জালাল উদ্দিন আহমেদ
তবু,বাংলাদেশ জিন্দাবাদ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:২১ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
বড়ই গোলমেলে হিসাব এ জগৎ সংসারে। রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি এমনকি সংসার নীতির প্রতিটি রন্ধ্রে যতসব দুর্ভেদ্য চোরাবালির বিচরন লক্ষ্য করা যায়। পই পই করে স্বাধীনতার পঞ্চাশটি বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা। এখনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে আমরা কথিত কোন ক্ষেত্রেই শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারলাম না। ব্যক্তি দ্বিচারিতার প্রভাবে সামাজিক রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও লক্ষ্যনীয়ভাবে আমাদের আগ্রযাত্রায় হোঁচট খাওয়াচ্ছে। মত পার্থক্য বা ভিন্নমতের উপস্থিতি জীবন ও জীবিকার প্রতিটি স্তরের পুষ্টতাকে মজবুত করে। আবার ভিন্নমতের অস্তিত্ব না থাকলে সেক্ষেত্রে দেশ বা সমাজ চলে একচক্ষু দৈত্যের সাজানো একপক্ষীয় বিধি বিধানের নিয়মাচারে। এই মূহূর্তে আমার এই প্রিয় মাতৃভূমি কোন্ দৈত্যের পিঠে চড়ে জিনের লাগাম ধরেছে তা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার নজরে আছে বলে মনে হয় না। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আমরা যখন ধর্মকে জাতি বানিয়ে মিশ্র জাতীয়তার উলোট করা গন্ধে খাবি খাচ্ছিলাম, তখন বাঙালীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু নামের ধুমকেতুর আবির্ভাব হয়। তিনি তাঁর জীবন বোধের আখ্যান তৈরী করে বাঙালীকে রাজনীতি শিখিয়েছেন। রাজনীতির সহাবস্থান, সহমর্মিতা, নৈতিকতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং কৃচ্ছ্বসাধনের পথে বাঙালীকে একাট্টা করেছেন। সেই মহান নেতার নেতৃত্বেই আমরা আমাদের কাংখিত স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহন করেছি। রাজনৈতিক শিষ্ঠাচারে স্বতঃস্ফূর্ত থেকে আমরা আপন উঠান তৈরীতে মনোযোগী হতে চেয়েছি।
অকস্মাৎ কালবোশেখী ঝড়ো হাওয়ায় সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে বাঙালীর শেকড় উৎপাটনের দশা। দম বন্ধ হওয়ার সেই বিভৎস পনেরোই আগষ্ট বাঙালীকে তাদের আপন অস্তিত্বের তলানিতে ফেলে দিতে চেয়েছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সিপাহশালার এবং দেশপ্রেমিক সৈনিকদের প্রিয় নেতা ও সাধারন বাঙালীর আশার প্রতীক একাত্তরের ঘোষনা পাঠের সেই অখ্যাত মেজরটি তখনও যে বাঙালীর শেষ সলতে হিসাবে জীবিত ছিলেন। সেটাই বাঙালীকে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে। অবশেষে অনেক নাটকীয়তা শেষে তিনি শাসনকর্তা হলেন বটে, তবে তা ছিল স্রোতের বিপরীত মেরুতে। বাঙালীর বাংলাদেশী চেতনাকে সামনে এনে তিনি প্রথম বাংলাদেশের শ্লোগানে মজে গেলেন। জাতীয় শ্লোগান 'জয় বাংলা' নির্বাসিত হোল। ঘোষনা পাঠের মেজরের(ততদিনে তিনি মেজর জেনারেল) 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' শ্লোগানে বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে শুরু করে। সেই ধারাহিকতায় পরবর্তী পনেরোটি বছর দুই জেনারেলের সামরিক মিশ্রিত গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বাংলা তখন আন্তর্জাতিকভাবে মুসলিম রাষ্ট হিসাবে উঁকি মারা শুরু করেছে। তবে গনতান্ত্রিক চেতনা বোধের আত্মিক আহ্বানে ছাত্র জনতার দুর্বার আন্দোলনে বাঙালীর উঠানে রাজনীতির প্রকৃত রূপ ও গনতান্ত্রিক চেতনার ক্ষেত্র তৈরী হয়। ততদিনে দেশের স্থপতি ও ঘোষনা পাঠের বীর মুক্তিযোদ্ধার পারিবারিক বলয়ে রাজনীতির আত্মীকরন হয়ে দেশে দুই মেরুর রাজনীতির জমকালো আয়োজনের সুত্রপাত ঘটে। কাল পরিক্রমায় দেশে আবারো সামরিক মদত নিয়ে এক জগা খিচুড়ির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তীতে তাদেরই মদতপুষ্টে আজকের দিনে চলমান তথাকথিত গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক রাষ্ট্রের সূচনা হয়। গত পনের বছর ধরে একচক্ষু দৈত্যের সেই তথাকথিত গনতান্ত্রিক লেবাসের সরকার দেশে এখন রাজ করছে বাধাহীনভাবে।
দেশে রাজনীতির চরিত্র নতুনভাবে লেখা শুরু হয়। সামরিক লেবাসের সুত্রপাতে রাজনীতির সংজ্ঞা পরিবর্তনের পাশাপাশি এর আচার আচরনেও যেন বিত্ত বৈভবের স্ফুরন ঘটে। মাসলম্যান দাদাগিরির আস্ফালনে ন্যুনতম মানবিক মূল্যবোধ ও তার পঠন পাঠন রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়। বাংলার রাজনীতি ও গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের সেই মধ্যবিত্তের সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা, শ্রদ্ধাবোধ, নৈতিকতা এমনকি মূল্যবোধের অনুশীলন এবং এর পর্যায়ক্রমিক পরিমিতি ও পরিপুষ্টতার ধাপগুলি রাজনীতির উঠান থেকে নির্বাসিত হয়। নব্য এলিট শ্রেনীর গৌরি সেন, সামরিকের উচ্চাভিলাষীরা এবং পারিবারিক পরম্পরার অবাধ বিচরনের নায়কোচিত মুখগুলি রাজনীতি ও গনতন্ত্রের মুখিয়া হয়ে সামনের সারিতে চলে আসেন। পাশাপাশি সন্ত্রাসী মস্তানি করা পচাগলির দুর্বৃত্তরাও উপরের তিন শ্রেনীর সহচর বা পার্শ্বচরিত্র হিসাবে রাজনীতির নিয়ামক হয়ে সমাজে 'ভাই' হওয়ার তকমা গলায় ঝুলিয়ে নেয়। এভাবেই বিগত পঞ্চাশ বছরে বাংলা ও বাঙালীর রাজনীতিতে দখলদারিত্বের মেরুকরন হয়েছে। গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের মেহনত দিয়ে রাজনীতি ও গনতন্ত্রায়নের পথ এগোয়নি। বরঞ্চ উপর তলার মাসলম্যান দাদাগিরির আদেশ নির্দেশে সাধারন বাঙালীকে জিম্মি রেখে রাজনীতির দোকান বানিয়ে বাংলাকে ফোঁকলা করা হয়েছে।
একটু হাঁড়ির খবরের দিকে তাকানো যাক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যে পরিকল্পিত রসায়নে পুর্ব বাংলায় বাঙালীত্বের উত্থান পর্বটির সুত্রপাত হয়েছিল তা ছিল একতরফা হিন্দুয়ানী ভাবধারা ও হিন্দু রাজা জমিদারদের নিষ্পেষন ও অত্যাচারের কাহিনী। পুর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যাধিক্যের জনপদ হলেও হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদীদের আচার বিচারেই তারা আবদ্ধ ছিল। বিশেষ করে বৃটিশদের সাহচর্যে তারা এই সুযোগটি নিয়েছিল। ফলে এতদাঞ্চলে মুসলিম মেজরিটি থাকলেও শাসক ও সমাজের নিয়ামক হিসাবে হিন্দুরাই সামনের সারিতে ছিল। ফলে বৃটিশ বিতাড়নের পর যখন ধর্ম গরিষ্ঠের বাঙালীরা নিজ অস্তিত্বের মালিক হয়ে সামনের সারিতে এলো তখন অন্তরের আর্তনাদে তাদের মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো "জিন্দাবাদ" নামক বুকফাটা উচ্ছ্বাস। এবং তখনকার অর্থাৎ সাতচল্লিশের সেই গোড়া পত্তনে মুসলমান বাঙালীর অন্তরে "জিন্দাবাদ" শ্লোগানটা গেঁথে গেল। যদিও "জয় বাংলা" শ্লোগানে ভেসে তারা আপন ঠিকানা বানিয়েছে তথাপি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগান তারা অন্তরে পুষে রেখেছেন। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে ঘোষনা পাঠের সিপাহশালার তাঁর তুরুপের তাসের চালটি দিয়েছিলেন। যার ফলে স্বাধীনতার এতটা বছর পেরিয়ে গেলেও বাঙালী তার বাংলাদেশ জিন্দাবাদকে আপন ঘরানার মনের ও মুখের অভিব্যক্তি হিসাবে গ্রহন করেছে। নইলে স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে এসেও কেন এখনো গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে এই "জয় বাংলা" শ্লোগানকে হিন্দুদের শ্লোগান বলে অভিযোগ করা হয়। তদুপরি চেতনার ধ্বজাধারী বুদ্ধিজীবিরা যখন বাংলার সংস্কৃতি হিসাবে উত্তরীয়, মঙ্গল প্রদীপ কিংবা পেঁচা-সাপ-শকুন বা হাতি বানরকে সামনে রেখে বর্ষ শুরুর শোভাযাত্রা করে তখন স্বাভাবিক নিয়মেই একেশ্বর বাদের অনুসারী মুসলিম গরিষ্ঠ স্বাধীন দেশের বাঙালী আবারো সেই ঊনবিংশের তথাকথিত হিন্দুয়ানী বাঙালী ছায়ার অশুভ প্রেতাত্মাকে আবিস্কার করে। এই অজানা আশংকাকে সামনে রেখে তারা মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার সেই জিন্দাবাদ ধ্বনিকে শ্রেয়তর মনে করে।
আগেই বলেছি ইদানীং দেশে রাজনীতির দুর্বৃত্যায়ন চলছে। যারা রাজনীতি ক'রে বাংলার ভাগ্যান্নয়নের কথা বলে দেশকে এগিয়ে নিতে চান তারা দৃশ্যতঃ নিস্ক্রীয় হয়ে পড়েছেন। রাজনীতিতে এখন অর্থ ও অস্ত্রই হচ্ছে প্রধান অনুসঙ্গ। রাজনীতির আদর্শিক কাঠামো বলে কিছু নেই। যেটুকু আছে তা হচ্ছে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান মুখ এবং ইষ্টবেঙ্গল মেজরের মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনা পাঠের ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এক্ষেত্রে রাজনীতির শ্লোগানে দুটি মেরু সৃষ্টি হলেও সাধারন খেটে খাওয়া মেহনতি এবং ধর্মভীরু মানুষের অন্তর নি:সৃত 'জিন্দাবাদ' ধ্বনি তাদের মন থেকে মুছে দেয়া যায়নি। তাছাড়া 'জয় বাংলা' ধ্বনি সাধারন আম-বাঙালীর মুখের ধ্বনি হয়ে সার্বজনীনতা পায়নি। কারন একটিই তা হচ্ছে ধর্মীয় বৈষম্য ভেদের সেই ঊনবিংশীয় বঙ্কিম উচ্চারনের 'বন্দে মাতরম' জয় হিন্দ এবং আরো সব ধর্মীয় পুজা পার্বনীয় উচ্চারনের মন্ত্রগাঁথা। ঊনবিংশের উঠানে বৃটিশ সখ্যের তারাজুতে উঠা হিন্দু ব্রাহ্মন্য পন্ডিতদের পুজা অর্চনা ও মন্ত্র জপের তোড়ে বাঙালীর মুসলমান সম্প্রদায় কখনোই বাঙালী হয়ে উঠতে পারেনি। এখনও একবিংশের বটতলায় দাঁড়িয়ে কলকাতার কলেজ স্ট্রীটের বাইরে গিয়ে পশ্চিমের বাঙালীকে জিগ্যেস করলে তারা অকপটে বলে ফেলে 'পূর্ব বাংলা মুসলমানের দেশ'। ঠিক এখানে যেমন বলে 'জয় বাংলা' তো হিন্দু ভারতের 'জয় হিন্দের' অনুকরন। সুতরাং এই চিরস্থায়ী সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অবসান হবে কি? আর হবেই বা কেমন করে! নেত্রী যখন জিন্দাবাদের বিপরীতে বাংলায় 'চিরজীবি হোক' উচ্চারন করলেন তখন বুদ্ধি বিক্রী করে পেট চালানো আমাদের তথাকথিত চেতনার বুদ্ধিজীবিরা এই সুন্দর বাংলাটির যথার্থতা তুলে না ধরে অতি উৎসাহী হয়ে বাংলায় আমদানী করলেন উত্তরীয় ও মঙ্গল প্রদীপের মত নতুন নরুন যা আম বাঙালীর উঠানে বাড়া ভাতে ছাই ঢালার মতই মনে হোল।
এত শত কথার ঊদগীরন এজন্যই হোল, কারন সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকায় খবরের শিরোনাম "তবু, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ"। সম্প্রতি দুর্বৃত্তায়ন রাজনীতির উঠানে জিন্দাবাদ ঘরানার পোড় খাওয়া পদত্যাগী সাংসদের স্বতন্ত্র করিয়ে জিতিয়ে আনা এক উকিল সাহেবকে জয়বাংলা শ্লোগানের মহারথীরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস ক্লাবে সম্বর্ধনা দেন। আয়োজকদের মাঝে বিরাট এক বিজয়ের তৃপ্তিময় হাসিখুশির ভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ভাষন শেষে সেই মাননীয় স্বতন্ত্র সাহেব যখন সদর্পে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' শ্লোগান দিয়ে তার ভাষন শেষ করেন তখন আয়োজকদের গতি কতটুকু বেগতিক হয়েছিল তা আমার জানা নেই। তবে পত্রিকায় ছাপানো ছবিতে একজন মাননীয় মন্ত্রীর ভাষন দানকারী বিখ্যাত স্বতন্ত্র সাহেবের মাইকের স্পীকার ধরে রাখার দৃশ্যটি 'একদল মূমূর্ষ রোগীর জন্য হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া এক মহাপুরুষের বাণী বিতরনের মঞ্চ' বলেই মনে হয়েছে। এইসব মোস্তাকীয় হেরিডিটির মহা পুরুষরাই তো গত পঞ্চাশ বছরে বাংলার রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির ঘুন ধরানো উইপোকা। এরাই তো আজকের দিনে বাংলার অলিগলিতে রাজনীতির টং বানিয়ে উইপোকার ঢিপি বানাচ্ছে। ওদিনের পত্রিকার আরো একটি হেডলাইন আতংকিত হওয়ার মতই বটে। একজন ক্ষমতাসীন সাংসদ তার নির্বাচনী এলাকার তৃণমূলের জনপ্রতিনিধিদের পবিত্র কোরান ছুঁয়ে শপথ করিয়েছেন যেন তারা তার নির্বাচনী প্রতীকের সাথে বেইমানী না করে। রাজনীতির দৈউলিয়াত্ব কোন পর্যায়ে পৌঁছালে এধরনের অনৈতিক ঘটনা ঘটে তা মাথাওয়ালা বোদ্ধারাই বলতে পারবেন। এটা রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অপরাধ কিনা তা তারাই বলবেন যেটা নিয়ে তারা সর্বদা সরব থাকেন।