জালাল উদ্দিন আহমেদ
থ্যাংক্স টু ভগবান
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ১১:৪৪ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
পক্ষ বিপক্ষ নামক শব্দ দুটি বেশ ভালভাবেই বাজারজাতকরন হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের এই ভারতীয় উপমহাদেশে। এই শব্দ দুটোর অবাধ বিচরন সমাজ রাষ্ট্র রাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার উঠানে নতুন মেরুকরনের মাধ্যমে যে বাঙালীয়ানার সুত্রপাত হয় তা শুধু বাঙালীর সমগ্রতাকেই নষ্ট করেনি, ধর্মীয় বিষ বাষ্পের এক চরমতম আঘাত ছিল সেটি। ফোর্ট উইলিয়ামের উত্থানে বাঙালী সংস্কৃতির যে হিন্দুয়ানী ঢাক বাজা শুরু হোল, উইলিয়াম কেরি নামক বৃটিশ পাদ্রী ছিলেন তার কান্ডারী। যেহেতু কলকাতা কেন্দ্রিকতায় তখন ভারতবর্ষের ভাষা সংস্কৃতির চর্চা লালন হোত, বিধায় ধর্মকে সামনে এনে বৃটিশ কুটচালে বাঙালী তার ধর্মের প্রাধান্যে সামাজিক পট সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে প্রশ্রয়ের শতভাগে থেকে হিন্দু শিক্ষিত শ্রেনী, বাঙালী ঘরানাকে হিন্দুয়ানীর ধর্মীয় ছকে ফেলে বাংলার ভাষা সংস্কৃতির নতুন মাজনে মত্ত হয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ মুসলমান বাঙালী তাদের সেই অনুশীলনে বাঙালী থাকার উঠানে স্থান না পেয়ে মুসলমান বা ম্লেচ্ছ পরিচয়েই সব্যস্ত হয়ে যায়। বাংলা ভাষা সংকৃতির অঙ্গনে এতদাঞ্চলের বাঙালী মুসলমানেরা পরিযায়ী আদম সন্তান হিসাবে গন্য হয়ে যান। উনবিংশের ফোর্ট উইলিয়ামের কার্যধারা এবং তাদের রচনা শৈলী ও বাংলায় সংস্কৃত ভাষার অনুপ্রবেশই বলে দেয় বিজাতীয় সেন পালদের মুখের ভাষাই হচ্ছে বাংলা ভাষার মূল সূত্র। অথচ সংস্কৃত ভাষা হচ্ছে এশিয়া মাইনরের ককেশীয় অঞ্চলের আর্যদের ভাষা। আর সেন পালরা হচ্ছে সেইসব বিজাতীয় আর্যদের বংশ পরম্পরার অপভ্রংশ। সেইসব সেন পালদের মুখের ভাষা সংস্কৃতের তৎসম অর্ধতৎসম তদ্ভব দিয়ে সাজানো হয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে। সম্ভবত: তাদের সেই উর্বরা মস্তিষ্কের সৃষ্ট বাংলা প্রচলনের গদ্য ও পদ্য রীতি দিয়েই আমরা এখনো একই পাটাতনে উলম্ফন করে চলেছি।
খুব সুকৌশলেই এসব কাজ হয়েছে। অথচ বাংলায় সৃষ্ট হওয়া গদ্যরীতি যা ত্রয়োদশ শতাব্দী পরবর্তী সুলতানীয় শাহ আমলে চালু হয়েছিল, তা গুটিকয় হিন্দু ব্রাহ্মন্য পন্ডিতের অতি পান্ডিত্যের ধার এবং হিন্দু আধিক্যের ফোর্ট উইলিয়ামের ভারে সংস্কৃত অনুপ্রবেশে নতুন রূপ নেয়। ফলে ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় ধর্মীয় প্রাধান্যের এক প্রচ্ছন্ন প্রভাব সেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। জাতি হিসাবে আমরা বাঙালী - এটাই স্বত:সিদ্ধ। কিন্তু ধর্মের বিজাজনে এখন আমরা সেই অশুদ্ধ উচ্চারন হিন্দু মাসলমানকেই জাতি হিসাবে সামনে আনি। চাপিয়ে দেয়া সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরন করেই আমাদের এই অধোগতি হয়েছে। তারপরেও বাঙালী তার নিজ নিজ ধর্ম কর্মে অটুট থেকে শান্তি সম্প্রীতি ও সৌহার্দের পথ অনুসরন করে হাজার বছর ধরে প্রতিবেশীর সহমর্মিতায় একাট্টা থেকেছে। নিজেকে নিজের মত করে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেশীর সুখে সুখী হয়েছে, প্রতিবেশীর দু:খে দু:খী হয়েছে। সামাজিক আদান প্রদানে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একমুখী থাকার চেষ্টা করেছে। জীবন বিনির্মান ও কর্মক্ষেত্রের বহুচারিতায় বাংলার পুর্ব পশ্চিমের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচরনের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি বাঙালীর সহবস্থান ও সমাজে এক ইউনিট হয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে নেই কোন ধর্মীয় কাদা ছুঁড়াছুঁড়ি বা অসহিষ্ণুতার বাতাবরন। বিশাল মিনার সদৃশ্য দুতলা মসজিদের এক'শ গজ দূরেই মন্দিরের অবস্থান, একই লেনে ধর্মভীরু মুসলমানের বাড়ি সংলগ্ন দত্ত ঘোষদের বসবাস বাঙালীর চিরায়ত সহবস্থানের শাশ্বত দৃষ্টান্ত। পুরো বাংলা জুড়ে এই চিত্র, এই সংস্কৃতি নিয়েই বাঙালী তার জীবনবোধের গল্প সাজিয়েছে।
এ গল্প তো একদিনে তৈরী হয় নি। শত শত বছরের ভাঙা গড়ার মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধর্মীয় জাতিগত সহবস্থান আমাদের সামাজিক বন্ধনকে মজবুত করেছে। মনে পড়ে ষাটের দশকের একটি ছোট্ট অথচ অর্থপুর্ণ ঘটনার কথা। সবে হাইস্কুল পর্যায়ের ছাত্র হয়েছি। সভবত: সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র তখন। বড় ভাই দূরবর্তী একটি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। সেই হিসাবে আমার গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে সব শিক্ষকই তাঁর বন্ধু ও তৎসমতুল্য। আমার স্কুলের শিক্ষকদের শতকরা সত্তর ভাগই হিন্দু শিক্ষক। আর ভাইয়ার বন্ধু ও স্কুল সহকর্মীদের পঞ্চাশ ভাগই হিন্দু। বড় ভাইয়ার ঘরে নতুন সন্তান এসেছে। সুতরাং আকিকা দেয়ার বিশাল তোড়জোড়। বলছি পশ্চিম বঙ্গের জেলা পর্যায়ের এক মহকুমা শহরতলীর কথা। যদিও তা গ্রাম হিসাবে তখনও চিহ্নিত। ঘরের পালিত খাসি এবং পুকুরের মাছ ও বাড়িতে মিষ্টি বানানোর ময়রা এনে সে এক বিশাল আয়োজন। না হলেও পাঁচ'শ মানুষের ভুরি ভোজের এন্তেজাম। আধা শীতের রাতের সে আয়োজনে বাহির বাড়িতে বিশাল সামিয়ানা টানিয়ে গোটা দশেক হ্যাসাক লাইট জ্বালিয়ে সেই আয়োজনের মধ্যমনি ছিলেন আমার হাইস্কুলের হেড মাস্টার শ্রী শরৎ কুমার প্রামানিক। সব মিলিয়ে স্কুল শিক্ষক এবং ভাইয়ার বন্ধু বান্ধব মিলে শ'খানেক হিন্দু মানব সন্তান সেই আকিকার আতিথ্য গ্রহন করেছিলেন। লক্ষ্য করেছিলাম হিন্দু মুসলমান একপাতে পাশাপাশি বসে সেই ভুরিভোজে সামিল হয়েছিলেন। কি মধুর সে স্মৃতি। গত শতাব্দীর ছেষট্টি সালের কথা এটি। অথচ তখনকার সেই উত্তাল সাতচল্লিশের সাম্প্রদায়িক কাঁচা মাটি এবং সদ্য সমাপ্ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে বাঙালীর এই সহবস্থান আমাকে ভাবাই বৈকি! সত্যিকার অর্থে এই সামাজিক বুনিয়াদেই আমাদের বেড়ে উঠা।
সত্যিকার অর্থে বাঙালীর অন্তরের আত্মা কখনোই ভারতীয় বা পাকিস্তানী হতে চায়নি। তাদের বুনিয়াদী কাঠামো সব সময় তার নিজস্ব অস্মিতায় প্রস্ফুটিত হতে চেয়েছে। আজকে একবিংশের তেইশে এসে এখনো গর্ব করে বলতে পারি বাংলার(কি স্বাধীন বা অধীনস্ত) কোথাও কোন সাম্প্রদায়িক হানাহানি নেই। যেটা আছে তা হোল রাজনীতির বক্তৃতা বিবৃতিতে। তিলকে তাল বানিয়ে একশ্রেনীর উচ্ছিষ্টভোগী মানুষ এই সাম্প্রদায়িক জুজুটাকে জিইয়ে রেখে তাদের রূটি রুজির বন্দোবস্তে এই অস্ত্রটি ব্যবহার করছে। কি চমৎকার আয়োজনে হিন্দু মুসলমানের সহবস্থান। অথচ গেল গেল রব তুলে একশ্রেনীর মানুষ ধর্মের নামে এই বিষাক্ত বহ্নি জ্বালিয়ে নিজেদেরকে লাইম লাইটে রেখে রূটি রূজির এন্তেজাম করে বংশ পরম্পরা কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাদেরকে বলি আসুন গোটা বাংলার জেলা পর্যায় থেকে মেট্রোপলিট্যান সিটিগুলো ঘুরে দেখুন - কতশত নিজস্ব ঐতিহ্যের সাক্ষী নিয়ে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালী ঐতিহ্যের অস্মিতায় আলোকিত হচ্ছেন। অবসরের এই সময়টাতে রাজশাহী মেট্রো সিটিতে ঘুরে এই ধারনাটি আমার কাছে আরো পোক্ত হয়ে ধরা পড়েছে এবং ভাল লেগেছে। কি সুন্দর সহবস্থান। ঘোষপাড়া, বোসপাড়া, কুমারপাড়া, ফুদকিপাড়া, মালোপাড়া, পঞ্চবটি, ষষ্ঠিতলাসহ পাশাপাশি দরগাপাড়া, মিয়াপাড়া, পাঠানপাড়া ইত্যাদি সব নামগুলো বাঙালীর সহজাত সহবস্থানের শাশ্বত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথাকেই মনে করিয়ে দেয়।
এতগুলো কথা বললাম তার একটাই কারন আমার কাছে মনে হয়েছে যে আসলেই বাঙালী নামের সার্থকতায় আমরা সত্যিকার অর্থে গর্বিত। খেলার মাঠে ঘটে যাওয়া সেদিনের একটি ছোট্ট কথায় আমি আবেগপ্লুত হয়ে পড়ি। একবিংশের রাজনৈতিক বটতলায় যখন দেখি রাজনীতির কলুষতায় ধর্মকে সামনে এনে দেশে বিদেশে অনাচারের বীজ বুনা হচ্ছে তখন বাঙালী তার মনের উদারতায় কত সন্দর ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে ধর্মীয় সম্প্রীতির বাতাবরন তৈরী করছে। ক্রিকেট খেলার ইংল্যান্ডের সাথে সব শেষ ম্যাচে আমাদের লিটন কুমার দাস সর্বোচ্চ রান করে সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ধারাভাষ্যের উপস্থাপকের সামনে ম্যান অব দ্যা ম্যাচের ট্রফি নিয়ে তাঁর সেই উচ্চারন "থ্যাংকস টু ভগবান" আমার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়েছে। বাঙালী হয়ে বাঙালীয়ানার সহবস্থানের অপন বৈশিষ্ঠে বুকটা চওড়া হয়েছে। স্রষ্ঠার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধে আপন অনুশীলনে যে স্বত;স্ফুর্ততা দেখিয়ে লিটন বাংলাদেশে বাঙালীয়ানার সৌভ্রাতৃত্ব প্রকাশ করেছেন তা বাঙলাকে নতুন উচ্চতায় মহিমান্বিত করেছে। আমরা এভাবেই এগিয়ে যাব। বাঙালী তার ইস্পিত লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাকে বিশ্ব দরবারে এভাবেই উচ্চকিত করুক - এটাই কামনা।