একে একে বেরিয়ে আসছে হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের অর্থপাচারের তথ্য
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২১ জুন,শনিবার,২০২৫ | আপডেট: ০১:২৬ এএম, ২২ জুন,রবিবার,২০২৫

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পাচারের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এ টাকা তারা বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। দেশ থেকে ব্যাংক লুট ও বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা বিদেশে পাচার করে এসব সম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে।
এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার বাড়ি, শেখ রেহানার মেয়ে ও যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য টিউলিপ সিদ্দিকের লন্ডনে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট শনাক্ত হয়েছে। পতিত প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অফশোর বিনিয়োগের তথ্য অনুসন্ধান চলছে।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার নামে বিলাসবহুল বাড়ি পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের নামে বাড়ি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকে অর্থ জমার তথ্য পাওয়া গেছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী ও নেতাকর্মীদের নামেও যুক্তরাজ্যে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলোর বিষয়ে বিশদ তদন্ত হচ্ছে। সম্পদের মধ্যে বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংকে অর্থ জমার তথ্যও মিলেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আলোচিত বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনাগুলো সরকারের একাধিক সংস্থা থেকে তদন্ত চলছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল বা সিআইসি, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিও আছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক একাধিক তদন্ত সংস্থারও সহায়তাও নেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এদের তদন্তের ভিত্তিতে তৈরি প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সহযোগী সংস্থা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল বা সিআইসি দেশ থেকে টাকা পাচারের ঘটনা ব্যাপকভাবে তদন্ত করছে। সংস্থার একটি টিম সম্প্রতি বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসেছে। তারা সাইফুজ্জামান চৌধুরী, নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার, ওরিয়ন গ্রুপ ও আরও একটি গ্রুপের নামে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে থাকা সম্পত্তি ও ব্যবসায়ে বিনিয়োগ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। এছাড়া এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ ও পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অফশোর বিনিয়োগের তথ্য অনুসন্ধান করছে। আলোচ্য গ্রুপের সম্পদের বেশকিছু আলোকচিত্রও তারা নিয়ে এসেছে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তিনজনের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের ৩৩৬টি বাড়ি বা ফ্ল্যাট ও ব্যাংক হিসাবে জমা ৩৫ কোটি টাকা। এগুলোর কেনা দাম কম হলেও বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় এক হাজার ২৫ কোটি টাকা। সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান এফ রহমান ও তার ভাতিজা শাহরিয়ার রহমানের দুটি বিলাসবহুল বাড়ি জব্দ করা হয়েছে। এই দুটির মূল্য প্রায় ৭৭ লাখ পাউন্ড বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি। আরও একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের দুজনের নামে যুক্তরাজ্যে সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলোও জব্দ করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি বা এনসিএর কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই রনি চৌধুরীর নামেও যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন ব্যবসার তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো জব্দের জন্যও চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, শেখ হাসিনার পরিবারের আর কারও নামে-বেনামে দেশটিতে কোনো সম্পদ আছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত কাজে তারা দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্টিকরাপশন কো-অর্ডিনেশন সেন্টারের (আইএসিসিসি) সহায়তা নিচ্ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি হচ্ছে যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তারা যে কোনো বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। বিশেষ করে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে। আইএসিসিসি হচ্ছে যুক্তরাজ্য সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা। এর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা যুক্ত। তারা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে তদন্ত করে। কোনো ঘটনা তদন্তের প্রয়োজন হলে ওইসব দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করে। বাংলাদেশে বিগত সরকারের ১১টি ঘটনার যে তদন্ত হচ্ছে, সেগুলোতে সহায়তা করছে ওই দুটি সংস্থাসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। যে কারণে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচারের অর্থে বিদেশে গড়া সম্পদের তথ্য বের হয়ে আসছে।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে যুক্তরাজ্যে ৩৩৬টি বাড়ি ও ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। দলিল মূলে এগুলোর দাম তিন লাখ ২০ হাজার ডলার বা প্রায় চার কোটি টাকা। বর্তমান বাজার মূল্য অনেক বেশি। এছাড়া লন্ডনের ব্যাংকে তার সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। তার ভাই রনি চৌধুরীর নামে যুক্তরাজ্যে হাউজিং ব্যবসার তথ্য পাওয়া গেছে। তার নামেও কয়েকটি বাড়ি বা ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে।
এস আলম গ্রুপের নামে বিভিন্ন দেশে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আরও তদন্ত হচ্ছে। বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান এফ রহমান ও তার ভাতিজার নামে লন্ডনে বিলাসবহুল দুটি ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর বাজার মূল্য ৭৭ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যুক্তরাজ্যের বার্কলেস ব্যাংক পিএলসিতে দুটি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওই হিসাবের লেনদেনের অর্থ সম্পর্কে তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউ। সায়ান এফ রহমানের বাড়িটিতে এক সময় শেখ রেহানা থাকতেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি এখন সে বাড়িতে থাকেন না।
যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে লন্ডনে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট উপহার দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী আবদুল মোতালিব। বর্তমানে এর মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যবসায়ী আবদুল মোতালিবের লন্ডনে আরও বাড়ি রয়েছে। তিনি সেখানে হাউজিং ব্যবসা করেন বলে জানা গেছে। লন্ডনে তার ব্যাংক হিসাবও রয়েছে।
সিকদার গ্রুপের নামে চারটি দেশে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে সম্পদের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে তদন্ত চলছে।
যুক্তরাজ্যের একটি কোম্পানির ছয় লাখ ২৭ হাজার শেয়ার রয়েছে বাংলাদেশি একটি শিল্প গ্রুপের নামে। এগুলোর মূল্য প্রায় ৬০ লাখ পাউন্ড বা ১০২ কোটি টাকা। এগুলো জব্দ করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শেয়ার কেনার অর্থ কিভাবে স্থানান্তর হয়েছে এখন সেগুলোর তদন্ত হচ্ছে।
নাসা গ্রুপের নামে যুক্তরাজ্যে পাঁচটি সম্পদ পাওয়া গেছে। এছাড়া যুক্তরাজ্যশাসিত দুটি দ্বীপ জার্সি ও আইল অব ম্যানে আরও দুটি সম্পদ পাওয়া গেছে। সবগুলোর দলিল মূল্য তিন কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৬৪৫ কোটি টাকা। তবে বাজার মূল্য কয়েকগুণ বেশি হবে। যুক্তরাজ্যশাসিত একটি দ্বীপ আইল অফ ম্যানের ব্রার্কলে ব্যাংকে একটি হিসাব পাওয়া গেছে। এতে জমা দুই লাখ ৮০ হাজার ডলার।
যুক্তরাজ্যের সাবেক হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম ও তার স্বামী ব্যবসায়ী তৌহিদুল ইসলামের নামে দেশটিতে সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ২০০ কোটি টাকার বেশি যারা পাচার করে যুক্তরাজ্যে সম্পদ গড়েছেন তাদের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এছাড়া আরও অনেক পাচারকারী রয়েছেন যাদের দেশটিতে সম্পদ রয়েছে। সেগুলোর বিষয়ে পর্যায়ক্রমে তদন্ত হবে।