জালাল উদ্দিন আহমেদ
মজা মারে ফজা ভাই
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৭:৪১ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
প্রবাদটি খনার বচন কিনা জানা নেই তবে এই তির্ষক বক্তব্যের বাক্যটি বহুল প্রচলিত এক উপমা হিসাবে নদি বেষ্টিত এই বাংলাদেশে ব্যবহৃত হয়। কথাটির পূর্ণ রূপ হলো 'মজা মারে ফজা ভাই আমরা শুধু বৈঠা বাই'। অনেকদিন পর দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আঙ্গিনায় কোন এক সচেতন ব্যারিষ্টারের মুখে এই বাক্যটি শুনে আমার বোধদয়ের উনুনে নতুন ক'রে জাগ দিল বোধ হয়। এখানে 'জাগ' অর্থ যোগান দেয়াকে বুঝাচ্ছে। অনেকদিন ধরেই এসব অনিয়মের শোরগোল চারিদিকে চাউর হচ্ছে। কিন্তু আপন উঠান থেকে যখন এই জাগ বা যোগান প্রকাশিত বা উপিস্থাপিত হয় তখন তার মজেজা-ই আলাদা। একটা নতুন ঘ্রাণ ছড়িয়ে সমাজবদ্ধতার এই শুদ্ধ উচ্চারন যেন জনপদে আপন আলোকে উদ্ভাসিত হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা থেকে শুরু করে এর গ্রহনযোগ্যতাও বেশ চাখালো হয়। এই ব্যারিষ্টার কিন্তু বেশ সমাজ সচেতন। তার মিডিয়া সরবতার বিভিন্ন আইটেম দেখে এটাই মনে হয়েছে তিনি শুধু কেতাবী বা কোর্ট আঙ্গিনার সীমানাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চান না। রাজনীতি সচেতনতার সামাজিক জীব হিসাবে তিনি যথেষ্ট পারঙ্গম এক ব্যক্তিত্ত্ব। যাহোক তিনি নিজের ঘরে নিজেই বোমা ফাটিয়েছেন। শুদ্ধ উচ্চারনে তিনি অশুদ্ধ হয়ে যাওয়া মসিলিপ্ত গাউনটি ঝেড়ে কেশেছেন। সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য বটে এই ব্যারিষ্টার!
যে কথা বলে তিনি লাইম লাইটে আসলেন তা সত্যিই সাড়া জাগানো বটে। সরকার ব্যবস্থায় সরাসরি সম্পৃক্ত কিনা জানিনা তবে সরকারী দলের একজন গুরুত্বপুর্ন কর্মী হিসাবে তিনি বহুল আলোচিত। গ্রামে গঞ্জে রাস্তাঘাটে যেখানেই কোন অনিয়ম বা অসংলগ্নতা দেখেন ততক্ষনাৎ সেটাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি সরব হন। সেক্ষেত্রে তার প্রতিটি কভারেজই মোটামুটি জনস্বার্থ সম্পর্কিত এবং সচেতনতামূলক। তবে ইদানীং যে বিষয়টি সামনে এনে তিনি আমাদের সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছেন তা বেশ চিন্তার বিষয় বটে। এক্ষেত্রে একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে সাহস ও সততার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। যেসব আলোচনা ইদানিংকার সময়ে দেশে চাউর হয়ে বিচরন করছে তার মধ্যে সেকেন্ড হোম ও বেগম পাড়ার বিষয়টি প্রথম পাঁচটির মধ্যে একটি। বছর দশেক আগে আমরা এই সংবাদে হতচকিত হয়েছিলাম বটে তবে আশ্চর্য হইনি। বাংলাদেশের প্রতাপশালী ও পরিত্যক্ত রাজনৈতিক মহামুনিম এবং প্রশাসন যন্ত্রের বড় মাপের দুর্নীতিবাজ চাঁইদের কানাডা ও মালেশিয়ায় Second Home বানানোর কীর্তিকলাপ নিয়েই এসব উচ্চারনে আসে বেশী করে। সেসময় এটাকে নিয়ে খুব বেশী হৈচৈ বা শোরগোল হয়েছিল বটে তবে বাঙালী এটা নিয়ে ধাতস্থ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও সেসময় যে খবরটি বেশী করে সাধারন মানুষের মনে দাগ কেটেছিল তা হচ্ছে কোন এক প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন নেতা ও মন্ত্রীর সুপুত্রের নিউইয়র্কের অভিজাত এলাকায় বিশাল এক ছয়তলা বিশিষ্ট ইমারতের ছবিসব লাইভ ভিডিও ফুটেজ। তবে কানাডার টরেন্টোতে গড়ে উঠা অভিজাত বেগম পাড়ার গল্পের সত্যতা আমাদের ছোটবেলায় পড়া এবং শিহরন জাগানো আরব্য রজনীর গল্পকেও হার মানিয়েছে। শুনেছি এবং ভিডিও ফুটেজে দেখেছি একজন সরকারী অফিসের পিয়নেরও সে এলাকায় বাড়ির মালিক হওয়ার চিত্র। একজন মফস্বলের চলমান এমপির "জান্নাতি প্যালেস" এর খবর এবং তার বাস্তবতা আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি।
ইদানীংকালে ক্ষমতাসীনদের সর্বোচ্চ মহল ও প্রশাসন যন্ত্রের অসৎ কর্মচারীদের বাড়ি জমি ও ব্যবসা বাণিজ্যের খবরাখবর এই সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে আমাদের দেখতে হচ্ছে। দেশের টাকা লুট করে বিদেশে বাড়ি গাড়ি বাণিজ্য নিয়ে এসব কুকীর্তির বিষয়টি এখন এক সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে গেছে। এটা নিয়ে ঐসব দুর্নীতি গ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও অসৎ সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে একটি খোলামেলা প্রতিযোগিতা চলছে। তবে মানি লন্ডারিং সুইস ব্যাংক ইত্যাদির বিষয়টিকে ছাপিয়ে এখন যেটা দেশের ভীতকে নাড়িয়ে দিচ্ছে তা হোল বিদেশের মাটিতে তাদের স্থায়ী সম্পদের দৃশ্যমান বাড় বাড়ন্ত। উন্নত ও অভিজাত দেশ সমূহে দৃশ্যমান স্থায়ী সম্পদ বানানোর এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আজকের দিনে বাংলাদেশ নামক এই অভয়ারন্যের তথাকথিত অটোক্রাটিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিরোধহীন ভূখন্ডে পরাক্রমশালী উঁচুতলার মামুষগুলির মধ্যে তৈরী হওয়া এই দুরারোগ্য ক্যান্সার দেশটাকে ফোঁকলা করে দিচ্ছে।। দুবাই আবুধাবিতে কার ক'টা বাড়ি আছে বা কত সম্পত্তি আছে সেটা ছাপিয়ে এখন যেটা আমাদের মত হাড় হাভাতে বাঙালীকে আতংক গ্রস্ত করছে তা হচ্ছে বৃটেন আমেরিকার মত দেশের অভিজাত এলাকায় কার ক'টা বাড়ি আছে সেগুলোর চাঞ্চল্যকর হিসাব নিকাশ। কে সিঙ্গাপুরের সি আই পি হচ্ছেন বা কোন দেশকে বাংলাদেশ সরকার কত মিলিয়ন সাহায্য দিয়ে স্বর্নালী খাতায় নাম লেখাচ্ছে - এটা দেখাতে গিয়ে হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে আমাদের সংবাদ মাধ্যম হয়রান হয়ে যাচ্ছে। আর এসবের সাযুজ্যেই হয়তোবা বেনিয়া ইহুদি বেষ্টিত বিশ্ব সমাজের বিভিন্ন হিসাব নিকাশের প্রতিষ্ঠানগুলির ইদানীংকার প্রতিটি ইনডেক্সে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ ঈর্ষনীয় সাফল্যের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে। জানিনা হিসাব নিকাশের এই অংকে সেই ছোট বেলার বানরের রুটি ভাগ করার অংকটির সংগে সংগতি রেখে করা হয় কিনা! সেক্ষেত্রে আমাদের এতসব ব্রীজ কালভার্ট মেট্রো ফ্লাইওভারের দৃশ্যমান উন্নয়নের সাথে সিঙ্গাপুর-মালেশিয়া কিংবা নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন, ব্যাফেলো টাউন কিংবা লন্ডনের প্রিন্স স্কয়ার অথবা টরেন্টোর বেগম পাড়ার উন্নয়নের সূচক ধরে এসবের ইনডেক্স নির্ধারন করা হয় কিনা তা হিসাবের বাটন বা কলম ধরা মালিকরাই বলতে পারবেন।
দেশের বুনিয়াদ বিনির্মানের এই পরবাসী ভিতের সূত্রপাত হয় গত শতাব্দীর আশির দশকে যখন একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে অবৈধভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সদ্য স্বাধীন দেশে সামরিক ব্যবস্থাপনায় কমান্ডার ইন চীফ হয়ে একজন রিপার্টেড জেনারেল যখন ক্ষমতায় আসলেন তখন দেশের মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তি এক টেবিলের ভোক্তা হয়ে গেল। আরবিয়ান পেট্রোডলারের অবাধ গতি ও তাদের ইসলামী ভাবধারার ইগোকে পুঁজি করে দেশের নব্য মাথারা বাংলাদেশ সৃষ্টির আদি সুত্রটিই ভুলে গেল। আবারো সেই সাতচল্লিশ আদলের 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' জোশের সুত্রপাতে জনজীবনে ধর্মীয় জোশ মাথাচাড়া দেয়া শুরু হলো। পুরনো আয়ুবীয় চাকচিক্যে ফেরার গড্ডলিকায় বাঙালী তার চেতনার শিকড়কে ভুলতে বসলো। ফলে দেশের সামাজিক কঠামোয় নীতি নৈতিকতাবিহীন একশ্রেনীর ভুঁইফোঁড় এলিট শ্রেনীর উৎপত্তি হোল। ডিক্টেটর শাসন ব্যবস্থার সাহচর্যে তারাই একসময় দেশের নীতি নির্ধারক, ব্যবসায়ী এমনকি শাসন যন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি হিসাবে সামনে চলে এলো। নব্বইয়ে গন অভ্যুত্থান হয়ে শাসন ববস্থার পরিবর্তন ঘটলো বটে কিন্তু দেশে আবির্ভূত হোল বংশ পরম্পরার দুই মহা শক্তিধর উত্তরাধিকারী। আর গোষ্ঠীতন্ত্র বা পক্ষ বিপক্ষের মেরুকরনে দেশে তৈরী হলো মাসলম্যান দাদাগিরির এক অভয়ারন্যের অবাধ বিচরন ক্ষেত্র। এরপর এক এগারোর মহা পরক্রমশালী সামরিক মদদের কেয়ার টেকারের বল্গাহীন আচরনে দেশের রাজনৈতিক বুনিয়াদ ছত্রাখান হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছালো। পরবর্তীতে তাদেরই আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে বর্তমান রাজনীতির ধারকরা দেশ শাসনের দন্ডটি নিজের মত করে গুছিয়ে নিল। তবে নৈতিকতার শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়ে যে রাজনীতির কালচার বাংলার মাটিতে সর্বনেশে আবহ তৈরী করলো তার মাসুল কিন্তু আজ বাঙালী কড়াই গুন্ডাই মিটিয়ে যাচ্ছে।
দেশে রাজনীতি আছে কিন্তু রাজনীতির নৈতিক আবহ নেই। গনতন্ত্র আছে কিন্তু কোথাও গনতান্ত্রিক চর্চা নেই। সবকিছু কেতাবী। বাস্তবতায় দেশ এখন জবাবদিহিহীন এক অটোক্রাটিক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে বিচরন করছে। যে স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থার সুত্রপাত গত শতাব্দীর আশির দশকে এই বাংলার মাটিতে শুরু হয়েছে তা বিভিন্ন পর্যায় ও নাম নিয়ে এখন এক ভীমরুলের চাক হয়ে বাঙালীকে অহর্নিশি দংশন করে চলেছে। প্রসঙ্গটি ছিল বাঙালী নেতা আমলাদের বিদেশে সম্পদ বানানো মহোৎসব। বিষয়টি সত্য। নইলে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার যখন ক্ষমতাসীন সরকারের এক ফ্রন্ট লাইনের নেতার আমেরিকায় নয়টি বাড়ি ও সম্পদের ভিডিও ফুটেজ এয়ারে ছাড়েন তখন আমাদের মত অসহায় আমজনতার সেই পুরনো প্রবাদ আওড়ানো ছাড়া আর কিইবা থাকতে পারে। আর সেই প্রবাদটিই হলো আজকের প্রবন্ধের হেডলাইন- মজা মারে ফজা ভাই আমরা সবাই বৈঠা বাই।