জালাল উদ্দিন আহমেদ
স্ট্র্যাটিজি নামের কৌশলপত্র
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ মে,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৪১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কিসের কৌশলপত্র! মরার না মারার, না বেঁচে থাকার! কথায় আছে না, 'নিজে পায় না ভাত শংকরাকে ডাক'। আমরা আমজনতা সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ। 'ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র চিবিয়ে খাব'র অপামর সাধারন জনগন। সুতরাং 'ব্রিকস', 'কোয়াড' কিংবা হাল আমলের 'আইপিএস' - এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমাদের থাকার কথা নয়। আইপিএস অর্থাৎ ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটিজি। কি গালভরা নাম। বিবিএস(বে অফ বেঙ্গল স্ট্র্যাটিজি) কি ঠিক করতে পেরেছি? সার্ক? যখন স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে মুক্ত নি:শ্বাসে শ্বাস নিতে চাইলাম তখন ভারত এবং রাশিয়ার সাথে কি সব চুক্তি ইত্যাদি হোল। দেশে হৈ চৈ বাঁধল। গোলামী চুক্তি, দেশ বিক্রির চুক্তি - কতসব গালভরা বুলি আউড়িয়ে রাজপথ গরম করা মিটিং মিছিল কিংবা পত্রিকায় জ্ঞানগর্ভ কালির আঁচড়। কিন্তু আজকে স্বাধীনতার বাহান্ন বছর পেরিয়েও তো আমরা আমরাই আছি। আমাদেরটা আমাদেরকেই করতে হচ্ছে। সেই দুর্ভিক্ষ, সেই রক্ষীবাহিনী, সেই মহান স্থপতির নৃশংস হত্যাকান্ড, সামরিক শাসন, মুক্তিযুদ্ধের মহান সেনানায়ক ও সফল রাষ্ট্রপতির হত্যা পরবর্তী শত্রু পক্ষীয় ঘরানার দেশ শাসন, গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গন অভ্যুত্থান, গনতান্ত্রিক আদলের পারিবারিক পরম্পরার রাজনীতি এবং অবশেষে একদলীয় আদলে পারিবারিক আবহের তথাকথিত গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার চলন বলন। এটাই তো আমরা! আমরা তো আমরাই আছি। বিঘায় পাঁচ মন ধান উৎপাদনের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা এখন বিঘায় পঞ্চাশ মন ধান উৎপাদন করছি। জমিন প্রাপ্যতার স্বল্পতার কাছে হার না মেনে আমরা খাল বিল জলাশয়ে কচুরিপনা ভাসিয়ে শাক সবজি উৎপাদনে পারঙ্গমতা দেখাচ্ছি। হার না মানা জাতি আমরা। জনশক্তির এক কোটির উপর বাঙালী এখন পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে দেশের জন্য বয়ে আনছেন সমৃদ্ধির বৈদেশিক মুদ্রা। জেন্ডার ইস্যুর বিভাজন পিছনে ফেলে আমরা দেশের শিল্পায়নে চুড়ি পরা নারীর হাতকে কর্মীর হাতে পরিনত করে রপ্তানী বাণিজ্যে আকাশ ছোঁয়া সাফল্য এনেছি।
আমাদের এই সাফল্য গাঁথায় অনুপ্রেরনা আছে। আছে বাঙালী হয়ে বেঁচে থাকার ঝুড়িভর্তি সাফল্যগাঁথা। আমাদের মত আছে পথ আছে। কিন্তু একটি বিন্দুতে মিলিত হওয়ার মোহনা বড় ভঙ্গুর আমাদের। একত্রিত হওয়ার মন ও মাসসিকতার বড় অভাব আমাদের। রাজনীতির দুর্বৃত্যায়নই আজকের এই নাকাল অবস্থার জন্য দায়ী। রাজনীতি তার প্রকৃত চরিত্রে নেই বলেই আমাদের যত অনৈক্য, অসহযোগ। হিংসা বিদ্বেষ অসহিষ্ণুতা সন্দেহ অবিশ্বাস আজকের দিনে রাজনীতির প্রধান চর্চা। রাজনীতির দুর্বিনীত মহা পক্ষরাই আজকের দিনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সামনের সারিগুলো দখল করে রয়েছেন। নিজস্ব রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বা কারিশমা যত না তাদেরকে সামনের সারিতে জায়গায় দিয়েছে তার চেয়ে রাজনীতির পূর্ব পুরুষদের সাফল্যগাঁথা ও অর্জনই তাদের রুটি রূজির পাকা বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। রাজনীতির মত ও পথ ভিন্ন হতে পারে কিন্তু দেশীয় স্বার্থের অভিন্নতা সার্বজনীন হতে হবে। এটাই বেদবাক্য। কিন্তু তা হয় না দুর্ভাগা এ দেশে! ক্ষমতার দন্ডটিকে টিকিয়ে রাখা এবং মজবুত করার লক্ষ্যে হেন অপকর্ম নেই যা ক্ষমতাসীনেরা করতে পিছপা হন।
যে ব্রিকস কোয়াড বা হাল আমলের আইপিএস নিয়ে কলম ধরেছি তার বিন্দুমাত্র জ্ঞান গরিমা আমার কি আছে? তবে ওই যে বাতিক। বাঙালীর সব জায়গায়তেই পা ফেলতে হয়। সবকিছুতেই আঙ্গুল দিতে হয়, নাক গলানো লাগে। নইলে পুর্নতা আসেনা যে! তবে যারা জানেন তারা তো সব বড় বড় দিগগজ মহারথীর দল। তাদের পেটে তো আর আমাদের মত পান্তা ভাত আর কাঁচা মরিচের সাথে লবন মিশ্রিত গড়গড়ানী ঢেকুর তোলা মেটিরিয়াল থাকেনা। তাই তাদের বাক্য ব্যায়ের সেসব উচ্চ মার্গের বয়ান সাধারন আম জনতা বুঝতে পারেনা। সেক্ষেত্রে আমাদের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরজ আলিরাই আমজনতার ভরসা। তবে হাঁ, কোন এক নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম - দেশ যখন রাম রহিম চ্যাং ও জনদের চতুর্মুখী আলোছায়ার অম্ল-মধুর ছোবলের নাভিশ্বাসে, তখন আমরা একমুখী কীর্তন গেয়ে নিজেদেরকে চাঙ্গা রাখার চেষ্টায় প্রাণাতিপাত করছি। আসলেই তো তাই। বছর বিশেক আগে কোন এক 'নাফটা' নামক আমারিকান চুক্তি ইত্যাদি নিয়ে দেশে বেশ শোর উঠেছিল। এক যুগ আগে 'ব্রিকস' নামক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ সমূহের এক সংঘ গড়ে উঠে । আস্তে ধীরে সেটার পরিধি পাঁচ থেকে বাইশে পৌঁছেছে। আমরাও সেখানে আছি। অতি সম্প্রতি কোয়াড নাম দিয়ে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার এক ইন্দো প্যাসিফিক প্রতিরক্ষা জোট গঠন হয়েছে। জাপান অস্ট্রেলিয়া ভারত আমেরিকা সমন্বয়ে এই সামরিক জোটে বাংলাদেশকে যোগ দেয়ার ত্রিমুখী চাপ রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পার্টনার চিনকে অগ্রাহ্য করে এই ক্লাবে যোগ দিতে গড়িমসি করেছে। কারন এই কোয়াড হচ্ছে এমন এক সামরিক জোট যা চিন ও উত্তর কোরিয়াকে মোকাবিলা বা জব্দ করার সামরিক ফ্রন্ট হিসাবে গন্য করা হয়। সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় সহযোগী চীনের বিরুদ্ধে সামরিক জোটে যোগদান-বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতীই বটে। এভাবেই যুগে যুগে মোড়ল মাত্ববরীর এই ভূমন্ডলে আমেরিকা নামক বড় মোড়লটির বিভিন্ন স্ট্রাটিজি বা ফাঁদ পাতার কার্যক্রম নিরলস ভাবে এগিয়ে চলেছে।
ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটিজি সে ধরনের কোন সংস্করন কিনা তা আমরা জানি না।! জানিনা দূরবর্তী কোন মোড়লের কথামত বা তার চলন বলনের সাঞ্জস্যতায় থেকে নিজেদের আঞ্চলিক সহযোগিতার কৌশল পত্র তৈরী করে স্বতন্ত্র একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের কি ফায়দা হয় বা হবে! তাছাড়া কোন্ সহযোগিতা বা সহমর্মিতায় এখন আমাদের অবস্থান তা উপরওয়ালাই ভাল জানেন। ক্ষুদ্র পরিসরের দক্ষিন এশীয় সামান্য সাতটি দেশের "সার্ক" নিয়েই আমরা কি কোন স্ট্র্যাটিজিতে পৌঁছাতে পেরেছি? সেক্ষেত্রে বড় বড় স্ট্র্যাটিজি নিয়ে আমরা কোন তিমিরে হাবুডুবু খাব সেটা অন্তর্যামীই জানেন। প্রতিবেশী দেশ সমূহের দ্বিমুখী বৈরিতায় কোন সুবিধাজনক পজিশনে আছি কি আমরা? একদিকে বুদ্ধিষ্ট গরিষ্ঠ দেশটির বর্বরতার অমানবিক আচরনে তাদের সংখ্যালঘু জনতার শরণার্থীয় চাপে আমরা এখন নাভিশ্বাসে আছি। অন্যদিকে খাতা কলমের অকৃত্রিম বন্ধুর(!) অসম ও সন্দেহজনক আচরনের শিকারে আমরা আস্তেধীরে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে পড়ছি। বন্ধুর লেবাস পরিধান করে তারা আমাদের চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈরিতার প্রমান দিচ্ছে। স্থল সীমান্তে তাদের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রতিবেশী নিরীহ বাঙালীদের বিনা উস্কানীতে অহরহ গুলি করে হত্যা করছে। অসম বাণিজ্য ঘাটতি ও ট্রানজিটের দেদার সুবিধা ভোগের পরও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির জন্য সামান্যতম উদার মনোভাবে চরম দৈনতা নিয়ে তাদের নিত্য চলাচল। শোনা যায় 'নিলাম ওয়ালা ছ'আনা'র হিসাবে উন্মুক্ত ট্র্যানজিট সুবিধা দিয়ে যখন আমরা নেপাল ভুটানের সঙ্গে বাণিজ্য সংযোগের ট্র্যানজিট পেতে চাচ্ছি তখন দাদাগিরির সেই সৎ প্রতিবেশীর হাজারো ফ্যাকড়ায় আমাদের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে। এছাড়াও ধর্মীয় সহিংসতার চরমতম বৈরিতা নিয়ে অকৃত্রিম বন্ধুর সাথে 'সৎ প্রতিবেশীর ডিকশনারী'তে অবস্থান করছি আমরা।
রাম রহিম চ্যাং জনদের মধ্যে বাকী যে রহিম ও জন নামক দুটি পক্ষ থাকলো তার মধ্যে রহিম ভাইদের কথাও তো বলতে হয়। তাদের ঘরানায় আমাদের বিচরন আত্মিক ও আর্থিক। পেট্রো ডলারের ওআইসির ক্লাবে আমাদের বিচরন অনস্বীকার্য। সেখানেও তো আমরা ক'রে কম্মে খাই। সুতরাং এই রহিম গ্রুপের উপস্থিতি আমাদের জীবনবোধের একটি উপলক্ষও বটে। আসি জন সাহেবদের কথায়। বর্তমান বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় জন টমদের উপস্থিতি আমাদের জীবন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রেই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা যায় বিশ্ব বাণিজ্যের মুক্ত বাজার অর্থনীতির গোলক ধাঁধায় বিশ্ব এখন একটি গ্লোব্যাল ভিলেজে পরিনত হয়েছে।প্রয়োজনের অপরিহার্যতায় বিশ্বের দেশ ও জাতি সমূহ একে অপরের পরিপুরক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেক্ষেত্রে দলাদলি বা খবরদারির জোট ইত্যাদি না করে প্রত্যেকেই নিজেদের আপন অস্তিত্বের সম্মানজনক স্ট্র্যাটিজি বা কৌশলপত্র নিয়ে এগিয়ে যাবে - সেটাই প্রণিধানযোগ্য হওয়া উচিত।
এক্ষেত্রে সমস্যা কিছুটা রয়েছে বলেই হয়তো এই স্ট্র্যাটিজিক ভুলগুলো দুর্বিনীতি আহাজারি হয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতি স্বত্ত্বাকে যুগে যুগে অহর্নিশি দংশন করেই চলেছে। সে ভুল জাতি গঠনে হতে পারে। সরকার গঠনে হতে পারে। হতে পারে সেইসব দেশ সমূহের সরকারের অগনতান্ত্রিক আচরনের কারনে। রাজনীতির গনতন্ত্রায়নে অটোক্র্যাটিক আচরনের ফলেও সরকারে এসব অপকৌশল গ্রহনের প্রবনতা দেখা যায়। আবার দেশ পরিচালনার একনায়ক তান্ত্রিক আচরনের দুর্বলতা আড়াল করতে এইসব কৈশলপত্র নিয়ে রাষ্ট্রকে ভাবতে হয়। এসবের সুযোগ নিয়েই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৃষ্টি হয় মোড়ল মাত্ববরীয় বিভিন্ন চোখ ধাঁধানো জোট গঠনের মহা এন্তেজাম। জোট নিরপেক্ষতায় অঙ্গীকারাবদ্ধ বাংলাদেশ তার আপন অস্মিতার আলোক ছটায় কতদূর হাঁটতে পারে সেটাই আজকের দিনের অযুত সহস্র প্রশ্ন।