জালাল উদ্দিন আহমেদ
আত্মিক উন্নয়ন কতটুকু
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ মে,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৭:০৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
উন্নয়ন উন্নতি সবই তো হচ্ছে। যখন মাটি খুঁড়ে ইট গাঁথলাম, সেটাও ছিল উন্নয়ন। ইটের চালে টিন লাগালাম, টিন সরিয়ে ছাদ ঢালাই করে শক্তপোক্ত পাকা বাড়ির মালিক হলাম-সেটাও উন্নয়ন। কাঁচা রাস্তায় সুরকি ফেলে রাস্তা থেকে কাদা হটালাম-সেটাও উন্নয়ন। উন্নয়নের এই সাতকাহনে কি করিনি আমরা যা বলে পাতা ভরা যাবে না! ব্যক্তি উন্নয়ন, গোষ্ঠী উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, শিল্প, সাহিত্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শক্তি, সৈন্দর্য এবং অর্থ - কোন্ খাতে আমরা এগোয় নি! কিন্তু এগোনোর একটা তরিকা আছে। সেই তরিকার পথ তৈরী ক'রে কি আমরা এগিয়েছি? না এগিয়ে যেতে যেতে আমরা আমাদের চলার পথকে 'ভস্কা বেগুনে' পরিণত করেছি। সর্বক্ষেত্রেই আমাদের উন্নয়ন ঘটেছে। গ্রাম বাংলায় বেশ প্রচলিত একটি প্রবাদের কথা বেশ মনে পড়ে। অবশ্য এই লেখাটি লিখতে বসার পরেই এই কাহনটা হঠাৎ করেই মনে এসে গেল। কারন অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকিয়ে যায় এর অবস্থানে থেকে কোন্ উন্নয়নের সুচারু বিন্যাসে আমি অবগাহন করছি সেটাই তো মাথায় আসছে না। যে উন্নয়নের জোয়ারে আমরা ভেসে চলেছি, তাতে করে সেই ভাসমানতার আপেক্ষিকতাও যে একসময় ম্লান হয়ে উদ্বায়ুর আকার ধারন করবে তা অনুমান করেই বলা যায়।
যেটা নিয়ে আমার মস্তিক প্রদাহ বা মেনিনজাইটিসের দপদপানি মাঝে মাঝেই চড়ে বসে সেটার একমাত্র উপলক্ষ হচ্ছে চারিদিকে ঘটে যাওয়া এতসব উন্নয়নের ফুলঝুরি! হাঁ, ফুলঝুরিই তো! এখানে ফুলঝুরির কথাটি প্রায়োগিকভাবে যুতসই বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। ফুলঝুরি বলতে সেই ছোটবেলার বিয়ে-সাদি বা আকিকা কিংবা সুন্নতে খাৎনার অনুষ্ঠানে যেসব তুবড়ি ফুটানো হোত কিংবা ছোট বাচ্চাদের হাতে তারাবাতি জ্বালিয়ে আলোর ঝলমলানি সৃষ্টি করা হোত- সেটাকেই বুঝাতে চেয়েছি। আমাদের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলতে গেলে ওইসব আমুদের ক্ষণস্থায়ী উজ্জ্বলতার কথাগুলোই মুখে চলে আসে। কিসের উন্নয়ন হয়নি আমাদের! রাষ্ট্রের, সমাজের, রাজনীতির, গণতন্ত্রের, দেশের সাধারণ মানুষের! সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের ছড়াছড়ি। স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরে আমরা বাইশ জন রাষ্ট্রপতি পেয়েছি, চৌদ্দ জন প্রধান মন্ত্রী বা সরকার প্রধান আমাদের নেতৃত্ত্বের আসন অলংকৃত করেছেন। সেই হিসাবে কমবেশী শ' সাতেক মন্ত্রী - বাঙালী পেয়েছে। আর জনপ্রতিনিধির সর্বোচ্চ আসন অলংকৃত করেছেন মোটামুটি পাঁচ হাজারের মত। তাছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের বড় ছোট মিলিয়ে হাজার পঞ্চাশেক জনপ্রতিনিধি আমাদের এই ক্ষুদ্র ভূখন্ডের ক্ষমতার দন্ডটি নিয়ে চলাফেরা করেছেন। আর প্রশাসনের সচিব চেয়ারম্যান ডিজি ইত্যাদিসহ সর্বোচ্চ শিখরের প্রশাসক না হলেও লাখ ছুঁই ছুঁই। আছেন আইন শৃংখলার জেনারেলস আইজি সাইজের উচ্চপদের হাজার খানেক বাঙালী আদম। আইনের মহারথীরাও তো কম নন। পঞ্চাশ বছরের এই হিসাবে ইঞ্জিনিয়ার ও পেশাজীবিদের এক বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে যারা রাষ্ট্র পরিচালিত খাজাঞ্চিখানা থেকেই তাদের রুটি রুজির পরিমাপ করেন।
এ'তো গেল রাষ্টের মাপ জোকে পরিচালিত এক পরিপুষ্ট এবং বলিষ্ঠ নেটওয়ার্কের চোখে দেখা হিসাব। সীমানা বেষ্টিত রাষ্ট্রে থাকে সামাজিক নেটওয়ার্ক, সাংস্কৃতিক বলয়, শিল্প বাণিজ্যের মহা আয়োজন এবং স্বাস্থ্য শিক্ষাসহ আরো সব বিশাল বিশাল কর্মযজ্ঞ। উন্নয়নের সূচকে সমাজ রাষ্ট্র তার সার্বিক কর্মযজ্ঞ নিয়ে খাতা খোলে। সেখানে বস্তু জগতের চোখ ধাঁধানো উন্নয়নের জোয়ার ছুটিয়ে ঘোড়া দাবড়িয়ে লাভ হবে কি, যদি সেখানে ঘোড়ার জিন বা লাগাম ধরার কোন যোগ্য সহিস না থাকে? তারপরেও তো লাউড স্পীকারের উচ্চ ভলিউমে চিৎকার করে বলতে শুনা যাবে - এতসব কাঁড়ি কাঁড়ি উন্নয়নের পরও কি চোখে পড়ে না! কি নেই! চারিদিকে আলোর ঝলক। চব্বিশ ঘন্টা ঘরে বাতি জ্বলছে(যদিও ইদানীং ঘন্টা ধরে রেশনিং করা হয়)। পদ্মা হোল। এলিভেটর হচ্ছে। পায়রা হোল বলে। রামপাল হচ্ছে। কর্ণফুলি টানেল হচ্ছে। রূপপুর হচ্ছে। মাথার উপর আঁকাবাঁকা ফ্লাই ওভারে ঢাকায় চলাচলের গলিপথে কতই না চমক। মেট্টো দিলাম। বড় বড় ইমারত ইউরোপ আমেরিকা স্টাইলে। স্কাই স্ক্রাপারের খোলা ছাদে বউ বাচ্চা নিয়ে বাঙালী ডিনারে যায়। হেলিকপ্টারের এয়ার এম্বুলেন্স সুবধা নিয়ে ব্যংকক সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। দেখাও সবাইকে তোমাদের হাতির ঝিলের সিঙ্গাপুরীয় ঝলক। দোড়াও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে। হাতে হাতে স্মার্টফোন। বোতাম টিপলেই হাতের মুঠোই সবকিছু। ঘরে বসে বাচ্চারা ক্লাস করছে। অনলাইনে ঘরে বসে যা ইচ্ছা তাই কিনতে পারছো। এমনকি ঘরে বসে অফিস আদালতও তোমরা করতে পারছো। আর কি চাও বাঙালী! ঘরে বসে বোতাম টিপেই বিল দিচ্ছ। গ্রামের বাড়িতে বোতাম টিপে টাকা পাঠাতে পারছো। বোতাম টিপে বাবা-মায়ের সাথে ভিডিও করে কথা বলছো। তোমাদের জীবনটাইতো ডিজিট্যালাইজড করে দেয়া হয়েছে। জীবনে চলার গলিপথে আর কি চাই? চার বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাপিয়ে দেশে একশোর বেশী বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছড়াছড়ি, জেলায় জেলায় মেডিক্যাল, টেকনিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। শিক্ষা স্বাস্থ্য আজ বাংলার দোরে দোরে। আর কত কি করলে বাঙালীর মন ভরবে, বলা যাবে কি?
এত কিছু হওয়ার পর বাঙালী তথা ভূখন্ডের মানুষ স্বস্তিতে আছে কি? রাষ্ট্র কাঠামোর সার্বভৌমত্ব, রাজনীতির স্বচ্ছ ও শুদ্ধ আচরণ, স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা, আইনের স্বচ্ছতা ও প্রয়োগ, শিক্ষার বাস্তবতা, স্বাস্থ্য খাতের দৈনদশা, কৃষিপন্য বিপনন, সড়ক পথ, জলপথ, নদী ভাঙ্গন থেকে শুরু করে বাংলার জনপদের কোনো উঠানে স্বস্তি ও স্বচ্ছতা আছে - বলা যাবে কি? চাওয়ার কি আর শেষ আছে! বাড়ি চাই, গাড়ি চাই, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাই। ভাল চাকুরী চাই। নিরাপদে ব্যবসা করতে চাই। ছেলে মেয়েদের শিক্ষা চাই। সামাজিক নিরাপত্তা চাই। স্বাস্থ্য সেবার গ্যারান্টি চাই। মূল্য বৃদ্ধির লাগাম চাই। ভেজাল মুক্ত খাদ্য চাই। নিরাপদ সড়ক চাই। দুর্নীতি মুক্ত সমাজ চাই। ঘুষ মুক্ত প্রশাসন চাই। আমাদের মত বুড়োদের সামাজিক নিরাপত্তা চাই। এই চাহিদার ফর্দ কিন্তু অনেক লম্বা। না চাওয়ার ফর্দটাও বেশ লম্বা। সমাজ সংসারে স্বেচ্ছ্বাচারিতা চাই না। প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর পরিসরে যেভাবে রাজনীতির দাদাগিরি চলছে তার অবসান চাই। পাড়া মহল্লা ও প্রত্যন্ত গ্রাম্য পরিবেশে তরুন টিন এজারদের কলুষিত রাজনীতির পাঠ বন্ধ করে সমাজবদ্ধতার আবহ তৈরীর পরিবেশ চাই। রাজনীতির দৈন্যতা ও অসহিষ্ণুতার ফেরে সৃষ্ট রাস্তার মাওয়ালী কালু মালুদের ম্যাসলম্যান দাদাগিরির হাতকে কাজে লাগিয়ে সমাজকে যেভাবে তাদের হাতে তুলে দিয়ে কলুষিত করা হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হবে। দেশের কলুষিত রাজনীতির আঁচলে ওদের স্বাচ্ছন্দ বিচরণে আজ জনপদে চলছে নীরব আহাজারি ও হতাশা। এক সময় ওরাই এমপি মন্ত্রী হয়ে আমাদের মাথার উপর ছড়ি ঘোরান। ওদের সার্টিফিকেট নিয়ে আমাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। রাজনীতির কলুষিত অনুশীলনে ওরাই আজ সমাজপতি, সমাজের নিয়ন্তা। এদের দাপটে আজ বাংলার আবহমান সমাজের নৈতিক স্খলন চরম পর্যায়ে নেমে এসেছে। গ্রাম বাংলার নৈতিক আবহে পুষ্ট বংশ পরম্পরা ও গন্যমান্য মুরুব্বী ও শিক্ষক সমাজের সম্মানীয় স্থান আজ মরিচিকায় পরিণত হয়েছে। শহর নগর বন্দর গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র একই আহাজারি। উঠতি মাসলম্যান দাদাগিরিতে রাজনীতি সয়লাব হয়ে গেছে। সেখানে নীতি ও নৈতিকতা বলে কিছু নেই। সর্বক্ষেত্রে শুধু ক্ষমতার দাপট, দখলদারি আর সরকারী সম্পদের নয় ছয়।
রাজনীতির মোড়কে চাপিয়ে দেয়া এসব সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলার আবাহমান শুদ্ধতার চিরায়িত কৃষ্টি কালচার বাংলায় ফিরিয়ে আনতে হবে। উন্নয়নের ঝলমলে জৌলুষে না থেকে গ্রাম বাংলার বুনিয়াদি উৎকর্ষতা বাড়ানোর মানসিকতায় এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ সংসারের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ মেরামতে হাত লাগাতে হবে। মানুষের মুখের অন্ন যোগানে কৃষি ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন এবং তার উৎপাদনশীলতা পরবর্তী সরবরাহ ও মূল্য সংযোজনে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ফ্রেমকে মজবুত করে সাজাতে হবে। শিক্ষার সামঞ্জস্যতা আনয়নে দেশে একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বাস্তবতা ও প্রায়োগিক বিচরনে জোর দিতে হবে। ঢালাও উচ্চশিক্ষার গড্ডলিকায় লাগাম দিতে হবে। যে উচ্চশিক্ষা নিয়ে উন্নত বিশ্বে গিয়ে স্নাতক পর্যায়ের অনুমোদনও মিলে না সে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর নতুন করে ভাবতে হবে। বাচ্চাদের মানবিক ও দৈহিক শ্রী বর্ধনে খেলাধুলাকে অগ্রাধিকারে নিয়ে স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলা বাধ্যতামুলক করতে হবে। মাদকাসক্তির ছোবল থেকে কিশোর ও যুব সমাজকে ফিরিয়ে আনতে হলে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে খেলাধুলা বাধ্যতা মুলক করা প্রয়োজন। ছাত্র রাজনীতিতে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া রাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। সরকারী অফিস আদালতে রাজনীতির প্রকাশ্য মেরুকরন বন্ধ করতে হবে। রাজনীতির দুর্বল ও অস্বচ্ছ আচরনে আজ সমাজ, প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের প্রতিটি আঙ্গিনায় রাজনীতির উলঙ্গ বিচরন। ফলে বহুমত ও পথের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চর্চায় দেশ তার চলার পথে প্রতিটি পদে হোঁচট খাচ্ছে।
বাঙালীর মুক্তির সংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। মেহনতি মানুষের ভাত কাপড়ের সংগ্রাম–একটি চলমান প্রক্রিয়া । এক সময় বাইশ পরিবারের সমন্বয়ে গড়ে তোলা পাকিস্থানের চকমকে উন্নয়ন গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সেই উন্নয়নের ভরন-পোষন করতে গিয়ে আজ পাকিস্থানের বুনিয়াদ ফোকলা হয়ে পড়েছে। আমরা সে পথে হাঁটছি কিনা তা ভেবে দেখতে হবে। মোটকথা বাঙালীর বুনিয়াদ বিনির্মানের শেকড়ে হাত লাগাতে হবে। উন্নয়ন নামক সাতকাহনের কবিতায় মাজন লাগিয়ে মানুষের মন ও মননশীলতার উন্নয়নের দিকে নজর দিতে হবে। আত্মিক উন্নয়ন না হলে বাহ্যিক উন্নয়নের বহমানতা থমকে যাবে। সেজন্যই হয়তো বাংলার সেই চিরায়ত বহুল প্রচলিত প্রবাদটিই আমার এই নিবন্ধের শেষ কথা হয়ে উঠে আসে। 'উপরে চিকন চাকন ভিতরে ভস্কা বেগুন'। জানিনা গ্রাম্য কাহাবতের এই রূঢ় উচ্চারণটির উৎস কোথায়। সেক্ষেত্রে বাংলার বর্তমান উন্নয়নের সাথে এর সাজুয্য কি উড়িয়ে দেয়া যায়!