আমি কি বিএনপিতে আছি নাকি আওয়ামী লীগে চলে গেছি!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২১ অক্টোবর,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:০৭ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
একটি প্রতিবেদনের জন্য আমি ভীষণ ঝামেলার মধ্যে রয়েছি। ১৬ অক্টোবর, ২০২৩ সালের পত্রিকায় প্রথম পাতায় লিড নিউজ ছিল- ‘বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত আওয়ামী লীগ।' প্রতিবেদক মনিরুল ইসলাম রোহান আরো কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিবিদের সাথে আমার মতো অধমের মন্তব্যও বেশ গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করেন। সেখানে মার্কিন স্যাংশন, পুলিশের মনোভাব ও আওয়ামী লীগের কৌশল সম্পর্কে বেশ কিছু খোলামেলা বক্তব্য দিই। বক্তব্যের মোদ্দাকথা ছিল, মার্কিন ভিসানিষেধাজ্ঞার ফলাফল হিতে বিপরীত হয়েছে। পুলিশ আরো বেপরোয়া হয়ে পড়েছে এবং আওয়ামী লীগের সাহস বেড়ে গেছে। ফলে নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সরকার তাদের জুলুম-নির্যাতনের পুরনো কৌশল আরো অধিকতর নিষ্ঠুরতা নিয়ে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে।
প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর একজন পাঠক ফোন করে প্রথমেই জানতে চান যে, আমি এখনো বিএনপিতে আছি নাকি আওয়ামী লীগে চলে গেছি। তার কথায় যেন আমি আহত না হই সে জন্য তিনি সবিস্তারে আমার সম্পর্কে তার ইতিবাচক মনোভাব সম্পর্কে বর্ণনা দিলেন। আমার লেখালেখি-টকশো ছাড়াও ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছুই তিনি জানেন। আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চাইলাম, কেন তার মনে হলো যে, আমি বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে চলে গেছি। তিনি নির্দ্বিধায় বহুক্ষণ ধরে আমাকে বুঝাতে চাইলেন যে, বিএনপির সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্তে এমন কিছু বলা উচিত নয় যাতে নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়; বরং সত্য হোক-মিথ্যা হোক সেটি কোনো বিষয় নয়; বরং বিএনপিকে উজ্জীবিত করবে সেই ধরনের প্রচার প্রপাগান্ডার দিকে বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত।
ভদ্রলোক আক্ষেপের সাথে জানালেন, সেই ২০০৯ সাল থেকেই তিনি আমাকে অনুসরণ করে আসছেন। আমি যেদিন বিএনপিতে যোগদান করি সেদিন তিনি যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। ইউটিউবে আমার বক্তব্য তার হতাশাময় জীবনে প্রেরণা দিয়ে থাকে। তিনি বোঝেন অনেক কিছুর সাথে বাস্তবতার মিল নেই। কিন্তু তার স্বপ্ন ও আশা-আকাক্সক্ষার সাথে আমার বক্তব্য মিলে যাওয়ায় তিনি তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকেন কখন আমার নতুন ভিডিও আপলোড হবে। সুতরাং সেই আমি যখন বলেছি যে, মার্কিন ভিসানীতিতে আওয়ামী লীগ ভয় পায়নি। অন্যদিকে, পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষেত্রে ভিসানীতি নিয়ে অতি বাড়াবাড়িমূলক প্রচার প্রপাগান্ডার ফলে হিতে বিপরীত হয়েছে। তারা আরো বেপরোয়া হয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে তখন তিনি কষ্ট পেয়েছেন।
ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাবে আমি যেসব কথা বলেছি তা পাঠকদের কাছে তুলে ধরার প্রয়োজন অনুভব করছি। বিএনপিকে হাজারো ছলাকলা দিয়ে গত চার-পাঁচ বছর ধরে যারা উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা করেছেন আমি তাদের মধ্যে অন্যতম। মাঠে-ময়দানের রাজনীতিতে সময় দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়-বাণিজ্য-শারীরিক অবস্থা ও সর্বোপরি কৌশলগত কারণে আমি জনসভা-পথসভার পরিবর্তে সামাজিক মাধ্যম সভা-সমিতি-সেমিনার এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিকে সুবিধাজনক মনে করেছি। আমি যেহেতু আওয়ামী লীগ ছেড়ে এসেছি সেহেতু বিএনপির তৃণমূলের কিংবা জেলা অথবা বিভাগীয় পর্যায়ের সমাবেশে গেলে আমাকে ঘিরে কয়েকটি সমস্যা হবে। প্রথমত, মিডিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও বিএনপির হাইকমান্ডের সাথে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার কারণে উপস্থিত নেতাকর্মীরা আমাকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখাবে যা দলের পরীক্ষিত ও লড়াকু নেতাদের জন্য বিব্রতকর হয়ে পড়বে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের লাঠিয়ালরা আমাকে টার্গেট করে কিছু একটা ঘটিয়ে নিজ নিজ অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চাইবে অথবা দলীয় প্রধানের কাছ থেকে ধন্যবাদ আশা করবে।
গত পাঁচটি বছরে আমার জীবনে এমন কিছু ঘটেছে যা বিএনপির অন্য নেতাকর্মীর জীবনে ঘটেনি। বুদ্ধিমত্তা-কৌশল ও সতর্কতা অবলম্বন করার কারণে আমি আমার অবস্থান নিরাপদ রেখে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, বিএনপির নীতি-আদর্শ সাধারণ মানুষের কর্ণকুহুর ও মন-মস্তিষ্কে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা-দুর্নীতি এবং গোপন পরিকল্পনাগুলোর আগাম তথ্যও যথাসম্ভব জনগণের নজরে এনেছি। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে রাজনীতি-অর্থনীতি-সামাজিক যোগাযোগ-প্রচার-প্রপাগান্ডা ইত্যাদি সব কিছুর ভূমিকা মাঠের রাজনীতির চেয়েও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর এবং প্রভাবশালী হওয়ায় আমি প্রযুক্তিনির্ভর রাজনীতিতে বেশি সময় দিয়েছি যা বিএনপির শীর্ষ নেতারাও অকপটে স্বীকার করেন।
মার্কিন ভিসানীতি-রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের কর্মকাণ্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা চীন-ভারতের কূটনীতির সমস্যা ছাড়াও বাংলাদেশের রাজনীতিকে রাশিয়ার প্রভাবে আওয়ামী লীগের কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে এবং বিএনপির কী উপকার হচ্ছে তা তথ্য প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে অনবরত বলে যাচ্ছি। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা যথা দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-অর্থপাচার, অপশাসন-অবিচার ইত্যাদি কারণে আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক পারিবারিক সংহতি কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বৈশ্বিক মানে আমরা সভ্যতা-ভব্যতা-শিক্ষা-দীক্ষার সূচকে কিভাবে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি তাও যথাসম্ভব তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ফলে আমার মতো হাজার হাজার সচেতন নাগরিকের অক্লান্ত ও ধারাবাহিক পরিশ্রমের ফলে সারা দেশে জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণ জেগে উঠেছে এবং ক্ষমতার স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে একধরনের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সদ্য বিদায়ী প্রধান বিচারপতি কিংবা মহামান্য হাইকোর্টের সম্মানিত বিচারপতি যখন এজলাসে বসে নির্ভয়ে বলতে পারেন যে, দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন তখন বুঝতে হবে যে- তাদের বোধোদয় ও বিবর্তন রাস্তায় চুঙ্গা ফুঁকানোর কারণে হয়নি।
মার্কিন ভিসানীতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিত্যনতুন সিদ্ধান্ত এবং লন্ডন-কানাডা-ফ্রান্স-অস্ট্রেলিয়া-দিল্লি-মস্কোর ক্ষমতার কেন্দ্রে বাংলাদেশের রাজনীতির বাস্তব অবস্থা পৌঁছে দেয়ার পর এ মুহূর্তে বিএনপির করণীয় কি তা নিয়ে মহাবীর আলেকজান্ডারের একটি বিখ্যাত যুদ্ধজয়ের কাহিনী বলা অবশ্যক।
আলেকজান্ডার যখন পারস্য আক্রমণ করতে গেলেন তখন পারস্য দুনিয়ার একনম্বর পরাশক্তি আর আলেকজান্ডার একে তো বয়সে তরুণ, দ্বিতীয়ত তার রাজ্য মেসিডোনিয়া পারস্যের একটি অঙ্গরাজ্য বা করদরাজ্য হওয়ার যোগ্য ছিল না। ৩৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে তিনি তখন তার ৪০ হাজার সৈন্য নিয়ে পারস্যসম্রাট তৃতীয় দারায়ুসের তিন লাখ বাহিনীর সম্মুখে হাজির হলেন তখন শত্রুশিবিরে হাসাহাসি ও আলেকজান্ডারের বাহিনীতে কাঁপাকাঁপি শুরু হলো।
আলেকজান্ডার তার বাহিনীকে একত্র করলেন এবং সংক্ষিপ্ত ভাষণে বললেন, তোমরা জেনে রাখো, আমাদের বিজয় নিশ্চিত। কাল শুধু তলোয়ার ও বর্শা হাতে তোমাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে একটু দাঁড়াতে হবে মাত্র। তার এই ঐতিহাসিক ভাষণ কিভাবে তাকে বিজয়ী করেছিল সেই কাহিনী বলার আগে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ওয়াটার লু যুদ্ধে পরাজয়ের কাহিনীটি বলে নিই। ব্রিটিশরা কোনো যুদ্ধেই নেপোলিয়ানের সাথে পেরে উঠছিল না। ফলে তারা মিথ্যা প্রচার ও নেপোলিয়নের পরিবারে অর্থাৎ তার স্ত্রী জোসেফাইনের মনে সন্দেহের বিষ এমনভাবে ঢুকিয়ে দিলো যার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকেও তিনি পারিবারিক সমস্যায় জর্জরিত হতে থাকলেন এবং মানসিক দুর্বলতার কারণে কিছু মারাত্মক ভুল করে ফেললেন যা তাকে পরাজয়ের নির্মম পরিণতির দিকে নিয়ে গেল।
আলোচনার এই পর্যায়ে আলেকজান্ডারের বিজয় ও হাল আমলে আওয়ামী লীগের দুর্দশা এবং বিএনপির বিজয়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করা যাক। আলেকজান্ডারের মা অলিম্পিয়াস প্রথম থেকেই প্রচার করে আসছিলেন যে, দেবতা জিউসের ঔরসে আলেকজান্ডারের জন্ম হয়েছে। ফলে তাকে ঘিরে বহু অলৌকিক কল্পকাহিনী ছিল। অধিকন্তু তার বীরত্ব, সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও একের পর এক সফলতার কারণে ‘অলৌকিক কল্পকাহিনীগুলো সবাই বিশ্বাস করত। সুতরাং যুদ্ধের ময়দানে তিনি যখন বললেন, আমাদের বিজয় নিশ্চিত। ফলে শুধু তলোয়ার হাতে একটু দাঁড়াতে হবে মাত্র। তখন সাধারণ সৈন্যরা বিশ্বাস করল যে, দেবদূত জিউস স্বর্গ থেকে সৈন্য পাঠিয়ে পারস্য বাহিনীকে পরাজিত করবে। অন্যদিকে, পারস্য সম্রাট দারায়ুসের অহঙ্কার ও তার সৈন্যবাহিনীর জেনারেলরা যেভাবে আলেকজান্ডারের বাহিনীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিল তাতে করে যুদ্ধের ময়দানে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হলো যা কিনা সর্বকালের সেরা একটি বিজয়রূপে ইতিহাসের মাইলস্টোন তৈরি করে ফেলল।
উল্লিখিত কাহিনীর সাথে যদি আমরা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির তুলনা করি তবে দেখতে পাব, পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারায়ুসের মতো অহমিকাবোধ আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতাকর্মীকে পেয়ে বসেছে। তাদের সংখ্যাধিক্য, অর্থবিত্ত ও ক্ষমতার দম্ভের কাছে তারা বিএনপিকে তেজপাতার মতো দুর্বল ও অসহায় মনে করছে। অন্যদিকে, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, বহুমুখী আন্তর্জাতিক চাপ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ দেশের সার্বিক ব্যবসায়-বাণিজ্যের দুরবস্থা বিএনপির জন্য অলৌকিক নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগকে এখন বিএনপির চিন্তা বাদ দিয়ে ভারত-আমেরিকা-রাশিয়া-চীন ও ইউরোপের পেছনে ছুটতে হচ্ছে। তাদের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ হলো- এই ছুটোছুটির জন্য তাদের মধ্যে যেসব যোগ্যতম লোক ছিলেন তাদেরকে বিগত দিনে আঘাতের পর আঘাতে এবং অপমানে জর্জরিত করে এতটাই অবদমিত করে রাখা হয়েছে যার ফলে তাদের পক্ষে মাথা উঁচু করে দলের জন্য ওকালতি করা অসম্ভব। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ৭৯ বছরের প্রধান প্রবীণা শরীর নিয়ে দেশ-বিদেশে যেভাবে ছুটছেন তার ফলে বিএনপির রাজনীতির জন্য পুরো মাঠ ফাঁকা হয়ে আছে।
আওয়ামী লীগের প্রধানতম ভরসা পুলিশসহ পুরো আমলাতন্ত্রকে এখন পশ্চিমাশক্তির সাথে মনস্তাত্তিক যুদ্ধে সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। পশ্চিমারা যেভাবে আওয়ামী লীগের শক্তির উৎসগুলো দুর্বল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে তাতে করে বিএনপির জন্য বিরাট একটি রাজনৈতিক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সুতরাং দ্য ব্যাটেল অব গাওগেমেলার মতো তারা যদি কেবল মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তবে বিজয় নিশ্চিত।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য