avertisements 2

ক্রসফায়ার, গুম-খুন যেভাবে হচ্ছে-!

আউয়াল খান
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ এপ্রিল, বুধবার,২০১৮ | আপডেট: ১১:৪৬ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪

Text

র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব’র বহুল আলোচিত ক্রসফায়ার, গুম-খুন কেন ও কিভাবে হচ্ছে তার আসল তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে একটি সুইডিশ রেডিওতে। বাংলাদেশের এলিট পুলিশ ফোর্স হিসেবে খ্যাত র‌্যাব কীভাবে মানুষকে অপহরণ করছে এবং খুন করছে তা নিয়ে র‌্যাবের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথাবার্তার রেকর্ড প্রকাশ করেছে ওই সুইডিশ রেডিও। এই সংবেদনশীল আলোচনায় সেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন তারা কীভাবে বিভিন্ন সহিংস পদ্ধতিতে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ওই রেডিওর সাথে আলাপে সে কর্মকর্তা বলেছিলেন- ‘তাকে যদি পান তাহলে গুলি করুন এবং মেরে ফেলুন। সে যেখানেই থাকুক না কেন। তারপর তার পাশে একটি অস্ত্র রাখুন’।

ওই কর্মকর্তা বলেন, আদেশটা এমনই হয়ে থাকে। সেই আলাপে উঠে এসেছে কীভাবে বাংলাদেশের সে এলিট বাহিনীটি বাছাই করে কাকে মারবে। তার সাথে আলাপ যে রেকর্ড হচ্ছিল সেটা জানতেন না সেই র‌্যাব কর্মকর্তা। তিনি নিজেও কয়েক ডজন মানুষকে মেরেছেন। যাদেরকে মারা হয়েছে তারা গুরুতর অপরাধ করেছে বলে সন্দেহ করা হয়। তারা এমন অপরাধী যাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা কঠিন বা পুনর্বাসন করা কঠিন।


র‌্যাব হচ্ছে পুলিশের ভেতরে একটি বিশেষ ইউনিট। সামরিক বাহিনী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এই বাহিনীটি গঠিত। গুরুতর অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ ও মাদক চোরাচালান ঠেকানোর জন্য ২০০৪ সালে এই বাহিনীটি গঠিত হয়েছিল। র‌্যাবের সেই কর্মকর্তার সাথে আলাপচারিতা বাংলাতেই হয়েছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে সোর্স জানায়নি সুইডিশ রেডিও। কীভাবে তারা টার্গেটকে খুন করে তার লোমহর্ষক তথ্য উঠে আসে আলাপচারিতায়। দেখা গেল টার্গেট কোনো চায়ের স্টলে চা খাচ্ছেন বা নিত্য অন্যান্য কাজ করছেন। সে সময়ই মেরে দেন।

ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আরও জানান, পুলিশ কীভাবে অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়। ঘুষের টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে খুন করা ব্যক্তির পাশে রেখে দেয়। মানুষের কাছে তো আর অস্ত্র প্রস্তুত থাকে না। কিন্তু র‌্যাব যে তাকে হত্যা করলো তার যুক্তিযুক্ত কারণ দেখাতে হয়। পাশে অস্ত্র থাকলে এটা বলা যায় আত্মরক্ষার জন্য করা হয়েছে। জানা যায়, র‌্যাবের সেই কর্মকর্তার সাথে আলাপচারিতার রেকর্ডিং চলেছে ২ ঘন্টা। একই কথা বারবার উঠে এসেছে তার কথায়। র‌্যাব কীভাবে মানুষ হত্যা ও গুম করছে তা নিয়ে বলতে শোনা গেছে।


বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাবের কর্মকা- ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সমালোচনা করে আসছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এই ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। র‌্যাব দ্বারা নির্যাতিত, গুম ও হত্যার শিকার হওয়ার ব্যক্তিদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ এক্সপার্ট ওলফ ব্লুমকভিস্ট বলেন, রেকর্ডিংটি শোনা খুবই কষ্টকর। এই বিপজ্জনক পর্যায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কেউ এত স্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে পারে, তা ভাবলেই গা শিউরে উঠছে। আমরা নিজেরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে এই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, কয়েক বছর ধরে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ পেয়েছেন, সেগুলোর সঙ্গে এই বর্ণনা মিলে যায়।

র‌্যাব কাউকে হত্যা করার পর সেটাকে ‘ক্রসফায়ার’ নাম দেয় কীভাবে এবং সাংবাদিক ও জনসাধারণের কাছে কীভাবে উপস্থাপন করা হয় সেটা নিয়েও খোলাখুলি বলেন ওই কর্মকর্তা। জোরপূর্বক কাউকে তুলে আনা, হত্যা, গুম নিয়ে র‌্যাব সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে আসছিলো অনেক আগে থেকেই। গুম কীভাবে করা হয় সেটা নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন সে র‌্যাব কর্মকর্তা। কাউকে জোর করে তুলে আনা, খুন করা এবং অতঃপর মরদেহ কীভাবে লুকিয়ে ফেলা হয় সেটা নিয়েও খোলাখুলি বলেন তিনি। হত্যা করার পর মরদেহের সাথে কিছু ইট বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। র‌্যাব কর্মকর্তা এমন শিতল গলায় কথাগুলো বলছিলেন যেন কোনো হরর ফিল্মের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তারা কীভাবে টার্গেট করা ব্যক্তির সাথে মিথ্যা কথা বলে সেটাও জানান। টার্গেট ব্যক্তিকে বলা হয়- তার কোনো বন্ধুর কাছে নিরাপদে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার বদলে তাকে হত্যা করা হয়।


র‌্যাব কীভাবে সতর্কতা অবলম্বন করে সেটা নিয়েও কথা বলেন তিনি। ক্রসফায়ার বা গুমের ঘটনা ঘটানোর সময় র‌্যাব কর্মকর্তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়। তিনি বলেন, প্রত্যেকেই তো আর জোর করে গুম করতে সমর্থ নয়। আমাদের চেষ্টা করতে হয় যেন কোনো ক্লু পাওয়া না যায়। কারো আইডি কার্ড যেন পড়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। আমরা হাতে গ্লাভস পরে নিই, পায়ের চিহ্ন যেন না থাকে সেজন্য জুতার উপরে কাভার লাগানো হয়। অপারেশন চলাকালে আমরা ধূমপানও করিনা। সেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এভাবেই প্রতিনিয়ত মানুষ গুম হচ্ছে। নিরপরাধ লোক বা যে কোনো ব্যক্তিকে এভাবে খুন করা যায়।

র‌্যাব কীভাবে নির্যাতন চালায় তারও লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন সেই কর্মকর্তা। তার বর্ণনামতে-একটি অন্ধকার রুমে গ্রেফতার করা ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হয়। মাঝখানে লাইট থাকে। হাতকড়াতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। অ-কোষে ইট ঝুলানো হয়। র‌্যাব কর্মকর্তা জানান অনেক সময়ে ইটের ভারে অ-কোষ ছিড়ে যায়। নির্যাতনে শিকার হওয়া লোকটি ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে যায়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওলফ ব্লুমকভিস্ট বলেন, এই ধরণের কথা শুনা খুবই কষ্টকর। খাতা কলমে নির্যাতন বিরোধী আইন নিয়ে বাংলাদেশ বেশ প্রগতিশীল। কিন্তু সমস্যা হলো তারা কদাচিতই এটা চর্চা করে থাকে। মহামারির মতো নির্যাতন চলছে এবং যারা এর জন্য দায়ী তারা বিচারের আওতায় এসেছে তার কোনো নজির নেই।

বাংলাদেশের যে গণমাধ্যম এই খবরটি প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়, সুইডেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্গট ওয়ালস্ট্রম এই গোপন টেপটির কথা শুনে ধাক্কা খেয়েছেন। কীভাবে মানুষ অপহরণ করা হয়, খুন করা হয়, গুম করা হয় তার বর্ণনা শুনে তিনি নিন্দা জানিয়েছেন। মার্গট ওয়ালস্ট্রম বলেন, এই ব্যাপারে শুধু একটি কথাই বলবার আছে। এটা খুবই জঘন্য কাজ হয়েছে এবং এটা অবশ্যই থামাতে হবে। আর বাংলাদেশকে এর জন্য দায় নিতে হবে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2