জালাল উদ্দিন আহমেদ
তারুন্যের স্মৃতি এখন নবান্নে
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৫ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৫৬ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
এইতো সেদিন। গত শতাব্দীর একাত্তর বাহাত্তরের সময় ছিল সেটা। মানুষ নক্সালী আন্দোলনের নামে মাওবাদী অতি বিপ্লবীদের উৎপাতে নাকাল অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। পাশাপাশি নক্সাল দমনের নামে ভারতীয় কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআরপির তান্ডবে সাধারন জনপদে নাকানি চুবানি খাচ্ছে। কৈশরের স্মৃতি চোখের সামনে সব জ্বলজ্বল করে ভাসছে।
বলছি ভারতীয় পশ্চিম বঙ্গের সেই সত্তর বাহাত্তরের নক্সাল আন্দোলন ও তার দমন প্রক্রিয়ায় ভারতীয় কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীর তান্ডব প্রসঙ্গে। বাহাত্তরে তখন আমি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত রামপুরহাট কলেজের ছাত্র। সময়টা বেশ অনিশ্চয়তা ও উৎকণ্ঠা নিয়েই কাটত আমাদের। তবে সর্বভারতীয় আঙ্গিকে সেসময় এক বাঙালী তরুনের ধুমকেতুর মত উদয় হয়েছিল। বৃহত্তর দিনাজপুরের চিরির বন্দরে জন্ম নেয়া সেই বাঙাল ছেলিটির হাতে তখন সর্বভারতীয় তরুন ও যুব সমাজের ব্যাটন। তার নেতৃত্বে কংগ্রেসীয় ছাত্র সংগঠন অর্থাৎ ছাত্র পরিষদ বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। প্রিয়'দা আর্থাৎ প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি তখন ছাত্র পরিষদসহ যুব কংগ্রেসের সর্ব ভারতীয় আইকন। সে সময় সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে একঝাঁক তরুন বাঙালীর নেতৃত্বে ভারতীয় কংগ্রেসের তরুন ও যুব শাখার বেশ রমরমা অবস্থা।
সম্ভবত: বাহাত্তরের জুন জুলাইয়ের দিকে আমার ইউনিভার্সিটি এন্ট্রাস ফাইনাল পরীক্ষা। তার আগে শেষের দিকে কিছু এক্সট্রা ক্লাস করার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেদিন কেমিস্ট্রির ক্লাসে পাঠ নিচ্ছিলাম মাদ্রাজী এক প্রফেসরের কাছে (নামটা বেশ বড় তাই সঠিকভাবে মনে করতে পারছিনা)। স্যার 'আইসোটোপের' উপর ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি বাংলা জানেন না এবং বুঝেনও না। যথারীতি ইংরাজীতে তার কভারশেসন চলছে। এমন সময় শ্লোগান মুখর মিছিল সহকারে আশীষ'দার আগমন। ক্লাস রূমের গেটে দাঁড়িয়ে শ'খানেক ছাত্রের বন্দে মাতরম আর জয় হিন্দ ধ্বনিতে বাতাস গরম হয়ে গেল। স্যার একটু ভাবুক প্রকৃতির এবং গবেষক ধাঁচের মানুষ ছিলেন। সম্ভবত: তিনি D.Sc ডিগ্রিধারী ছিলেন। তিনি তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিমায় দরজার দিকে তাকিয়ে আইসোটোপের সংজ্ঞা উচ্চারন করে মিছিলকারীদের জিগ্যেস করছেন, 'Do you understand'. অর্থাৎ তারা যে ছাত্র মিছিলের দলবল সেটা তার খেয়ালে নেই। স্যারের কথা শুনে আশীষ'দার মিছিলের শ্লোগানের জোশ আরো বেড়ে গেল। তখন স্যার সম্বিত ফিরে হুংকার দিয়ে উঠলেন, ' What do you want? Get lost. I'm just taking my class. Don't shout. If you don't, I will straight away write to the Vc about this chaotic situation'. স্যারের হুংকারে আশীষ'দা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তার মিছিল নিয়ে ফিরে গেলেন। বলে রাখা ভাল, অধ্যাপক স্যার আমাদের কলেজের নিয়মিত শিক্ষক ছিলেন না। মাঝে মধ্যে পঠন পাঠনের উৎকর্ষতা বাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যশস্বী প্রফেসরদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত প্রধান প্রধান কলেজে প্রেষনে পাঠানো হোত।
আশীষ'দা মানে আশীষ কুমার ব্যানার্জী। বাংলা অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র এবং কলেজ ছাত্র পরিষদের সভাপতি বা সেক্রেটারী এইরকম কিছু হবে। রামপুরহাটের ছেলে। রামপুরহাট শহরের হাট পাড়ায় তাদের পৈত্রিক নিবাস। বন্ধু বাৎসল এবং উচ্চাভিলাষী আশীষ'দা বেশ হাসিখুশি এক প্রানবন্ত যুবক ছিলেন। ছাত্র কমিউনিটির খোঁজ খবর বেশ ভালই রাখতেন। তার সাথে মেশার বেশী সময় আমি পাইনি। তবে তিনি যে আমার একজন শুভাকাংখী ছিলেন তা পরে টের পেয়েছি। মনে পড়ে কেমিস্ট্রি ল্যাবে কাজ করার সময় একদিন হঠাৎ ডেমোনেষ্ট্রেটর স্যার আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলেছিলেন। 'দেখ জালাল, তুমি তো মোটামুটি ভাল ছাত্র হিসাবেই আমাদের কাছে বিবেচিত। কিন্তু প্রতিযোগিতায় হয়তো পিছিয়ে পড়ছো। আশীষ তোমার কথা আমাকে বিশেষ করে বলেছে। তাছাড়া মাস্টার মশাইকে তো আশীষ অন্য চোখে দেখে (এখানে মাস্টার মশাই মানে আমার বড় ভাইয়া মোয়াজ্জেম হোসেন যিনি স্থানীয় হাইস্কুলের হেডমাস্টার)। কলেজে একটা এক্সট্রা ফান্ড আছে। তুমি একটা দরখাস্ত লিখে দাও। আমি তোমার স্টাইপেন্ডের ব্যবস্থা করে দেব।' আমার স্টাইপেন্ড হয়েছিল। এ নিয়ে আশীষ''দাকে আমি আর প্রশ্ন করিনি। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সোজা ঢাকায় চলে এলাম। নিয়তিতে এটাই লেখা ছিল।
ছিয়াশির দিকে বউ-বাচ্চাদের নিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন আমি বাংলাদেশ সরকারের লেদার টেকনোলজি কলেজে শিক্ষক হিসাবে চাকুরী করি। সম্ভবত: আক্টোব-ডিসেম্বর, ১৯৮৬, এই তিন মাসের জন্য প্রডাকশন ও প্রডাকটিভিটির উপর পশ্চিম জার্মানী ও সুইজারলান্ডে আমার উচ্চতর ট্রেনিং এর ব্যবস্থা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এই প্যাকেজ প্রোগ্রামের ব্যবস্থা হয়েছিল। তারই সূত্র ধরে বিদেশ যাওয়ার আগে পনের দিনের ছুটি নিয়ে ভারতে মা ও অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে যাওয়া হয়েছিল। আমার বড় ভাইয়া অর্থাৎ এলাকার প্রিয় মোয়াজ্জেম মাস্টার সে সময় একটি সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ। তার মাধ্যমে শুনলাম ছাত্রনেতা আশীষ ব্যানার্জী তখন আমারই কলেজের অধ্যাপক। বউ বাচ্চাদের নিয়ে সোজা কলেজে চলে গেলাম। কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকতেই সেই ছোটখাট মানুষটির দূর থেকে চিৎকার, কিরে জালাল ঢাকা থেকে কবে এসেছিস। আই বস, এই বুঝি তোর ফেমিলি' ইত্যাদি। আমি একটু আবেগাপ্লুত হলাম। এটাই বুঝি রাজনীতি। রাজনীতির মানুষজন আসলে 'মানুষ' হয়েই রাজনীতিবিদ হন। নইলে এত বছর পর এ স্টাইলের সম্বোধনে আমি সত্যিকার অর্থেই একটু হলেও ভিমড়ি খেয়েছিলাম। তারপরে তো ইতিহাস। আশীষ'দা রামপুরহাট বিধানসভা কেন্দ্রে এমএলএ হলেন। পরবর্তী টার্মে আবারও নির্বাচিত হলেন। রাজ্যের কৃষি ও সেচমন্ত্রী হলেন। আর এবার তো বিধায়ক নির্বাচিত হয়ে সরাসরি নবান্নের উপাধ্যক্ষ অর্থাৎ ডেপুটি স্পীকার হলেন। চাকুরি জীবন শেষ করে এই শতাব্দীর বারো সালে সস্ত্রীক গিয়েছিলাম পৈত্রিক ভিটায়। প্রিয় আশীষ'দার সঙ্গে দেখা করতে কলেজ ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম। মন্ত্রী মশাই কলকাতায় অবস্থান করছিলেন বিধায় দেখা হয়নি। পরে কলেজের নতুন অধ্যক্ষ তপন বাবুর সঙ্গে দেখা করে কিছুটা সময় স্মৃতিচারন করে ফিরে এলাম।
আমার কৈশরের স্মৃতি চারনের টগবগে প্রানবন্ত সেই যুবক আশীষ ব্যানার্জী অর্থাৎ সত্তোর্ধ প্রিয় আশীষ'দা এখন পুরো দস্তুর রাজনীতিবিদ। পশ্চিম বঙ্গের বাঙালীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রনে নবান্নের শিরোমনিদের একজন এখন। ভাল থেক আশীষ'দা। দীর্ঘজীবি হও। সুস্থ্য থেক। আমরাও এখন সবাই সত্তরের আশেপাশে বিচরন করছি। ঢাকাবাসী হলেও নাড়ির টানে মাঝেমধ্যে পিতৃ ভিটা জয়কৃষ্ণপুরে বেড়াতে যায়। মহেন্দ্রপুরের বন্ধু হরনারায়ন সাহা এসটি কোটায় কোন এক মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। পড়ার চাপে না কোন এক কারনে ব্রেন স্ট্রোক করে কচি বয়সেই সে ইহলোক ত্যাগ করেছে। দিঘির পাড়ের কলেজ সহপাঠী আরেফ আলি মাস্টারী জীবন শেষ করে অবসর দিন কাটাচ্ছে। গ্রামের মেধাবী ফজর আলি এমএসসি করে বেকার। বুনিয়াদী অস্ত্র অঙ্কের উপর ভর করে টিউশন টিচার হিসাবেই জীবনটা কাটিয়ে দিল সে। সহপাঠী মৃণা রায় চৌধুরী সরকারী হাসপাতালে নার্সের চাকুরী শেষে অবসরে গেছে। বাকীরা সব চাষাভুষা হয়েই কেউ মাটির উপর, অনেকে ইহধাম ত্যাগ করে মাটির নীচে চলে গেছে।
ভাল লাগছে, তারুন্য্যের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলির তুখোড় ছাত্রনেতা আমাদের প্রিয় আশীষ'দা এখন ভারতীয় পশ্চিবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতিতে অভিভাবক হিসাবে নবান্নে রাজ করছেন। স্মৃতির আয়নায় অনেক কিছুই চোখের কোনে চিক চিক করে। মনে পড়ে একাত্তরের সেইসব স্মৃতি জাগানিয়া দিনগুলির কথা। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের আঁচ আমাদের গায়ে খুব বেশী লাগেনি। তথাপি আমাদের কলেজ ছাত্র সংসদের পক্ষ থেকে কলকাতা থেকে খুলনার এক সাইক্লিস্টকে ম্যানেজ করে রামপুরহাটে আনা হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম ছিল সম্ভবত: মনিরুল হক বা মনির হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহের কাজে তিনি পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় তার সাইক্লিং কসরত দেখিয়ে তহবিল সংগ্রহের কাজটি করছিলেন। আমাদের কলেজ সংসদ থেকে তাকে ম্যানেজ করে কলেজ ফুটবল মাঠে তিনদিনের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। যথারীতি আশীষ'দা এই মহৎ কাজের পুরোভাগেই ছিলেন। এছাড়া একাত্তরের অক্টোবরের দিকে কলকাতা থেকে প্রথিতযশা শিল্পীদের আনিয়ে জলশার আসর বসিয়েও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের তহবিল সংগ্রহে আমরা কাজ করেছিলাম। এর সবকিছু সম্ভব হয়েছিল প্রগতিশীল ছাত্র নেতৃত্ব এবং তৎসময়ের সেদেশীয় পজেটিভ রাজনীতির কারনে। স্থানীয় রাজনীতির উদীয়মান কর্মী হিসাবে সেসময় আশীষ ব্যানার্জীরা পজেটিভ নোট নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে সবার নজর কেড়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের দিনে মাননীয় ডেপুটি স্পীকার হিসাবে নবান্নে শ্রী আশীষ কুমার ব্যানার্জীর সম্মানিত পদচারনা। জয়তু আশীষ'দা। জয় বাংলা।