জালাল উদ্দিন আহমেদ
শিক্ষাঙ্গনে নয়ছয় ও নৈরাজ্য
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ মার্চ,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:২৩ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
এসব নিয়ে লেখার স্পর্ধা কখনোই ছিল না। কারন বড় বড় মাথা ওয়ালারা আছেন এসব নিয়ে ভাববার। যারা শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চায় প্রতিনিয়ত গবেষনায় বুঁদ হয়ে দেশ মাতৃকার সুর্য সন্তান রূপে স্বীকৃত তারাই তো এসব নিয়ে কথা বলবেন! আমার মত জাউলা-মাউলারা এসবের কি বুঝে? কিন্তু সূত্রধর যখন কাঠের উপর র্যাঁদা চালানো ভুলে যায়, কামার তার উতপ্ত লোহার উপর হাতুড়িটার আঘাত ঠিকমত মারতে পারে না, জেলে মাছ চলাচলের গতি ভুলে নদী স্রোতের বিরান এলাকায় জাল বায়, তখন ফলাফলে যে শুন্যতা আসে তাতো অনুমিত ভাবেই ঘটে। এসব সাদা চোখে দেখা দেশীয় কাদা মাটির শ্যামল সবুজের গল্প। দেশ গড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টার আঙ্গিনায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ডের শিক্ষা স্বাস্থ্য অর্থনীতি সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির পরিচালনার জন্য সুস্থ পরিবেশের একটি সুষ্ঠ গনতান্ত্রিক চর্চার রাজনীতি সমৃদ্ধ সরকার ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা সর্বজনবিদিত। এসব নিয়ে আমরা সংগ্রাম করেছি, যুদ্ধ করে নিজের দেশ নিজের মত করে হাতের মুঠোয় নিয়েছি। সেটাও তো অর্ধ শতাব্দী হয়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছেলেটি কৈশর পেরিয়ে যৌবনের শেষ প্রান্তে কাঁচা-পাকা চুলের প্রৈঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে এসেও যেন অপরিপক্ক যৌবনের আচরনে টালমাটাল। যে রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের আকাঙ্ক্ষায় আমাদের পথ চলা শুরু, সেই উঠানটির মসৃনতা তৈরী করতে এখনো অপরাগ রয়ে গেলাম আমরা। রাজনীতির আঙিনার গনতান্ত্রিক চর্চায় এখনো আমরা সাবলীল হতে পারলাম না। অনুশীলনের ঘাটতি, নাকি বহুজাতিক রক্ত পরম্পরার চাপান-উতোর আমাদের চলার গতিকে বার বার হোঁচট খাওয়াচ্ছে, তা বিদগ্ধ জনেরাই ভাল বলতে পারবেন।
রাজনীতির মেরুদন্ডটি বংশ পরম্পরার হেঁসেলে জমা রেখে যে গনতান্ত্রিক যাত্রাপথে আমাদের গতিপথ সাজিয়েছি তা যে কখনো তার কাংখিত গন্তব্যে নোঙর করতে পারবে না সেটা চোখ বন্ধ করেই বলে দেয়া যায়। ছোটবেলায় দেখেছি এবং নিজের চলার পথে শিখেছি রাজনীতি ও গনতন্ত্রায়নের গতিপথ। গ্রামের আইএ বিএ পাশের মাস্টার মশাইরা রাজনীতির পঠন পাঠনে গ্রাম্য উঠানে তাদের স্বল্প শিক্ষার বাণী বিতরন করে সমাজকে সংগঠিত করতেন। শ্রেণী শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রদের মধ্যে আদর্শ ও নৌতিকতার বাণী বিতরন করে তাদের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন মানবিক মূল্যবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ এবং অহিংস বাণীর আলো ছড়িয়ে দিতেন। ফলে স্কুল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে ওইসব গ্রাম্য নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা উচ্চ শিক্ষালয়ে গিয়ে তাদের বুনিয়াদী শিক্ষার আলোকে ছাত্র রাজনীতির উঠানে পা রাখতেন। ছাত্র জীবনে গড়ে উঠার সময়টিতে তারা নিয়মানুবর্তিতা ও শৃংখলা বোধের আচরনে ছাত্র রাজনীতির অনুশীলনে ভবিষ্যত রাজনীতির পরিপুর্ণ কর্মী হওয়ার অক্সিজেনে সমৃদ্ধ হতেন। সেক্ষেত্রে মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় পন্ডিতস্মন্য শিক্ষকদের সাহচর্যে এমনকি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের স্বনামধন্য রাজনীতিবিদদের সাহচর্যে তারা দেশীয় প্রেক্ষিতের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস ও অনুষ্ঠানে সক্রিয় কর্মী হয়ে রাজনীতি সচেতনেতায় সমৃদ্ধ হওয়ার একটি স্বচ্ছ জমিনে বিচরন করতেন। এভাবেই রাজনীতির পাইপ লাইনে ছাত্র রাজনীতির অগ্রনীরা ভবিষ্যতের জাতীয় রাজনীতির অপিরিহার্য কর্মী হয়ে আমজনতার আশা আকাঙ্ক্ষার আলোক বর্তিকা হয়ে সামনের সারিতে চলে আসতেন। তাছাড়া দেশীয় প্রেক্ষিতের রাজনীতির উঠানে সামনের সারিতে থাকতেন সেইসব পোড় খাওয়া ত্যাগী ও জ্ঞানী মানুষেরা যাদের ত্যাগ তিতিক্ষার অনুকরনীয় অনুশীলনে সাধারন মানুষের মাথা এমনিতেই নুয়ে আসতো। এভাবেই রাজনীতির আবর্ত তৈরী করে আমাদের ঘরে জন্মেছেন মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলাসহ অসংখ্য মেধাবী ও ক্যারিশম্যাটিক নমস্য রাজনীতিবিদ।
বর্তমান রাজনীতি ও গনতান্ত্রিক আচরনের উঠানে এই পরম্পরার আবহ আছে কিনা সেটা বলা মুস্কিল। তবে দিব্য চক্ষে যা দেখা যায় তা বড়ই হতাশা ব্যঞ্জক ও অন্ধকারের ইঙ্গিত দেয় বলেই মনে হয়। যে ছাত্ররা একসময় সমাজ তথা জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে রাজনীতিতে সমীহ করার জায়গায় তৈরী করেছিল সেই ছাত্র সমাজকে নিয়ে এখন চারিদিকে আতংক, ঘৃণা আর হতাশার চিত্র দেখা যাচ্ছে। সবচেয়ে আতংকের যে চিত্রটি এখনকার দিনে সমাজ তথা রাষ্ট্রের ভীত নড়িয়ে দিয়েছে তা হচ্ছে জেন্ডার সমতার দৌড়ে ছাত্রীরাও তাদের অপকর্মের পারঙ্গমতায় নিউজ হেডলাইন হতে চাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্রদের মধ্যে ভবিষ্যত রাজনীতির যে পাইপ লাইন সৃষ্টির রীতি অনুসৃত হোত, আজকের দিনে সেটা এখন রাজনীতির হিংস্র ক্যাডার তৈরীর সংগঠন বলে সাধারন মানুষ মনে করে। কারন ছাত্র সংগঠন করে এরাই যুব সংগঠনের ক্যাডার হয়ে পরবর্তীতে মূল রাজনীতির মুখ্য কার্যকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হন।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি তার আঁতুড় ঘরেই কলুষিত হয়ে যাত্রা শুরু করে। সেক্ষেত্রে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছাত্র রাজনীতির অহংকারের সাজানো বাগানটি স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে থিয়েটার রোডে আরাম আয়েশে কাটানো 'অবশিষ্ঠের' প্ররোচনায় কলুষ পথে হাঁটার মন্ত্রে প্রলুব্ধ হয়েছিল। ফলে স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই শুরু হয়েছিল ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বিত্ত বৈভব ও ক্ষমতা লিপ্সার অনুশীলন। এছাড়া স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশে সামরিক এক নায়কতন্ত্র কায়েম হওয়াতে ছাত্র বৈশিষ্ঠের উদ্যমতাকে সামরিক শাসকেরা ভালমতোই অপব্যবহার করেন। ক্ষমতার বলয় বেষ্টিত ছাত্র সংগঠন সব সময়ই একটা আধিপত্য বিস্তারের সুবিধাভোগে দৃশ্যমান থাকে। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলের ভ্রাতৃপ্রতীম ছাত্র সংগঠনটি যে বিভৎস চেহারা নিয়ে ইদানীং সমাজ তথা রাষ্ট্রাচারে উইপোকার মত কিলবিল করছে সেটা মোটেই আইন সঙ্গত এবং ছাত্র সুলভ নয় বলে বিদগ্ধজনেরা শোর উঠাচ্ছেন। একদল ছাত্র যখন রাজনীতির আশীর্বাদে শিক্ষাঙ্গন ও সমাজের গলিপথ এমনকি রাজপথে ভাইচারের আচরনে নিজেদেরকে উপস্থাপনে বিমূর্ত থাকবে তখন সমাজ তথা রাষ্ট্রের স্বাভাবিক নিয়মাচারে ব্যতয় ঘটবে - এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আজকে ক্ষমতাসীন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে তাদের যে বেপরোয়া জীবন যাপন ও চাহিদার পারদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা পিলে চমকানোর মতই বটে। ক্ষমতাসীন রাজনীতির ছাত্র সংঘঠনটি হলে সীট বরাদ্দের নিরঙ্কুশ খবরদারিতে বলিয়ান। এমন কি বিদ্যাপীঠে নতুন শিক্ষক নিয়োগে তাদের সুপারিশের বিষয়টিও সামনে চলে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকান্ডের কমিশন সংশ্লিষ্টতায় তাদের চাহিদা প্রকাশ্য হয়ে গেছে। এমনকি জাতীয় পর্যায়ের বড়সড় উন্নয়ন কাজেও তাদের ভাগ বাটোয়ারার খবরাখবর এখন নিত্য সংবাদ হয়ে বাতাসে চাউর হয়েছে। তাছাড়া সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা ছাত্র ছাত্রীদের হলে সীট দেয়া না দেয়ার ব্যাপারে যে মধ্যযুগীয় কায়দায় তাদের দলে ভিড়ানোর বর্বরোচিত ও অসভ্য ব্যবহারের পথ অবলম্বন করা হয় বা হচ্ছে তা সত্যিই গা শিউরে উঠার মত। এ নিয়ে খবর হয়। বুয়েটের মেধাবী আবরারকে ভিন্ন মতাবলম্বী বলে হলের মধ্যেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ভিন্নমতের নির্বাচিত ডাকসুর ভিপি নূরকে মধুর ক্যান্টিনে গরুপেটা করা হয়। শাহজালালে শিক্ষা ও পরিবেশ সংক্রান্ত সাধারন ছাত্রদের আন্দোলনে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটির হামলা হয়। এছাড়া কুমিল্লা নোয়াখালী এবং সরকারী সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দশক ধরে ট্রেজারী বেঞ্চের ছাত্র সংগঠনের ছাত্র অপরাজনীতির তান্ডব চলছে বাধাহীন ভাবে।
এই নয়ছয় ও নৈরাজ্যের অবসান হবে কি? সম্ভাবনা নেই একেবারে। কারন রাজনীতির অনৈতিক আচরনের উঠানে সরকারী প্রশাসন যন্ত্রের পাশাপাশি নিজস্ব ঠাঙ্গাড়ে বাহিনী না থাকলে অবৈধ শৈরাচারী শক্তি কখনোই টিকে থাকতে পারে না। ঘটনাটি ঘটছে জ্ঞাতসারেই। তবে একটি স্বাধীন দেশের ভবিষ্যত তৈরীর সুতিকাগার হিসাবে বিবেচিত বিদ্যা শিক্ষার উঠানে উইপোকার চাষ করে যেভাবে ক্ষমতার দন্ড ধরে একটি রাজনৈতিক শক্তি দাঁড়িয়ে আছেন তাতে করে সেই শত সহস্র বর্ষীয় পুরনো সত্যটিকেই মনে করিয়ে দেয়। মসজিদুল আল-আকসা তৈরীর ইতিহাসে আমরা দেখি হজরত সূলাইমান (আ:) এর মরদেহ ধরে রাখা লাঠি উইপোকার ঘুনে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার পর লাঠিসহ হজরতের মরদেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমাদের দেশ বিনির্মানের ভবিষ্যত প্রাণশক্তি ছাত্র সমাজকে ঘুনের পোকা বানিয়ে বর্তমান রাজনীতির রাষ্ট্রশক্তি আজ ক্ষমতার রাজদন্ডে বিচরন করছেন। এতে দেশ গঠনের বাহ্যিক চাকচিক্য হয়তো দেখা যাচ্ছে কিন্তু ভবিষ্যত নেতৃত্বের কার্যকরিতা ঘুনে ধরা সুলেমানীয় লাঠির চরিত্র ধারন করছে কিনা - সেটা কি কেউ খেয়াল করেছেন? তাছাড়া বর্তমান সময়ে রাজনীতির দেউলিয়াত্ব এত নিম্নগামী হয়েছে যে জীবন চলার প্রতিটি ক্ষেত্রে এখন দলীয় ফোরাম তৈরী করতে হচ্ছে। তারই প্রতিফলনে এখনকার দিনে দলীয় পরিচয়ের শিক্ষক সমিতিগুলি যেভাবে প্রকাশ্য দলবাজির মহড়া চালাচ্ছে তা কি সুস্থ্যতার লক্ষ্মন! তাছাড়া ছন্নছাড়া রাজনীতির আশীর্বাদ নিয়ে দলীয় ট্যাগ লাগানো সুযোগ সন্ধানীরা যোগ্যতাহীন অবস্থায় বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে নিজেদেরকে যেভাবে সামনে আনছেন, সেটা দেশকে মেধাশুন্য করার পরিকল্পিত পরিকল্পনা কিনা-সেটাও ভাবতে হবে বৈকি!