জালাল উদ্দিন আহমেদ
শুভঙ্করের ফাঁকি নয় তো!
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ মার্চ,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৪০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
অবসরের এই দিনগুলিতে ইদানীং সময়টা বেশ নিজের মত ক'রে বের করে নিতে পারি। ফলে সকালটা বেশ আয়েশেই কাটে। বাজারের ঝক্কি নেই, নাতি-পুতিদের স্কুলে নেয়ার আলাদা চাপ নেই। কারন তৃতীয় পুরুষেরা এখন জুনিয়র পর্যায়ে এসে গেছে। তাছাড়া ওদের আসা যাওয়ার দায়িত্ব স্কুল ম্যানেজমেন্ট থেকেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এর বদৌলতে প্রতিদিনের সকালে পত্রিকার পাতাগুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে নেয়ার অফুরন্ত সময় আমাকে চিন্তা ও বিশ্লেষনের সুযোগ করে দেয়। তবে সত্যি কথা বলতে কি, সেই পুরনো কাহাবতের আক্ষেপটি বেরিয়ে আসে,'কে পড়ে বা শুনে এসব'। সত্যিই তো তাই। গত এক দশক ধরে শিল্প সংক্রান্ত বিষয়ের চামড়া শিল্প নিয়ে, এর আধুনিকায়ন ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রন ইত্যাদির ব্যাপারে বিভিন্ন ফোরাম এমনকি লাইভ টেলিভিশন টকশোতে কত না শোরগোল হলো; কিন্তু গতস্য শোচনা নাস্তির আদলেই তো চলছে সেইসব সরকারী কর্মযজ্ঞ। মনে হচ্ছে যেন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই শিল্প সেক্টরটির জন্য কাউরি মাথাব্যাথা নেই। Value addition এর এত এত সুযোগ ও পথ খোলা থাকার পরও কেন যেন এক অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা এই শিল্প সেক্টরটির পথের কাঁটা হয়ে আছে।
আমাদের পত্র পত্রিকার সবগুলিই একটা বলয় কেন্দ্রিক বলে মনে হয়। গদবাঁধা কিছু নৈমিত্তিক পাতাভরা কেচ্ছা কাহিনী আর দূষিত রাজনীতির ঝগড়া ফ্যাসাদের খবর নিয়েই তাদের রোজ নামচা। হাঁ, দেশের দু:খ দুর্দশার হালচালও থাকে, তবে একপেশে স্তুতি আর ব্যক্তি বন্দনার খবরা খবরেই পাতাগুলি ভরা থাকে। কেন বলছি এসব কথা, তার নিশ্চয় একটা কারন বা খেদ আমার মত অনেকেরই আছে। যেসব বিষয় নিয়ে খবর হয় তার পিছনের খবরটা নিয়েও মানুষের অনেক প্রশ্ন থাকে। সেইসব প্রশ্নের উত্তর যখন চুলচেরা বিশ্লেষনের মাধ্যমে পাঠক সমাজের সামনে উত্থাপিত হবে তখনই সেই খবরের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে। সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু মনের উদগীরনে যখন সমাজ তথা রাষ্টের অসামঞ্জস্যতা ফুটে উঠবে তখন সামাজিক সাম্যতার চাহিদায় মানুষের মানবিক মূল্যবোধে জাগরন আসবে। রাষ্ট্র বিনির্মানের কারিগররা সঠিক পথের কান্ডারী হয়ে আপন কক্ষপথে দেশের প্রকৃত নির্মাতার ভূমিকায় আছেন কিনা সেটাও ভাববার অবকাশ থাকবে।
বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, আমাদের দেশবরেন্য মাথাওয়ালা ব্যক্তিবর্গ দেশের অর্থনীতি ও তার ভবিষ্যত গতি প্রকৃতি নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন। তাদের বিচার বিশ্লেষনে গেল গেল রবের রাজনৈতিক ডংকা না বাজলেও সংকট-সমস্যার অশনি যে আছে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। দেশের মুখ্য খবরগুলির মধ্যে যে বিষয়টি টক অব দি কান্ট্রি হয়ে গত কয়েক মাস যাবত এদেশের রাজনীতি অর্থনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ভীতকে নাড়িয়ে দিয়েছে তা হোল টাকা ও সম্পদ। এইতো বছর খানেক আগেও আমাদের জিডিপি, রিজার্ভ, অর্থমুল্য এমনকি দেশের বিভিন্ন সূচকের উর্ধগতি এবং তার মোটাতাজা অবস্থান পার্শবর্তী অনেক শক্তশালী বড় বড় দেশের থেকেও স্বাস্থ্যবান হওয়ার গল্পগুলি আমরা শুনেছি। কোভিড এসেছে সেই বিশের প্রথম দিকে। ওটা নিয়েই পৃথিবী হেলে পড়ার কথা। সেটাও যখন হোল না, দেশের উন্নয়নের উর্ধগতি সেই দুর্যোগ মহামারীতেও যখন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো তখন কি এমন হোল যে দেশের জিডিপি থেকে শুরু করে মহা অহংকারের সেই স্ট্রং রূমের রিজার্ভের থলেটা ফুটো হয়ে অর্ধেকে নেমে এল। তাও আবার এই তেইশের শুরুতেই এটার চাউর হওয়া শুরু হোল। সেটা নিয়ে কথা বলার স্পর্ধা আমার নেই। কারন এই রিজার্ভ জিডিপি ইত্যাদির ব্যাপারে আমি মোটের উপর ব-কলম। কিন্তু প্রশ্নটা জেগেছে অন্য এক আশার প্রদীপের ঝলকানি দেখে। সেই ঝলকানি হঠাৎ করেই এল, না এটা এক দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার ফলশ্রুতি সেসব জানার ইচ্ছে নিয়েই এবিষয়ে আমার আগ্রহটা জন্মেছে। এটার ব্যাখ্যা বিশ্লেষন কেউ কোনদিন করেছেন কিনা আমি জানি না। তাই সরল মনে এটার উপর প্রশ্নাকারে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছি।
আমাদের মুখ্য সংবাদ পত্রগুলির সব কটিতেই অর্থনীতির উপর বেশ খবরাখবর পরিবেশন করা হয়। মাঝে মধ্যে বড়সড় অর্থনীতিবিদদের মতামত ও বিশ্লেষন প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে গোল টেবিল বৈঠকের খবর চিত্রসহ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার এই অর্থনীতির পাতাগুলি থেকেই বোধ হয় শিখেছি কাল টাকা ও সাদা টাকার কথা। তাছাড়া মাননীয় অর্থমন্ত্রীদের বৎসর ভিত্তিক বাজেট পেশের বদৌলতে বাংলার সাধারন মানুষ এই সাদা-কালোর কথাগুলি শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বলেই মনে হয়। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, ইদানীং রেমিট্যান্সের প্রবাহ উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে চলেছে। খুব ভাল কথা এবং সুখবও বটে। রেমিট্যান্স মানেই বিদেশী টাকা। আর বিদেশী লেনদেনের ভাবার্থ হচ্ছে ডলার আমদানি। শুধু টাকা ছাপিয়ে কি পার পাওয়া যাবে! বিশ্ব বাণিজ্যের সামঞ্জস্যতায় ডলার অর্থনীতির এক বিশাল সাম্রাজ্য রয়েছে। অর্থনীতির সেই অক্সিজেনের সরবরাহ ও পরিবেশনায় এধার ওধার হলেই রাষ্ট্র কাঠামোর অস্তিত্ত্বে অশনির উঁকি দেয়া শুরু হয়। কারন বিশ্বময়তায় বর্তমান মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে বিশ্ব এখন একটি গ্লোব্যাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে। ফলে নিজের পায়ের মাটিকে শক্তপোক্ত করতে প্রয়োজন আন্তর্জাতিকতাবাদের ভাড়ারের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করে পথচলা।
আশংকাটা ছোট না বড় তা বলতে পারবো না। কারন আগেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি যে আমি কোন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ নই এবং এসব নিয়ে বুঝিও খুব কম। তবে যা নিয়ে আমার দীর্ঘ দিনের আশংকা এবং একটা সন্দেহের অবকাশ তৈরী হয়েছে তা হচ্ছে তেলা মাথায় তেল দেয়ার সেই পুরনো কেচ্ছা কাহিনী। এটা অমূলকও হতে পারে। কারন এর কোন ভীত তৈরীর প্রকাশ বা প্রয়াস চোখে পড়েনি। বিশ্ব মন্দার এইসব দিনগুলিতে প্রবাসী আয়ের বাড় বাড়ন্ত চোখে পড়ার মত। যেখানে বিশ্ব মন্দার কবলে দুনিয়ার তাবড় শক্তিধর দেশ ও বিশ্বখ্যাত কোম্পানীগুলোতে কর্মী হ্রাসের খবরা খবর নিত্য দিনের ঘটনা সেখানে গত দু'এক মাস থেকে রেমিট্যান্স বাড়ার ঘটনা বেশ চমকপ্রদও বটে। অনেকেই বলাবলি করছিলেন কোভিড জটিলতায় প্রবাসী সঞ্চয় গুটিয়ে অনেকেই নিজের দেশে বরাবরের মত চলে আসার তাগিদে হয়তোবা এই অতিরিক্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এখনকার সময়ে যখন উন্নত বিশ্ব নিজেরাই অর্থনৈতিক মন্দায় জর্জরিত তখন এই রেমিট্যান্সের স্ফীত প্রবাহ জিগ্যাসা বাড়ায় বৈকি! তাছাড়া কাল টাকা সাদা করার সরকারী ঘোষনা তো তাদের জন্য একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক হিসাবে রয়েই গেছে। এই 'তাদের' কথাটা বলা হোল এই কারনে, তারা তো জাতির ভাশুর। ভাশুরের নাম কি মুখে নিতে আছে! এই ভাশুররাই তো দেশের টাকা পয়সা সম্পদ পাচার করে দেশটাকে ফোঁকলা করে দিয়েছে। আর ইদানীং যখন বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান ঝগড়া ফ্যাসাদের অজুহাতে পক্ষ বিপক্ষের তুলাদন্ডে উঠে নিষেধ্যাজ্ঞা নামক মহা অস্ত্রটি ব্যবহার করে, তখন অর্থ ও সম্পদ নয়ছয়ের ভাশুররা শংকায় পড়ে এসব পন্থায় কালোকে সাদা করার প্রয়াস নিলে আশ্চর্যের কিছু থাকে কি? সেক্ষেত্রে তারা তখন বিভিন্ন পন্থায় দেশে তাদের লুটের সম্পদ ফিরিয়ে আনার এসব কৌশলের আশ্রয় নেয়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির বিষয়টি সেই শুভংকরের ফাঁকি নয়তো?