পশ্চিমাদের টিকা বৈষম্যের ফল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ নভেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০২:০০ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বিশ্বব্যাপী ব্যাপক টিকা কার্যক্রমের পর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডব কিছুটা স্থিমিত হয়ে আসার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ বুকভরা আশা নিয়ে সুদিনের আশায় প্রহর গুনছিল এই ভরসায় যে শিগগিরই হয়তো এ দুঃসময় বিদায় নেবে। কিন্তু পশ্চিমাদের কপটতা, স্বার্থপরতা, টিকাবৈষম্য আর মেধাস্বত্ব আঁকড়ে ধরে রাখার হীন মানসিকতা বিশ্বকে আরো একটি নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্টের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এমতাবস্থায় টিকা কার্যক্রমের পাশাপাশি টিকাবৈষম্য আর টিকা বর্ণবাদের ভূত দূর করে সম্মিলিতভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় নেই মর্মে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন। তিনি গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন। নয়া দিগন্তের পাঠকদের উদ্দেশে আলাপচারিতার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের পর আবার নতুন করে আরেকটি ভয়ঙ্কর ওমিক্রনের আবির্ভাবের জন্য কাকে দায়ী করবেন?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : প্রথমত, বিশ্ববাসী এখন এক বাক্যেই বলবে যে এর মূল কারণ পশ্চিমা বিশ্বের চাপিয়ে দেয়া ভ্যাকসিন ইনইকুইটি বা টিকাবৈষম্য। এত দিন পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ধনী দেশগুলোকে টিকা দান করতে এবং মেধাস্বত্ব ছাড় দিয়ে স্বল্প ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন গেল শুক্রবার ২৬ নভেম্বর। অথচ কিছুদিন আগেও পশ্চিমা বিশ্ব মেধাস্বত্ব ছাড় দিতে ক্রমাগত অস্বীকার আর প্রয়োজনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি টিকা মজুদ করে আসছিলেন। এক সময় গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর উন্নয়নের দোহাই দিয়ে পশ্চিমারা দশকের পর দশক ভাগাভাগি করে আফ্রিকা শাসন করেছে। এরপর স্বাধীনতাকামীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ যখন ছেড়ে গেছে তখন দুর্ভিক্ষ আর হানাহানি ছাড়া আর কিছুই দিয়ে বিদায় হতে পারেনি। এখন করোনা মহামারী দমনে একই রকম কপটতার কারণে বিশ্ব বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশ ও গরিব দেশগুলো আজ টিকাবৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বিশ্ব আরেকটি নতুন ভয়ঙ্কর করোনা ভ্যারিয়েন্টের হুমকির মুখোমুখি।
দ্বিতীয়ত, পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে আফ্রিকা মহাদেশই টিকা অসচেতনতায় সবচেয়ে এগিয়ে। এমনকি আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে উন্নত দেশ বলে খ্যাত, সেই দক্ষিণ আফ্রিকাও টিকা অসচেতনতায় এগিয়ে থাকার কারণে আজ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের জন্মভূমির তকমার ভাগীদার হয়ে গেল।
তৃতীয়ত, আফ্রিকা মহাদেশ স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারেও অনেক পিছিয়ে। তার প্রমাণ হলো, গত সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকান সরকার সে দেশের ড্রাগ কোম্পানিগুলোকে সরবরাহের গতি শ্লথ করার অনুরোধ করেছেন জনগণের দিক থেকে ক্রমাগত কম চাহিদার কারণে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের মাতৃভূমি দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশের যদি এই অবস্থা হয়, অন্য আফ্রিকান দেশগুলোর কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়।
চতুর্থত, এখন তাদের দেশে মাত্র ৩৫% লোক দুই ডোজ টিকা সম্পন্ন করেছে। সারা পৃথিবীতে যেখানে গড়ে এ পর্যন্ত ৫৪% লোক কমপক্ষে এক ডোজ টিকা সম্পন্ন করেছে, যেখানে আফ্রিকার অনেক দেশসহ গরিব বিশ্বের মাত্র ৫.৭% লোক একটি ডোজ টিকা সম্পন্ন করেছে। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের কোনো কোনো দেশ বুস্টার ডোজ টিকা পর্যন্ত দিয়ে দিচ্ছে। টিকা গ্রহীতার এই যে পার্থক্য তাই করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের উৎপত্তির আরেকটি অন্যতম কারণ।
পঞ্চমত, এখন হলো করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার উপযুক্ত সময়। টিকা দান কর্মসূচি জোরেসোরে অব্যাহত থাকার মধ্যেই (২৪ নভেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত ৭৫% আমেরিকান অন্তত এক ডোজ টিকা প্রাপ্ত) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে গত দুই সপ্তাহে ১০ শতাংশ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে গড়ে ৮৭ হাজার ১৯৫ জন নতুন আক্রান্ত, ৫২ হাজার ২৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি এবং এক হাজার ১৩ জনের মৃত্যু হচ্ছে।
প্রশ্ন : এই যে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের কথা বলা হচ্ছে, এই ভ্যারিয়েন্টগুলোর উৎপত্তি কিভাবে হয়?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কথা বলতে গেলে করোনাভাইরাসের গঠন ও চরিত্র সম্পর্কে জানা অত্যাবশ্যক। ভ্যারিয়েন্ট হলো চীনের উহানে আবিষ্কৃত অরিজিনাল করোনাভাইরাসের বারবার মিউটেশনের পর নতুন এমন একটি কার্যকরি অবস্থায় রূপান্তর হওয়া, যা ভিন্ন চরিত্র প্রদর্শন করে। সব মিউটেশন বা ভ্যারিয়েন্টই ক্ষতিকর না।
করোনাভাইরাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো জেনেটিক মাইনর কিংবা মেজর ভ্যারিয়েন্ট হয়েছে সেগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা ও গুরুত্বের ওপর ভিত্তি করে ভ্যারিয়েন্টস অব মনিটর, ভ্যারিয়েন্টস আন্ডার ইনভেস্টিগেশন, ভ্যারিয়েন্টস অব ইন্টারেস্ট, ভ্যারিয়েন্টস অব কনসার্ন এবং ভ্যারিয়েন্টস অব হাই সিকুয়েন্সেস- এই পাঁচ ভাগে ভাগ করেছে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট হলো এ পর্যন্ত ঘোষিত আল্ফা, বিটা, গামা এবং ডেল্টা-এই ৪টি ভ্যারিয়েন্টস অব কনসার্নের পর আরো মারাত্মক পঞ্চম ধরনের ভয়ঙ্করতম ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন।
করোনাভাইরাস হলো একটি ইলেকট্রোন মাইক্রোস্কপিক পরজীবী প্রোটিন পার্টিকেল যার সাইজ ৩০-১৩০ ন্যানোমিটার (এক সেন্টিমিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগ হলো এক ন্যানোমিটার)। এটা মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত। প্রথমত, এটির কেন্দ্রে থাকা রাইবোনিউক্লিক এসিড, দ্বিতীয়ত, তাকে তোয়ালের মতো করে পেঁচিয়ে থাকা নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন, তৃতীয়ত, এই উভয়টাকে ঘেরাও করে থাকা লিপিড বাইলেয়ারের মেমব্রেন। এই লিপিড বাইলেয়ারের গাত্রে লাগানো থাকে তিন ধরনের প্রোটিন-মেমব্রেন গ্লাইকোপ্রোটিন, এনভেলপ প্রোটিন এবং ব্যাংগের ছাতার মতো স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন।
ভাইরাসের সব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য জেনেটিক মেটারিয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জেনেটিক কোডকে ভাইরাসের ব্রেইন বলা যায়। এক কথায় বলা যায়, আরএনএ হলো কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার এবং জেনেটিক কোডটি হলো সফটওয়্যার। সুতরাং ভাইরাসের অভিযোজন প্রক্রিয়ায় জেনেটিক কোডের পরিবর্তন ও নির্দেশনা অনুসারেই স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন আসে।
আমরা জানি, প্রকৃতিতে মোট ২০টি এমাইনো এসিড আছে। একটি স্পাইক প্রোটিন হলো ১২৭৩টি পয়েন্টে ২০টি বিভিন্ন ধরনের এমাইনো এসিডের পুঁথির মালার মতো করে সাজানো একটি চেইন। এই ২০টি এমাইনো এসিড ১২৭৩ পয়েন্টের কোনটি কোন জাগায় বসবে তা ভাইরাসের আরএনএতে থাকা জেনেটিক কোড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একটি করোনাভাইরাসে গড়ে ৭৮টি স্পাইক প্রোটিন থাকে। স্পাইক প্রোটিনের সংখ্যা বাড়লে সংক্রমণ ক্ষমতাও বেড়ে যায়।
করোনাভাইরাসে অন্তত তিনটি এন্টিজেনিক ও সংক্রমণশীল অংশ রয়েছে। এর মধ্যে করোনার স্পাইক প্রোটিনগুলো হলো সবচেয়ে এন্টিজেনিক এবং বহুমাত্রিক কার্যসম্পাদনকারী মলিকুলার মেশিন। এই স্পাইক প্রোটিনের একটি অংশের নাম রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন (আরবিডি) যেখানকার এস১ রিসেপ্টর দিয়ে হোস্ট সেলের সারফেসে থাকা এসিই-২ এর সাথে সংযুক্ত হয়ে ভেতরে ঢোকে।
তাদের এই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করার কারণ হলো, স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশে এবং তার বাইরে অনেকগুলো অংশে মিউটেশনের ঘটনা। স্পাইক প্রোটিনের আরবিডি অংশে যেখানে ডেলটায় মিউটেশন হয়েছিল দু’টি আর ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে সেই অংশে মিউটেশন হয়েছে দশটি। যত বেশি মিউটেশন তত বেশি মারাত্মক হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের ৪১৭ থেকে ৫০১ নম্বর এমাইনো এসিডগুলোই আরবিডি, যা কোষে লেগে আমাদের দেহের ভেতরে প্রবেশ করে। বলতে গেলে এটি মানব কোষে ঢোকার টিকিট, যার থাকবে সে নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে ঢোকার সুযোগ পাবে।
ভাইরাসের মিউটেশন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। মিউটেশন আর কিছুই না জাস্ট এক এমাইনো এসিডের পরিবর্তে আরেক এমাইনো এসিড বসা। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের জিনোম বা নিউক্লিউটাইড সিকোয়েন্সে কয়েক হাজার এমাইনো এসিডের অদল-বদল হয়েছে। এভাবে দুইয়ের অধিক এমাইনো এসিডের অদল-বদল হলেই সাধারণত ভ্যারিয়েন্টে রূপান্তর হয়।
মানবজাতির সৌভাগ্য এই যে অন্য সব আরএনএ ভাইরাসের প্রুফ রিডিং ক্ষমতা না থাকার কারণে মিউটেশন হয় ১০ হাজার থেকে ১ লাখ র্যাপলিকেশনের পর। কিন্তু করোনাভাইরাসের গ্রুফ রিডিং ক্ষমতা থাকার কারণে মিউটেশন অনেক কম হয়, ফলে ভ্যারিয়েন্টও অনেক কম হয় (ডিএনএতে মিউটেশন হয় প্রতি এক কোটি থেকে ১০০ কোটি র্যাপলিকেশনের পর)। ভ্যারিয়েন্টগুলো যত বেশি তাড়াতাড়ি যত বেশি লোকের মধ্যে ছড়াবে তত মিউটেশনের চান্স আরো বেড়ে যাবে। যত বেশি মিউটেশন বাড়বে, তত নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে।
প্রশ্ন : ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে এত দুশ্চিন্তার কারণ কি?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচওর একটি প্যানেল ‘ওমিক্রন, বি১.১.৫২৯’কে উদ্বেগের ভ্যারিয়েন্ট আখ্যায়িত করেছে। প্রাথমিকভাবে এখন পর্যন্ত এটিকে অত্যন্ত সংক্রমণযোগ্য ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকৃত কারণ জানতে আরো কয়েকটা দিন সময় লাগতে পারে। এখন পর্যন্ত স্বল্প সময়ে যা জানতে পারা গেছে তা খুবই ভয়াবহ।
গত শুক্রবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন সবচেয়ে খারাপ ও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী এ পর্যন্ত পঞ্চম ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন এই ভ্যারিয়েন্টটির নাম দেন ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৫২৯)। ধারণা করা হচ্ছে এই ভ্যারিয়েন্ট ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের চেয়েও বেশি সংক্রমণশীল, মারাত্মক, ভ্যাকসিন কার্যকারিতা দ্রুত বিনষ্টকারী প্রকৃতির হবে। এ ছাড়াও এই ভ্যারিয়েন্ট ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিয়ে অধিক সংক্রমণ ক্ষমতাসম্পন্ন। এরা বয়স্কদের নয় বরং অল্প বয়স্কদের বেশি আক্রান্ত করছে। আরো ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, দক্ষিণ আফ্রিকায় আক্রান্তদের ৯০ শতাংশই হচ্ছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে। ‘ন্যাচার’ জার্নালে প্রকাশিত রিপোর্ট মতে ভ্যারিয়েন্টটির রি-ইনফেকশন বা ব্রেক থ্রু ইনফেকশন ক্ষমতাও ডেলটার চেয়ে বেশি। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টির প্রথম আবিষ্কার দক্ষিণ আফ্রিকায় ৯ নভেম্বরে হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেলজিয়াম, বোৎসাওয়ানা, জার্মানি, হংকং, ব্রিটেন, ইসরাইল এবং ইতালিতে এর সন্ধান মিলেছে।
কারণ এর রয়েছে বিপুলসংখক মিউটেশন এবং নিজের মধ্যে রূপান্তর করার ক্ষমতা। ব্রিটেনের একজন প্রখ্যাত সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ভাইরোলজিস্ট এই ভ্যারিয়েন্টিকে এ পর্যন্ত পাওয়া ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ এবং ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় শতাধিক লোক, বৎসোয়ানা ও হংকংয়ে ৫৯ জনের মধ্যে শনাক্ত নিশ্চিত হওয়া গেছে। চীনের উহানে আবিষ্কৃত অরিজিনাল করোনাভাইরাসের চেয়ে বিপজ্জনক ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট কয়েক গুণ বেশি সংক্রামক। আর এই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট তার চেয়েও বেশি বিপজ্জনক।
প্রশ্ন : নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের মোকাবেলায় বাংলাদেশের কি করণীয় আছে বলে আপনি মনে করেন?
ডা: তৌহিদ হোসাইন : দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, বৎসোয়ানা, লেসোথো, এস্বাতিনী এবং মোজাম্বিকÑ আফ্রিকার এই সাতটি দেশে ইউরোপিয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, সোদি আরব, ইউএই, বাহরাইন, জর্ডান এবং মরক্কো ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আজ অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলন স্থগিত ঘোষিত হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের মতো এমন ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশে একবার এই মারাত্মক ভ্যারিয়েন্ট ঢুকে পড়লে তা সামাল দেয়ার শক্তি আমাদের নেই। তাই বাংলাদেশও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে দ্রুততম সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে যোগাযোগ স্থগিত করায় জনমনে স্বস্তি ফিরে আসছে। তবে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে করোনার ঝুঁকি দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে প্রতিবেশী দেশ বিশেষ করে ভারতের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি। কারণ ভারতের সাথে আমাদের সব ধরনের যোগাযোগই মিয়ানমারের চেয়ে অনেক বেশি। এখন গণটিকা কার্যক্রম আরো গতিশীল করা প্রয়োজন। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানা, ঘন ঘন হাত ধোয়া এবং মাস্ক পরিধানের ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে চলে যাওয়া উচিত।
এর সাথে যুক্ত হতে হবে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ব্যক্তিদের ওপর কড়া নজরদারি যেমনÑ কোয়ারেন্টিন, ভ্যাকসিন দেয়া আছে কি না দেখা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। আমাদের দেশে মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে। এই পরিমাণ ভ্যাকসিনেশনে নতুন ভ্যারিয়েন্টের আক্রমণ থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব নয়, কারণ যেসব দেশে ৮০ শতাংশের ওপরে মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে সেসব দেশে দুর্বল আকারে হলেও নতুন নতুন ওয়েভ দেখা দিচ্ছে। কাজেই আগে যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল যে ৮০ শতাংশ লোককে ভ্যাকসিন দিলেই সমাজে হার্ড ইমিউনিটি এসে যাবে এ ধারণা সঠিক নয়। এর অন্যতম কারণ হলো অন্য সব ভ্যাকসিনের চেয়ে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগে তৈরি এন্টিবডির কম স্থায়িত্ব, গ্লোবালাইজেশন, দেশে দেশে সহজ যোগাযোগ, স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে ঢিলেমি এবং পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক টিকাবৈষম্য সৃষ্টি করে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরির সুযোগ করে দেয়া। আমাদের এখন উচিত হবে যত বেশি সম্ভব জিন সিকুয়েন্সিং করে সম্ভাব্য ঢুকে পড়া এই নতুন ভ্যারিয়েন্টকে দ্রুত শনাক্ত করার ব্যবস্থা করা। কোনো একটা এলাকায় দুর্ভাগ্যবশত এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে ওই এলাকাকে অন্তত ১৪ দিন অন্য সব এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং লকডাউন শাটডাউন জারি করে ট্রান্সমিশন চ্যানেল ব্লক করার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।