হাজিদের চোখের পানিতে ভিজল আরাফাত ময়দান
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৯ জুলাই,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:১০ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
মিসরীয় নাগরিক জাকারিয়া মোহাম্মদের সারাজীবনের প্রত্যাশা ছিল পবিত্র হজ পালন করবেন। তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে এবার। গতকাল শুক্রবার হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ আরাফাতের ময়দানে সমবেত হয়ে তিনি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমি এখন মহান আল্লাহর অতি কাছে। তিনি আমাকে এই সুযোগ দিয়েছেন।’
এদিন আরাফাত ময়দান ভিজেছে জাকারিয়ার মতো আরও লাখো হাজির চোখের পানিতে। যথাযথ ধর্মীয় গাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এদিন পবিত্র হজ পালিত হয়। আত্মশুদ্ধি ও পাপমুক্তির আকুল বাসনা নিয়ে হাজিরা এদিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন। ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়া নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’ (আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই; সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার) বলে তাঁরা কেঁদে বুক ভাসান।
এদিন ভোররাত থেকেই সৌদি আরবের আরাফাতের ময়দানে হাজিরা সমবেত হতে থাকেন। সেলাইবিহীন শুভ্র কাপড়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারাবিশ্ব থেকে সমবেত মুসলমানরা ঐতিহাসিক এ ময়দানের তাঁবুতে অবস্থান করেছেন। সারাদিন কাটিয়ে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে পড়েন তাঁরা। দিনভর তাঁরা কাটান ইবাদত-বন্দেগিতে। আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় মশগুল ছিলেন জিকির ও তালবিয়া পাঠে। করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর হজে সৌদি আরবের বাইরের কেউ অংশ নিতে পারেননি। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় এবার বড় পরিসরে হজ পালনের সুযোগ দিয়েছিল সৌদি সরকার। এ বছর বিভিন্ন দেশ থেকে ১০ লাখ মুসলিম হজ পালনের সুযোগ পান। বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬০ হাজার মুসল্লি অংশ নিয়েছেন হজে।
হাজিরা গতকাল সূর্যোদয়ের পর সমবেত হন মিনা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বিদায় হজের স্মৃতিবিজড়িত আরাফাতের ময়দানে। তিন দিকে পাহাড়ঘেরা প্রায় চার বর্গমাইল আয়তনের এ বিশাল সমতল মাঠের একপ্রান্তে জাবালে রহমত অর্থাৎ রহমতের পাহাড়। ১৪০০ বছরের বেশি সময় আগে এখানেই শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এ পাহাড়টিকে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলে থাকেন। বলা হয়, হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর এই আরাফাতে এসে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন।
শুক্রবার সূর্যোদয়ের পর হজযাত্রীদের আরাফাত ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁদের সেখানে নিয়ে যান মুয়াল্লিমের দায়িত্বশীলরা। সেখানে আগে পৌঁছে ফজর এবং জোহর-আসর আদায় করেন তাঁরা। সেখানে উপস্থিত না হলে হজ পূর্ণ হয় না। তাই হজে এসে যাঁরা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁদেরও অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসা হয় এখানে। ইসলামী রীতি অনুযায়ী, জিলহজ মাসের নবম দিনটি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে ইবাদতে কাটানোই হলো হজ।
এখানে মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেন খতিব। এ বছর আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা দেন শায়খ ড. মুহাম্মাদ আবদুল করিম আল-ঈসা। একই সঙ্গে মসজিদে নামিরাতে নামাজও পড়ান তিনি। এ বছর খুতবার অনুবাদ বাংলাসহ মোট ১৪টি ভাষায় শোনা গেছে। বাংলা অনুবাদক হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন দু’জন। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ শোয়াইব রশীদ ও তাঁর সহকারী খলিলুর রহমান। মোহাম্মদ শোয়াইবের বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায়। তিনি মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদিসশাস্ত্রে পিএইচডি করছেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রামের শিক্ষক। এ ছাড়া তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব। খলিলুর রহমান মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্যে পিএইচডি করেছেন।
সারাদিন আরাফাত ময়দানে অবস্থানের পর বিকেলে মুসল্লিরা পা বাড়ান মিনার পথে। প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন তাঁরা। সেখানেই রাতে খোলা আকাশের নিচে ছিলেন। এটি ওয়াজিব। এ সময়েই তাঁরা প্রয়োজনীয় সংখ্যক পাথর সংগ্রহ করেন, যা মিনার জামারায় প্রতীকী শয়তানকে উদ্দেশ করে আজ শনিবার ছোড়া হবে। মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায়ের পর হাজিরা মিনায় নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। সেখানে বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (ন্যাড়া) গোসল করবেন।
এরপর পবিত্র কাবা শরিফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। এটি হজের আরেকটি ফরজ। কাবার সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় সাঈ (সাতবার দৌড়ানো) করবেন। মিনায় তাঁরা যত দিন থাকবেন, তত দিন প্রতীকী শয়তানকে লক্ষ্য করে পাথর ছুড়ে মারবেন। সবশেষে কাবা শরিফ বিদায়ী তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা।
কাবা শরিফে নতুন গিলাফ: শুক্রবার পবিত্র কাবা শরিফে পরানো হয়েছে নতুন গিলাফ। প্রতিবছর (৯ জিলহজ) হজের দিন হাজিরা সব আরাফাত ময়দানে থাকেন এবং মসজিদে হারামে মুসল্লির সংখ্যাও থাকে কম। হাজিরা আরাফাত থেকে ফিরে এসে কাবা শরিফের গায়ে নতুন গিলাফ দেখতে পান। নতুন গিলাফ পরানোর সময় পুরোনোটি সরিয়ে ফেলা হয়। পুরোনো গিলাফ কেটে মুসলিম দেশের সরকারপ্রধানদের উপহার দেওয়া হয়।