জালাল উদ্দিন আহমেদ
রেল ভ্রমন
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ জানুয়ারী,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৪০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
অভিজ্ঞতা বটে! একবিংশের অভিজ্ঞতা। ডিজিট্যালের অভিজ্ঞতা। কোনপথে হাঁটছি আমরা? সঠিক উত্তরটা কি - আমরা কি কেউ জানি! জানলেও বলার উচ্চকন্ঠ আজ মৃয়মান। উচ্চস্বরের বলিষ্ঠ কন্ঠে সুবচনটি উচ্চারনের মানুষটি আজ খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুস্কর। বছর তিরিশেক আগের কথা। তখন কর্মক্ষম ছিলাম। জাতীয় স্বার্থে এবং নিজের কর্মধারার যোগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। বর্তমানের কর্মহীন সময়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কদাচিত ছেলে মেয়েদের বা আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে যেতে হয়। বাংলাদেশে রেলভ্রমন অভিজ্ঞতা খুব বেশী না হলেও ঢাকা সিলেট, ঢাকা চট্টগ্রাম, ঢাকা রাজশাহী ইত্যাদি রুটে চলাচলের ছোটখাট অভিজ্ঞতা আছে। তবে তা খুব সুখকর নয়। এই নয়ের ব্যাখ্যাটা দিতে গেলে সে এক মহাভারত হয়ে যাবে হয়তো। তবে এই হয়-নয় এর বিষয়টি নিয়ে আগে হয়তো এত ভাবতাম না। এখন ভাববার কিছু নেই বলেই হয়তো সামনে যা আসে তাই নিয়ে চিরুনী বিশ্লেষনে লেগে পড়ি। তবে অমূলক কি না তা ভাবার অবকাশ আছে বৈকি!
গ্রামের ছেলে। তবে শহর ঘেঁষা গ্রাম বলেই হয়তো একটা শহুরে ছোঁয়া নিজের মধ্যে ছিল। অবশ্য মহকুমা শহরের গন্ডির মধ্যেই তা আবদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পঞ্চাশটি বছর পেরিয়ে গেছে। তেড়েফুঁড়ে না হলেও স্বাধীনতা প্রাপ্তির এতগুলো বছর পরে বাঙালী আত্ম মর্যাদায় নিজেদেরকে দাঁড় করিয়েছে তা কিন্তু বলা যায়। তবে তার গতি প্রকৃতি ভিন্ন ধাঁচে হচ্ছে এটাও খালি চোখে দেখা যায়। বুনিয়াদ বিনির্মানে শিকড়ের বিনুনিগাঁথা সৃষ্টি না করে চাপিয়ে দেয়া উন্নয়নের বহর সাজিয়ে চমক দেখানোর যে মহা আয়োজন চলছে তা কতটুকু সফলতা নিয়ে আসবে সেটা সময়ই বলে দেবে। তবুও আমরা এগোচ্ছি। মহা সমারোহে চলছে দেশের তথাকথিত উন্নয়নের উর্ধগতি। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে শ্রমশক্তির অবাধ প্রপ্যতায় হয়তো শিকড়ের সম্পৃক্ততা দৃশ্যমানতায় আসছে, তবে গ্রাম বাংলার বুনিয়াদ বিনির্মানে তৃণমূলে কতটুকু সুবাতাস বয়ে দিতে পারছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। পাশাপাশি জন গন মন অধিষ্ঠানের গণপ্রজাতন্ত্রী মন্ত্রধারায় দেশ শাসনের ব্রত তার প্রকৃত মূলমন্ত্রে দন্ডায়মান আছে কিনা সে প্রশ্নও থেকে যায়।
আসি মূল কথায়। প্রসঙ্গ রেল ভ্রমন। সে এক বিরস কাহিনী। যেতে হবে রাজশাহী। রাস্তা তিন পথে। বায়ুপথ রেলপথ সড়কপথ। সড়কপথের ঝক্কি পোহানো - বয়সে সায় দেয় না। আকাশ পথের জটিলতায় টিকেট দুষ্প্রাপ্য। ট্রেন বা রেলপথের টিকেট মাঝে মধ্যে অমাবস্যার চাঁদ হলেও ওটার দেখা মেলে ঠিকই। তবে কমলাপুরে গিয়ে ট্রেনে উঠতে গেলেই মনে হয় যেন সাভার অতিক্রম করেই তারপর ট্রেনে উঠতে হবে। অবশ্য মেট্রো বা উড়ালপথ ইত্যাদি চালু হলে এসব বিপত্তি আর থাকবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া ইদানীকার রেল সেবার যেসব গুনকীর্তন শোনা যায় তাতে করে রেলে না চড়ার অক্ষেপ থেকে যাবে বিধায় রেল ভ্রমনটাই শ্রেয় মনে করে ঢাকা-রাজশাহী রূটের সর্বাধুনিক ও সর্বোচ্চ গতিময়তার সর্বশেষ সংস্করন "বনলতা একপ্রেস" ননস্টপ ট্রেনেই রাজশাহী ভ্রমনের ইচ্ছা মঞ্জুর করা হোল। মাত্র চার ঘন্টা তিরিশ মিনিটের রাস্তা। যথা সময়ে নির্দিষ্ট দিনের টিকেট হাতে এল। ১৮ জানুয়ারী, বুধবার, ২০২৩ সাল। ট্রেন ছাড়বে ১-৩০ মিনিটে। রাস্তা জ্যামের ভয়ে সকাল ১১-০০টায় রওনা দিলাম কমলাপুর রেল স্টেশনের দিকে। কেন যেন ভাগ্যটা ভালই মনে হচ্ছিল। সোয়া এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম দশ কিলোমিটার দূরত্বের কমলাপুর রেল স্টেশন। আর সঠিক সময়েই প্রিয় বনলতা হুইসেল বাজিয়ে কমলাপুর স্টেশন ত্যাগ করলো। সরকারী পরিসেবা। ট্রেনের কি অবস্থা বা তার ভিতরের সেবা পরিসেবার কি হাল হকিকত তা না হয় অন্য কোন এক সময় বলা যাবে। এখন আমরা "ননস্টপ এক্সপ্রেস" নামের যথার্থতা নিয়েই না হয় একটু আলোচনা করি।
ঢাকার বিশ পঁচিশ কিলোমিটারের দূরত্ব ঢাকার মত করেই চলতে হয়েছে। তবে নিয়ম রক্ষার তাগিদে বিমান বন্দর স্টেশনে মিনিট দশেক দাঁড়িয়েছে আমার সেদিনের বাহন বনলতা এক্সপ্রেস। শুনেছি বেশ দ্রুতগতির এই ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ের পাঁচ দশ মিনিট আগে বা পিছে তার গন্তব্যে পৌঁছে যায়। কিন্তু একি হাল দেখছি রাজশাহীর স্বপ্নের এই ননস্টপ বনলতা এক্সপ্রেসের। জয়দেবপুর স্টেশনে থেমে গেল। তাও মিনিট বিশেক হবে। কোন সাড়া নেই, শব্দ নেই। নেই কোন ঘোষনা। নাহ্, আমি কোন বড় ঘোষনা শুনতে চাই নি। কোন দুর্ঘটনার ঘোষনা, কোন লাইনচ্যুতির ঘোষনা এমনকি রাজনৌতিক অবরোধ কর্মসুচির ঘোষনা। স্রেফ একটি ছোট্ট বাক্য। "অমুক কারনে আমাদেরকে দাঁড়াতে হয়েছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত"। অভিজাত চলাফেরায় এধরনের ছোটখাটো পরিসেবার সংযোজন অবশ্য কর্তব্য বলে প্রতিটি যাত্রী আশা করতেই পারেন। আবার টঙ্গাইলে থামানো হলো প্রায় আধা ঘন্টা। যমুনা সেতু পারাপারের নির্ধারিত প্রস্তুতি সেটাও আধা ঘন্টা খেয়ে ফেললো। তারপরে যমুনার ছয় কিলোমিটার পেরোতেই গেল বেশ কয়েক মিনিট। যমুনা পেরিয়েও থামলো বেশ কিছুক্ষন। এরপর উল্লাপাড়া স্টেশনে অনেকক্ষন। কি মসিবত! ঈশ্বরদিতেও প্রায় আধা ঘন্টা। কি হোল আজকের যাত্রায়। নাকি যাত্রা অশুভের পাল্লায় পড়ে আজকের বনলতা সেনের এই দশা! রাত্রি সাড়ে আট'টায় পৌঁছলাম রাজশাহীতে। অর্থাৎ মোটামুটি দু'ঘন্টার অতিরিক্ত সময় লাগলো।
শুনেছি, বনলতা বা সুবর্ন এক্সপ্রেস যখন চলে তখন অন্য ট্রেনগুলি তাদের গতি অবাধ করার জন্য নিজেদের যাত্রাপথে থেমে ঐসব সুপার এক্সপ্রেসদের রাস্তা ছেড়ে দেয়। আজকে তো দেখলাম, বনলতাই অন্যদের স্যালুট জানিয়ে নিজেই অন্যদের অবাধ গতিপথ তৈরী করে দিচ্ছে। এর ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। তবে সুপার এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে ডিজিট্যালের স্মার্ট সার্ভিস হাতেনাতেই ভোগ করলাম। ভয়ানক না হলেও কিছুটা যন্ত্রনাদায়ক তো বটেই। এর কোন জবাবদিহিতা আছে কিনা জানিনা। তবে উত্তর বঙ্গের মানুষজনের ধৈর্য্য যে সাধারন বাঙালীদের মত নয় তা কিন্তু টের পেলাম আজকের এই সুপার এক্সপ্রেস "বনলতা"র ট্রেন জার্নিতে। কোন হৈচৈ নেই। নেই কোন হট্টগোল বা বাক বিতন্ডা। যাত্রা কালীন সেবা পরিসেবার কথাটা না হয় উহ্যই রাখলাম। তবে মাথাভারি প্রশাসনের দিব্যচিত্র এবং তার রাশভারি সহায় সম্পদের ছড়াছড়ি যখন রাজশাহীতে এসে দেখলাম তখন আর বুঝতে বাকী রইলো না যে সেই ষাটের দশকের মটো নিয়ে রাজা-প্রজার সম্পর্কের মধ্যেই আছে আমাদের আজকের রেল সেবার পরিধি। তাছাড়া পশিমাঞ্চলীয় হেডকোয়ার্টার রেলভবনের প্রশাসনিক চত্ত্বরে যে কায়দায় রাজনৈতিক পোস্টার ব্যানার ফেস্টুন লাগানো আছে তাতে করে চেনার জো নেই যে প্রকৃতপক্ষে এটা সরকারী প্রশাসনিক ভবন না রাজনৈতিক কোন কার্যালয়।
ক্ষমা করবেন। রেল এগিয়ে যাচ্ছে। এক'শ বছর আগে বৃটিশদের করে দেয়া রেল যত্রার লাইনটা ঠিক রাখার জন্য অন্ততঃ মাঝেমধ্যে কয়েক'শ টন ব্লেশ পাথর ছিটিয়ে ওর ভীতটাকে মজবুত করার ব্যবস্থাটাও তো নেয়া যায়! তাছাড়া যমুনা ব্রীজের উপর দিয়ে আট-নয়'শজন জীবন্ত মানুষ নিয়ে যেভাবে ট্রেনটি পার হচ্ছিল তাতে করে ওইসব যাত্রীকুলের দোয়া দরুদ পড়ে বুকে ফু দেয়া ছাড়া আর কোন অনুভূতি থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়নি। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের হেফাজত করুন। সবার রেলযাত্রা শুভ হোক।