জালাল উদ্দিন আহমেদ
হক কথা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ ফেব্রুয়ারী,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:০০ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
লিখিতে চাইনে তবু -লিখতে হবে অনেক
লিখালিখি করতে গিয়ে তৈরী হবে সনেট।
গদ্য লিখি পদ্য লিখি, লিখি প্রেম কাব্য
এই লেখাতেই তৈরী হবে নতুন মহাকাব্য।
-স্বরচিত কবিতা "অতৃপ্তি"র প্রথম চার লাইন দিয়ে আজকের প্রবন্ধের সুত্রপাত করতে চাই। আসলে লেখালেখির এই শাশ্বত ঐতিহ্যটা বাঙালী চিরকালই ধরে রাখতে চায়। এই লেখালেখির জন্য বাঙালীকে অক্সফোর্ড বা হাভার্ডে গিয়ে ডিগ্রি আনতে যেতে হয়না। বাঙালী তার মস্তিষ্ক ও মননের স্বতঃস্ফুর্ত ইনস্টিংটের মেলবন্ধনে অনায়াসে তৈরী করতে পারে ছড়া ও ছন্দের বিশাল সব মহা আয়োজন। তাকিয়ে দেখুন না ঠাকুর বাড়ির জমিদার পুত্রটির দিকে। কিংবা হতদরিদ্র কাজী বাড়ির হা-অন্ন ওই ছেলেটির দিকে। অথচ তাদের লেখনী দিয়ে বাঙালী আজ বিশ্ব সভায় নিজেদের অবস্থানকে উচ্চকিত করেছে। চিন্তা করা যায়, একজন রবীন্দ্রনাথ দুটি স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। এমন কোন্ লেখক বা কবির এই সম্মানটুকু অর্জনে আছে - বলা যাবে কি? আমি জানি না জঠর জ্বালায় জর্জরিত স্কুল না পেরোনো কোন্ কিশোর দেশ মাতৃকার রক্ষা বাহিনীর সৈনিক হয়েও অগ্নিবীনা মহাকাব্য বা অন্যান্য জগন্ময়ী উচ্চারনের মাধ্যমে একটি দেশের জাতীয় কবির মর্যাদাসহ বিদ্রোহী কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মহিয়সী নারী, স্বশিক্ষিত বেগম সুফিয়া কামালের কীর্তিময় সাহিত্য সাধনার কথা আমরা কমবেশী সবাই জানি। বৃহত্তর বরিশালের অজ পাড়াগাঁয়ের এক স্বশিক্ষিত গ্রাম্য বালিকা তাঁর অসাধ্য সাধনে বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনায় নারী আন্দোলনের পথিকৃত হয়ে রয়েছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেগম সুফিয়া কামালের কাব্য সাধনার প্রশংসা করে গেছেন। আবার এক গ্রাম্য গৃহবধু ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও স্বশিক্ষার আলোয় মানুষ তথা সমাজকে আলোকিত করা যায়। সেই গৃহবধু কুসুম কুমারী দাশ লিখলেন,"আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে /কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে"। তখন সে সময়ের পুরুষ প্রাধান্যের বাঙালী সমাজ তাঁর সেই "আদর্শ ছেলে"র পংতিমালাকে অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। বরং তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা 'আদর্শ ছেলে' স্কুল পর্যায়ের জাতীয় পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তার অসাধারন মমতা ও মাতৃ শক্তিবলে তিনি ব্রাহ্ম্য সমাজের আচার্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে আমরা জেনেছি।
শুধু কি কবিতা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই স্বশিক্ষা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে! তা কিন্তু নয়। সঙ্গীত প্রতিভার অঙ্গনেও এর সাবলীল ধারা এভাবেই তার অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিভায় উচ্চকিত হয়েছে। আবারও সেই রবীন্দ্র নজরুলের নাম দুটি সামনে চলে আসে। কারন সংগীত জগতে এই দুই মহারথীর সৃষ্ট সংগীত নিয়েই বাঙালীর এখন প্রাত্যহিক রোজনামচা শুরু হয়। আর বাউল ভাটিয়ালী লালন ও হাসনের গান ও ময়মনসিংহের গীতি কবিতা ছাড়াও আরো বহু অঞ্চলিক গানের সমারোহে আমাদের বাংলা সংগীত জগত সমৃদ্ধ হয়েছে। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের সেইসব মরমিয়া গান আজ বাংলার ঘরে ঘরে বাঙালীর হৃদয় নিংড়ানো উচ্চারনে অনুরনিত হয়। ফকির লালন শাহের আধ্যাত্যিক গানের কথামালা এখন ভূবনজয়ী হয়ে বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং সৃষ্টিশীলতার স্ফুরনে বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সনদ প্রয়োজন হয়না। বরং শিক্ষা সনদ নেয়া ডিগ্রিধারীরা এসব স্বশিক্ষিত স্রষ্টাদের সৃষ্টি কর্ম নিয়ে উচ্ছসিত হন, অনুপ্রেরনা পান। তাদের সৃষ্টি নিয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়াম করে বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে উচ্চকিত হতে চান। আবার রাজনীতি শিল্প-বাণিজ্যেও এমন সব প্রথিতযশা আইকন আমাদের আছেন যারা স্বশিক্ষার আলোকবর্তিকায় বেড়ে উঠে সমাজ তথা রাষ্ট্রে স্ব স্ব ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ও অনুকরনীয় হয়ে চিরঞ্জীব রয়েছেন। আমাদের আবদু মিয়া, রহিম উদ্দিন ভরসা বা আকিজুদ্দিন শেখের কথা না হয় নাইবা বলি কিন্তু বিশ্বজয়ী মার্ক জুকার বার্গ, স্টিভ জবস আর বিল গেটসের কথা উচ্চারনে এলে কি দেখি আমরা! স্কুল পালানো আধুনিক ডিজিট্যাল বা স্মার্ট দুনিয়ার এই পথিকৃতদের সাফল্য গাঁথা কি আমাদের স্মরন করিয়ে দেয় না যে ব্যতিক্রমী হিসাবে আবির্ভূত এইসব স্বশিক্ষিত মনীষী ও মহান ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক স্ফুরনের ফসল হিসাবে আজকের দুনিয়ার যতসব সাফল্যগাঁথা আলোক বর্তিকা হয়ে আমাদেরকে ধন্য করেছে।
জীবন যুদ্ধের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ততায় স্বশিক্ষা ও সুশিক্ষার মেলবন্ধনে ধরনী তার আপন উঠানকে সুশোভিত করেছে। স্বশিক্ষা না থাকলে সুশিক্ষা বিকশিত হতে পারে না। আজকের দিনে স্বশিক্ষার অভাব জনিত কারনেই চারিদিকে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত নামক সার্টিফিকেট ধারীদের বেপরোয়া ও অশিক্ষিত আচরনে সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাভিচার ও অনাচারের ছড়াছড়ি। এটাকে উচ্চশিক্ষা না বলে বরং শিক্ষা নামক কুশিক্ষা বললেও ভুল কিছু হবে বলে মনে হয় না। মানুষকে চার দেয়ালের গন্ডির মধ্যে রেখে নির্দিষ্ট করে রাখা কেতাবী মুখস্ত বিদ্যায় আবদ্ধ করিয়ে তাদেরকে উচ্চশিক্ষার সনদ দিয়ে রাষ্ট্র তথা সমাজ ব্যবস্থার ছড়ি হাতে দেয়া হয়। তাদেরকে মননশীলতা, নৈতিকতা, সহমর্তিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের বুনিয়াদী পাঠক্রমে না রেখে শুধুমাত্র যান্ত্রিক অবক্ষয়ের নির্দিষ্টকৃত পাঠচক্রে বুদ রেখে উচ্চশিক্ষার সনদ দিয়ে রাষ্ট্র তথা সমাজ যন্ত্রের হাল ধরতে হয়। সেক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাবলীল ভিত বিনির্মানের বদলে সেখানে রথের চাকার মত উল্টো দিকে ঘুরতেই স্বাছন্দবোধ করে। ফলশ্রুতিতে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মেকানিজমের মেইন স্ট্রীম হয়ে তারা ঘুনে ধরা উইপোকার ঢিপির মত জনপদের জীবন জীবিকাকে দুর্বিসহ করে তুলে। ফলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডি পাঠের রাষ্ট্র কারিগর না পেয়ে অবক্ষয়ের কানা গলিতে জনপদে আহাজারি শুরু হয়।
একথা অনস্বীকার্য যে সৃষ্টির আঁতুড় ঘরে নেই কোন ডিগ্রির আধিক্য বা চাহিদা। সেখানে আছে শুধু মন ও মননের মস্তিষ্ক স্ফুরনের স্বতঃস্ফুর্ততা। সেক্ষেত্রে স্বশিক্ষা ও সুশিক্ষার মেলবন্ধন তৈরী করে সৃষ্টির ভান্ডারে যোগ করতে হবে দৃষ্টিযোগ্য সহাবস্থান। নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের বাতাবরনে স্বশিক্ষার আলো সুশিক্ষার গতিপথকে সাবলীল কলেবরে সামাজিক সুষ্ঠতায় ভরে তুলুক - এটাই প্রত্যাশা। স্বশিক্ষা ও সুশিক্ষার মেলবন্ধনে মানব জীবন ধন্য হোক, ধরনী ধন্য হোক।