আশা যেন দুরাশায় পরিণত না হয়
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ জানুয়ারী,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩২ পিএম, ২৫ জানুয়ারী,শনিবার,২০২৫
নতুন বছর আশা নিয়ে আসে। মানুষের আশার তো শেষ নেই। এর মধ্যে অন্যতম হলো- দিনবদলের আশা। আশা করা হয় দিন বদলাবে। কিন্তু আশাহত হওয়ার কারণটা প্রতিবারই অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। এর মধ্যে আশাহত হওয়ার বড় একটা কারণ দিন বদলায় না, সেই পুরোনো প্রায় সবকিছু থেকে যায়। উপরন্তু কখনও কখনও অধিক মর্মবেদনার কারণ সৃষ্টি হয়- এমন অনেক নজিরও আছে আমাদের সামনে। এসবই অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত। এই যে দিন বদলায় না এ কারণেই পুরাতন ও একঘেয়ে কাহিনি নতুন করে বলতে হয়। দিন না বদলাবার কারণ অনেক। তার মধ্যে অন্যতম ব্যাধি পুঁজিবাদ। এই ব্যাধি থেকে মুক্তির চেষ্টা চলছে সেই কবে থেকে; কখনও রাজনৈতিকভাবে কখনও সামাজিক-সংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমরা সফল হইনি। এটাই সত্য।
গত প্রায় দু'বছর ধরে বিশ্বব্যাপী করোনা-দুর্যোগ চলছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটির বারবার রূপ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশ্বে ফেলেছে বিপর্যয়ের ছায়া। গত বছরও আমরা এমনটি দেখেছি। এর বাইরে নই আমরাও। আমরা নতুন বছরের দ্বারে পা রাখলাম আবার করোনার ধরন পরিবর্তনের খবর সঙ্গী করে। এই নতুন ধরন 'ওমিক্রন' ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে ছড়িয়ে গেছে। আমাদের এখানেও এর সন্ধান মিলেছে। 'ওমিক্রন' বিশ্বের কোনো কোনো দেশকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। বিদায়ী বছরে সরকার টিকা কেনা ও সংগ্রহ করে দেশে এর প্রয়োগ শুরু করেছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এখন পর্যন্ত দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনা যায়নি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে টিকার বুস্টার ডোজও। স্বাস্থ্য খাতের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা পুরোনো। কিন্তু করোনা-দুর্যোগে তা আরও ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। অব্যবস্থাপনার উৎকট চিত্র চোখে পড়ে এ খাতে।
নানা দিকেই তো আমরা দুর্যোগাক্রন্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই, মানুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগও কম নয়। নিরাপত্তাজনিত সংকটে মানুষ ভুগছে। এও পুরোনো চিত্র। শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে পথে-ঘাটে নিরাপত্তাহীনতার ছায়া। বিদায়ী বছরে অনেকগুলো মর্মান্তিকতার মুখোমুণি আমাদের হতে হয়েছে। এর জন্য দায়ী ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও ব্যক্তি বা মহল বিশেষের স্বেচ্ছাচারিতা। আমাদের স্মরণে আছে, নারায়ণগঞ্জে হাশেম ফুডসের একটি কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ও স্বেচ্ছাচারিতায় সেই মর্মান্তিকতার ছায়া আরও বিস্তৃত হয়েছিল। পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের মর্মন্তুদ ঘটনাও এর বাইরে নয়। বছরের প্রায় শেষ দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে যে বীভৎসতার সৃষ্টি হলো তাও অনেক প্রশ্নই দাঁড় করায়। এভাবে কি মানুষকে অব্যবস্থাপনার খেসারত দিতে হবে একের পর এক ঘটনায় জীবন দিয়ে?
বছরজুড়েই নারী নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে এক ছাত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তদের আস্ম্ফালন বন্ধ করা যাচ্ছে না। বছরের শেষ দিকে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে স্বামী ও সন্তানকে জিম্মি করে নারীকে দফায় দফায় ধর্ষণের যে বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে- সমাজে মূল্যবোধের ধস কি ভয়াবহভাবে নেমেছে! রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দেশে দুর্বৃত্তদের বিচরণের খবর নতুন নয়। কক্সবাজারেও তা-ই দেখা গেল। সামাজিক চাপে নারী ও শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন বিধিবদ্ধ হয়েছে, কিন্তু এরপরও এই ব্যধি নির্মূল তো দূরে থাক নিয়ন্ত্রই করা যাচ্ছে না। কেন? ব্যবস্থা বদলানো যায়নি। এবং এ জন্যই আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী হওয়ার উৎসাহ জুগিয়ে চলছে যে পুঁজিবাদ এর দ্বারা মানুষ নিষ্পেষিত।
দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ চলছে মূলত এক ধারায়। বহু ধারার পথ সংকুচিত। গত বছর শুরু হওয়া স্থানীয় সরকারের নিম্নস্তর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাত-সহিংসতায় হতাহতের যে চিত্র এরই মধ্যে দেখা গেল তাও রাজনৈতিক অবক্ষয়েরই ভয়াবহ কুফল। এই নির্বাচনের আরও ধাপ বাকি রয়েছে। বিরোধী পক্ষবিহীন এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলছে গৃহদাহ আর এর মাশুল গুনছে দেশের সাধারণ মানুষ। নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা-অক্ষমতা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কথা হয়েছে, হচ্ছে কিন্তু দায়িত্বশীলদের নেই কোনো শিরঃপীড়া। গত বছর আমরা স্বাধীনতার বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করলাম। কিন্তু যে লক্ষ্যে জাতি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল সেই লক্ষ্যগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন কেন ৫০ বছরেও সম্ভব হয়নি- এসব প্রশ্নের উত্তর জটিল নয়।
এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আশা নিয়ে এলো নতুন বছর। সমাজের প্রায় সর্বত্র চলছে হীন প্রতিযোগিতা। কে কাকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাবে, কাকে ধাক্কা দিলে বিজয়ের প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে- সেটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান ঘটনা। ব্যক্তির উন্নতির এই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সমষ্টি ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন যা নির্বাচনের মাধ্যমে আসবে না; আসবে সমাজ বিপ্লবের রূপান্তরের পথে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো ছিল আসলে সমাজ বিপ্লবেরই চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত পঞ্চাশোত্তর বাংলাদেশকে সেই বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় বলিষ্ঠ হোক নতুন বছরে। নতুন বছর অনেক আশা নিয়ে এসেছে তা দুরাশায় পরিণত না হলেই মঙ্গল।