধতা, দেশপ্রেম, মমত্ববোধ, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা, নেতৃত্বের বিকাশ এবং মানবিক মূল্যবোধের সূচনা হয়। কিন্তু ইদানীংকার রাজনীতির উঠানে অর্থ যশ প্রতিপত্তি এবং লাঠিয়াল বাহিনীর সমন্বয়ে সজ্জিত মোড়ল মাত্ববরীয় আচরনের যে রমরমা জোশ পরিলক্ষিত হয় তাতে করে 'রাজনীতির তঞ্চকতা' নামের সেই আঁতেলীয় উচ্চারনের আর কোন ঠাঁই আছে বলে মনে হয়না। সেই মধ্যযুগীয় উপেন-জমিদারীয় চিত্রপটের ফ্রেমে বন্দি রাজনীতি এখন ডিজিট্যাল তঞ্চকতার জাট্কা জালের ফ্রেমে পড়ে ছটপট করছে। রাজনীতির তঞ্চকতায় বিশ্বময় যে অমানবিকতার জাল বিছানো হয়েছে তার ছোট ছোট নমুনাই আজ বিশ্ব নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। একটি ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বার রাষ্ট্র বানিয়ে অন্য বৃহৎ জনবেষ্টিত জাতিস্বত্ত্বার কয়েকটি রাষ্ট্রের বুকে বসিয়ে যেভাবে তাদেরকে নরহত্যার ওজিএল (open general licence) দেয়া হয় সেটাকে রাজনীতির তঞ্চকতা না দাদাগিরি বলবো তা মাথায় আসেনা। আবার উপমহাদেশের স্বাতন্ত্র রক্ষাকারী জনপদের একটি রাজ্যের অধিকার নিতে যেভাবে দুটি প্রতিবেশী দেশ তাদের ধন জ্ঞান ও শক্তির অপচয়ে প্রায় পৌঁনে এক'শ বছর ধরে লক্ষ কোটি ডলার অপচয় করে চলেছে সেটা রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতির কোন্ তঞ্চকতায় তাদের মূল ভূখন্ডের মানুষকে বঞ্চিত করছে সেটাই মাথায় আসেনা। ইদানীং ইউরোপের দুটি দেশের ঝগড়া ফ্যাসাদের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দশ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করা বর্তমান সময়ের বিশ্ব মোড়ল একটি পক্ষকে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র ও সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে তার মূল ভূখন্ডের কোন্ উপকারে আনতে চায় সেটাও বোধগম্যে আসে না। আবার ন্যাটো নাফটা কোয়াড স্ট্র্যাটিজি ইত্যাদি করে গোটা ব্রভান্ডের জনপদে কোন্ রাজনীতির বাঁদর নাচনের ডুগডুগি বাজানো হচ্ছে - সেটাও অযুত সহস্র প্রশ্নের জন্ম দেয়।
প্রথম মহাযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর শৌর্য বীর্যের মধ্যযুগ পরবর্তী নিজেদের ঝালিয়ে নেয়ার সময়। অর্থাৎ মধ্যযুগীয় বীরত্ব ও শক্তিমত্তায় নিজেদের অবস্থানের পরীক্ষা করে নেয়া। তবে এই মহাসমরে পৃথিবী বেষ্টিত জাতি ও রাষ্ট্র সমূহ তাদের জাতীয়তাবোধ এবং স্বকীয়তার আপন স্বত্ত্বায় নড়েচড়ে বসে। ভূখন্ডের সার্বভৌমত্বে উত্তর দক্ষিন পুর্ব পশ্চিমের সবাই সজাগ হয়ে উঠে। রাজনীতির সামঞ্জস্যতায় নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি কোন হতে আওয়াজ উঠে। তারই ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক চেতনার ফসল হিসাবে লীগ অব নেশনের ধারনা সামনে আসে। রাজনৈতিক সদিচ্ছায় ভূমন্ডলের জাতি ও রাষ্ট্র সমূহ লীগ অব নেশনস এর পত্তন ঘটায়। আধুনিক যুগ সূচনাপর্বে রাজনীতির তঞ্চকতায় জাতীয়তাবোধের উড়নচন্ডী আচরন মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। জাতীয়তাবাদ ও বোধের অহংবোধে শাসকেরা রাজনীতিকে হাতিয়ার করে বিশ্বময় এক শৈরতান্ত্রিক আচরনে প্রবৃত্ত হন। ফলে দেশে দেশে চলমান রাজতন্ত্র ও গনতন্ত্রের নামধারী শৈর শাসকেরা আগ্রাসী মনোভাবের অহংবোধে যুদ্ধবিগ্রহ ও কলহে লিপ্ত হতে শুরু করে। একসময় অবশম্ভাবী সেই বিভীষিকার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সুত্রপাত হয়। সেখানেও রাজনীতি ছিল। ছিল প্রতারনার ফাঁদ পেতে পক্ষ বিপক্ষের ঘায়েল হওয়ার দৃশ্যপট।
এক সময় যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু থেকে যায় কৌটিল্যের রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি ও অন্যান্য জীবনবোধের জটিল সব সমীকরন। নইলে কোন সমীকরনে গনতন্ত্রের অনুশীলনে বিচরন করা একটি ধনবাদী শক্তি সমাজতন্ত্রের কট্টর অনুশীলনে অবস্থান করা অন্য একটি শক্তির কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একদল শৈর শাসককে পরাভূত করে! হয়েছিলও তাই। ধনবাদী বেনিয়া শক্তি তার হাত প্রসারিত করে রাজনীতির সর্বোচ্চ পাশা খেলায় ইউরোপের ধনবাদীদের এক ছাতার নীচে ফেলে 'ন্যাটো' নামের একটি সামরিক প্ল্যাটফরম গড়ে তোলে। যদিও সমাজবাদী ঠাকুরটি তাদের দেখাদেখি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অন্য একটি পাল্টা সামরিক জোট 'ওয়ারস' সৃষ্টি করে। কিন্তু ধনবাদী সামন্ত তন্ত্রীদের জোশ ও চাকচিক্যের মোহময়তায় শামুকের আচরনে চলাফেরা করা সেই সমাজতন্ত্রী জোট একসময় ভেঙ্গে যায়। এখানেও রাজনীতি তার চানক্যীয় পাশার চালে প্রতিপক্ষকে নির্জীব করার কৌশল নেয়া হয়। এখনকার সময়ে বিশ্বময় যাকিছু চলছে তা নি:সন্দেহে রাজনীতির ধুরন্ধুর কুটচাল বা তঞ্চকতার সর্বোচ্চ অনুশীলন। তবে শক্তি ও অর্থবিত্ত নতুন পক্ষ হওয়ায় বিশ্বময় চলছে একটি একপক্ষীয় মোড়ল মাত্ববরীয় লম্ফঝম্ফ। ফলে অর্থবিত্ত ও শক্তির কাছে শরণার্থী হয়ে রাজনীতি এখন তার আপন স্বকীয়তার ঠিকুজি খোঁজায় ব্যস্ত রয়েছে। আর অর্থ-বিত্ত ও শক্তির জোশে বলীয়ান শক্তিমানরা তঞ্চকতার ঠিকাদার হয়ে রাষ্ট্রনীতি অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে দেশে দেশে ফেরি করে বেড়াচ্ছে।