পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু: কী ভাবছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১১:৪৯ পিএম, ২২ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ০১:০৭ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ নতুন নয়, অনেক পুরনো। বিভিন্ন সময়ে থানা, ফাঁড়ি কিংবা গোয়েন্দা হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা আলোচিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেলের মৃত্যুর ঘটনায় ডিবির তখনকার সহকারী কমিশনার (এসি) আকরাম হোসেন আলোচনায় আসেন। আর সর্বশেষ সিলেটের বন্দর বাজার ফাঁড়িতে নির্যাতনে রায়হান আহমেদ নামের এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় এখন পুরো দেশ তোলপাড়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বরাবরই হেফাজতে নির্যাতন, মৃত্যু ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে আসছে। অপর দিকে, অপেশাদার আচরণ থেকে বিরত থাকতে পুলিশের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্ন সময় নির্দেশনা দেওয়াসহ পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। তারপরও হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়মিত নজরদারি বা মনিটরিং থাকলে হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।
১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র শামীম রেজা রুবেল। এ ঘটনায় ২০০২ সালে প্রধান অভিযুক্ত ডিবির এসি আকরাম হোসেনসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় নিম্ন আদালত। কিন্তু ২০১১ সালে একমাত্র হায়াতুল ইসলাম ঠাকুরের সাজা বহাল রেখে এসি আকরামসহ অন্যদের খালাস দেন হাইকোর্ট। ২০১৭ সালে আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইনে দায়ের করা মামলায় প্রথম রায় হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর (২০২০)। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে এ রায় ঘোষণা করা হয়। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এই আইনে দায়ের করা মামলায় এটিই দেশের ইতিহাসে প্রথম রায়। যদিও হেফাজতে নির্যাতন, মৃত্যু (নিবারণ) আইন বাতিল চায় পুলিশ। বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এই আইন বাতিল চেয়ে আবেদন করে পুলিশ বাহিনী। ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে জনি নামে এক যুবককে মারার অভিযোগ এনে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি দায়ের করেন নিহতের ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি। ৯ সেপ্টেম্বর (২০২০) রায়ে আদালত এসআই জাহিদুর রহমানসহ তিন পুলিশ সদস্যকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আর পুলিশের দুই সোর্সকে দেওয়া হয় সাত বছর করে কারাদণ্ড।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মাসুদ রানা (৩৩) নামের এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ করেছে তার পরিবার। সর্বশেষ গত ১১ অক্টোবর সিলেটের বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে মাত্র ১০ হাজার টাকা ঘুষের জন্য পুলিশ সদস্যদের নির্মম নির্যাতনে রায়হান আহমেদ (৩৫) নামে আরেক যুবকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সিলেটসহ পুরো দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথমে গণপিটুনিতে রায়হান মারা গেছে বলে দাবি করা হলেও অবস্থা বেগতিক দেখে বন্দর বাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন পালিয়ে যান। এরপর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পুলিশের বিভিন্ন বিভাগ থেকেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আকবর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখতেও সর্বশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করে পুলিশ সদর দফতর।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও ‘ক্রসফায়ারে’ ২১৬ ব্যক্তি মারা গেছেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’, ‘গুলিবিনিময়’ ও এনকাউন্টারে নিহত হন ১৮৫ জন। এ সময়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মারা যান ২৭ জন।
থানা কিংবা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিনি সবসময় পুলিশ সদস্যদের অপেশাদার আচরণ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে আবারও সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে কোনও পুলিশ সদস্য এ ধরনের কাজ না করেন। আর কেউ করলে সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত দায় বলে গণ্য হবে। সে ক্ষেত্রে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাহিনী কোনও দায় নেবে না। থানাগুলোতে সিসিটিভি ফুটেজও সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। অভিযোগ আসলে সেগুলো দেখেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় টেকনাফের ওসি প্রদীপ ও এসআই লিয়াকতসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য এখন কারাগারে আছেন। এটিও সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত ঘটনা। সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি ছাড়াও কক্সবাজার পুলিশে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালানো হয়। এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে যোগ দিয়েছেন আনোয়ার হোসেন।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের পক্ষ থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বা কী ভাবছেন, জানতে চাইলে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়মিত সুপারভিশন ও মোটিভেশন প্রয়োজন। থানা, ফাঁড়ি, তদন্ত কেন্দ্র— পুলিশের প্রশাসনিক কাঠামোটা খুব সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। এগুলোকে তদারকি করার জন্য সিনিয়র অফিসাররা আছেন। তারা যদি প্রতিদিন বা একদিন পরপর থানা, ফাঁড়ি, তদন্ত কেন্দ্র পরিদর্শন করেন, সবাইকে নিয়ে একটা ব্রিফিং করেন, কে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে, সেগুলো তদারকি করেন— তাহলে এসব বিষয় কমে আসবে।’
ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একটা বাহিনীতে দুই-একজন খারাপ থাকতেই পারে। এই খারাপ সদস্যদের চিহ্নিত করে বেশি নজরদারিতে রাখতে হবে। এরপরও যদি সেই খারাপ সদস্য ঠিক না হয়, তাহলে তাকে সোজা প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে এনে বসিয়ে রাখতে হবে। বলতে হবে, জনস্বার্থে তোমাকে পুলিশ লাইনে বসিয়ে রাখা হলো। আমার পুলিশ লাইনে এখনও অর্ধ শতাধিক পুলিশ সদস্যকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদের সতর্ক করা হচ্ছে নিয়মিত।’
থানায় ও ফাঁড়িতে সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বেশিরভাগ জায়গাতেই সিসিটিভি আছে। হয়তো কিছু বাকি আছে। আবার কিছু নষ্টও থাকে। সিসিটিভি ফুটেজগুলো একমাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয়। এরপর অপ্রয়োজনীয়গুলো বাদ দেওয়া হয়।’
পুলিশের হাতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি কার কাছে বিচার চাইবে ও সেই প্রক্রিয়াটা কী? জানতে চাইলে ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কেউ সাব ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে নির্যাতিত হলে ওসি বা ইন্সপেক্টরের কাছে যাবেন। না হয়, দু’টি থানা মিলে একটি সার্কেল আছে, সেই সার্কেল অফিসারের কাছে যাবেন। সরাসরি সিনিয়র অফিসারের কাছে চলে যাবেন। গিয়ে বলবেন যে, আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি।’
থানায় কিংবা ফাঁড়িতে হেফাজতে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগের এআইজি মো. সোহেল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হেফাজতে নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনাই গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশনেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশি নির্যাতনের কোনও ঘটনায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হবেন। থানার ওসি, সার্কেল বা জোনাল এএসপি, জেলার এসপি বা জোনাল ডিসি, রেঞ্জ ডিআইজি বা মেট্রোপলিটন কমিশনারের কাছে গিয়ে প্রতিকার চাইতে পারবেন। এছাড়া, পুলিশ সদর দফতরের আইজিপির কমপ্লেইন সেল রয়েছে। পুলিশের নিচের ধাপগুলোতে উপযুক্ত সেবা বা প্রতিকার না পেলে আইজিপি কমপ্লেইন সেলে যেকেউ অভিযোগ করতে পারেন। বাংলাদেশ পুলিশের কেন্দ্রীয় ওয়েবসাইটেও এর লিংক রয়েছে।
উৎসঃ বাংলা ট্রিবিউন