বরিশাল সিটি নির্বাচন ভোটে তিন হুজুরের দরবার
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ জুন,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৪২ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বরিশাল শহরে প্রভাব রয়েছে ধর্মীয় তিন দরবারের। দরবারের হুজুরদের রয়েছে বড় সংখ্যক মুরিদ। ফলে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রভাবক হয়ে উঠেছে তিন হুজুরের দরবার। মেয়র পদে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হয়েছেন চরমোনাই দরবারের শায়েখ হুজুর হিসেবে পরিচিত মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম নিজেই। অপর দুই হুজুরের দরবারের সমর্থন পেতে চেষ্টা করছেন তিনিসহ বাকি মেয়র প্রার্থীরা।
সমর্থন পেতে ছারছীনা পীরের দরবারে গিয়েছেন খোকন সেরনিয়াবাত নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। ছারছীনা ও নেছারাবাদ দরবারের সঙ্গে চরমোনাইর সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে শীতল হলেও ফয়জুল করীম মেয়র হতে তাঁদের সমর্থন চাইছেন। তবে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন পরিচালনাকারীদের আশা, আওয়ামী লীগেই আসবে দুই দরবারের অনুসারীর ভোট।
নির্বাচনী আচরণবিধিতে নিষিদ্ধ হলেও সব প্রার্থীই ভোটের প্রচারে কমবেশি ধর্মের ব্যবহার করছেন। প্রচলিত প্রচারণার পাশাপাশি মসজিদ থেকেও ভোট চাইছেন তাঁরা। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে ভোটারদের পবিত্র কোরআন ছুঁইয়ে ভোট দেওয়ার শপথ করানোর একাধিক অভিযোগ রয়েছে। কীর্তনখোলা নদীর একপাড়ে বরিশাল শহর, অন্যপাড়ে চরমোনাই ইউনিয়ন। এলাকাটি চরমোনাই পীর পরিবারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
তাদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মী ছাড়াও বহু সংখ্যক মুরিদ রয়েছে বরিশালে। চরমোনাই দরবারের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মুজাহিদ কমিটির সদস্যরা ভোটের মাঠে হাতপাখার প্রচারে মূল ভূমিকা পালন করছেন।
১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার ছারছীনা দরবার শরিফের পীর ছিলেন আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ। তাঁর ছেলে শাহ মোহাম্মদ মোহেবুল্লাহ বর্তমান পীরের দায়িত্ব পালন করছেন। বরিশাল শহরের অদূরে ঝালকাঠিতে ১৯৫০ সালে নেছারাবাদ দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা আযীযুর রহমান। তিনিই একমাত্র পীর নন, বরং কায়েদ হুজুর (বড় হুজুর) নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ছেলে মাওলানা খলিলুর রহমান এখন দরবারের হুজুর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চরমোনাইয়ের মতো ছারছীনা ও নেছারাবাদ দরবার রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। রাজনৈতিক দল না থাকলেও রয়েছে সংগঠিত সংগঠন। ছারছীনা দরবারের সংগঠনের নাম জমইয়াতে হিযবুল্লাহ। নেছারাবাদ দরবার পরিচালনা করে হিযবুল্লাহ জমিয়াতুল মুছলিহীন নামে আরেকটি সংগঠন। এ দুই সংগঠনের মাধ্যমেই মতাদর্শ প্রচার ও ধর্মভিত্তিক ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করে ছারছীনা ও নেছারাবাদ দরবার। সংগঠন দুটির অনুসারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব দলের নেতাকর্মী রয়েছে। ভোটের মৌসুমে তাদের গুরুত্ব আরও বেড়েছে। ভোট পেতে প্রার্থীরা ছুটছেন দরবারে।
বিএনপি ভোট বর্জন করায় নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে হাতপাখা। জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছেন জাতীয় পার্টির লাঙ্গলের প্রার্থী। দলীয় নির্দেশ অমান্য করে মেয়র প্রার্থী হওয়ায় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত কামরুল আহসান রূপন এবং অপর তিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর দুইজনও প্রচারে রয়েছেন। এর মধ্যে ফরিদপুরের জাকের মঞ্জিল দরবারের রাজনৈতিক দল জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী মিজানুর রহমান বাচ্চুর ভরসা নিজ দলের মুরিদ। তাঁরাই গোলাপ ফুলের প্রচার চালাচ্ছেন।
প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের আভাসে চরমোনাইয়ের হাতপাখাকে ঠেকাতে ছারছীনা ও নেছারাবাদের মুরিদদের ভোট পেতে জোর চোষ্টা করছে নৌকা। ছারছীনার প্রয়াত পীরের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার বিরোধিতার অভিযোগ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী গত ৩১ মে দরবার শরিফে যান। অন্য প্রার্থীদের মতো তিনিও মসজিদে মসজিদে নামাজ আদায় করে ভোট প্রার্থনা করছেন।
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি তৃতীয় নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের অংশগ্রহণ ছিল না। সে বছর হেফাজত ইসলাম ইস্যু নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী শওকত হোসেন হিরন বড় ব্যবধানে হেরে যান বিএনপির আহসান হাবীব কামালের বিরুদ্ধে। ওই নির্বাচনে বরিশালের তিন দরবার শরিফেরই সমর্থন ছিল বিএনপির প্রতি। এবার আওয়ামী লীগও চেষ্টা করছে দরবারের সমর্থন পেতে।
বরিশাল শহরের অধিকাংশ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন কোনো না কোনো দরবারের সঙ্গে যুক্ত। বাকিরা জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো কওমি মাদ্রাসা ঘরানার দলের সমর্থক। দরবারের সমর্থন আদায়ে মহানগর ইমাম সমিতিকে কাছে পেতে চেষ্টা করছেন নৌকা ও হাতপাখার প্রার্থী। গত ৩০ মে নগরীর বিএম স্কুলে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন নৌকার প্রার্থী।
তবে ওই সভায় চরমোনাই দরবারের অনুসারী ইমাম-মুয়াজ্জিনরা যাননি। পাল্টা হিসেবে গত বৃহস্পতিবার ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন হাতপাখার প্রার্থী ফয়জুল করীম। এতে আট শতাধিক ইমাম-মুয়াজ্জিন অংশ নেন বলে দাবি করেছেন ইসলামী আন্দোলনের মিডিয়া কমিটির সদস্য মো. সানাউল্লাহ।
ইমাম সমিতির উপদেষ্টা এবং এবায়েদুল্লাহ জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুর রহমান বেগ ছারছীনার মরহুম পীরের ভাগনে এবং বর্তমান পীরের জামাতা। তিনি ছারছীনার দরবার নিয়ন্ত্রিত জমইয়াতে হিযবুল্লাহর বরিশাল বিভাগীয় প্রধান। নুরুর রহমান বেগ বলেছেন, চরমোনাই পীর পরিবারের সৈয়দ ফয়জুল প্রার্থী হওয়ায় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের গুরুত্ব বেড়েছে। আলেমদের সবাই ডাকছেন, দোয়া চাইছেন। তাই এবারের নির্বাচন আলেমদের জন্য নেয়ামত। বরিশালে আলেম-ওলামাদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই। কেউ কেউ গুজব ছড়াচ্ছে।
মহানগর ইমাম সমিতির সভাপতি মাওলানা আবদুল মান্নান হাতপাখায় ভোট চান গত বৃস্পতিবারের সভায়। ছারছীনার সঙ্গে চরমোনাই দরবারের শীতল সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ্য হলেও পরের দিন এবায়েদুল্লাহ মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন হাতপাখার প্রার্থী।
নেছারাবাদ দরবারের সমর্থন নৌকার দিকে যেতে পারে বলে সূত্রের খবর। নেছারাবাদ দরবারের বরিশালের খানকার পরিচালক মাওলানা মহিউদ্দিন সমকালকে বলেছেন, নেছারাবাদের হিযবুল্লাহ জমিয়াতুল মুছলিহীন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন। এর সভাপতি মাহমুদুল হক খান মামুন মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক এবং নৌকার প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য। জমিয়াতুল মুছলিহীনের নির্বাচনে ভূমিকা নেই। হাতপাখার প্রার্থীর মতবিনিময় সভায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা ইমাম সমিতির সদস্য। সেখানে জমিয়াতুল মুছলিহীনের প্রতিনিধিত্ব ছিল না।
নেছারাবাদ দরবারের হুজুর খলিলুর রহমান নেছারাবাদী জমিয়াতুল মুছলিহীনেরও প্রধান। নির্বাচনে এই সংগঠনের ভূমিকা কী– প্রশ্নে তিনি সমকালকে বলেন, অনেক প্রার্থীই যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু যাঁর মাধ্যমে সমাজ ও মানুষ উপকৃত হবেন, তাঁকে ভোট দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহারের অভিযোগ নাকচ করে নৌকার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য লস্কর নুরুল হকের দাবি, ছারছীনা ও নেছারাবাদী পীরের অনুসারীরা নৌকায় ভোট দেবেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, ঐতিহাসিক কিছু কারণেই তাঁদের ভোট আওয়ামী লীগে আসবে। তবে তাঁরও অভিযোগ, ভোটে ধর্মের অপব্যবহার করছেন নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বীরা।
লাঙ্গলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের একই অভিযোগ। তিনি বলেছেন, হাতপাখার প্রার্থীর পক্ষে ইসলামী আন্দোলনের নারী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোরআন শরিফ ছুঁইয়ে ভোট দিতে ওয়াদা করাচ্ছেন।
নির্বাচনের প্রচারের শুরু থেকে ওঠা এ অভিযোগ আগেই অস্বীকার করেছেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমাদ।