মিয়ানমার সফর : ফিরে এসে বেঁকে বসলেন রোহিঙ্গারা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৬ মে,শনিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:০৪ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
২০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে পরিবেশ ও আবাসনব্যবস্থা দেখাতে। ফিরে এসে তাঁরা নাগরিকত্ব, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন দাবি তুলেছেন। তাঁরা যে মন্তব্য করেছেন তাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
চীনের সমর্থনে বর্ষার আগেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। তারই অংশ হিসেবে গতকাল শুক্রবার সকালে ২০ জন রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল রাখাইন রাজ্যে গিয়েছিল। রাখাইন সফরকারী রোহিঙ্গারা কক্সবাজার ফিরে অন্যদেরও ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করবেন—এমনটিই প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের।
প্রতিনিধিদলের প্রধান শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান রাখাইন রাজ্য থেকে ফিরে কক্সবাজারের টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট ঘাটে সাংবাদিকদের বলেছেন, মিয়ানমার সরকারের আয়োজন এবং রোহিঙ্গাদের জন্য নির্মিত অবকাঠামো দেখে তাঁরা যথেষ্ট সন্তুষ্ট।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশ বরাবরই দাবি জানিয়েছে, প্রত্যাবাসন হতে হবে টেকসই ও সম্মানজনক। রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমার কী ধরনের ব্যবস্থা করছে, তা দেখানোর অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশ। মিয়ানমার তা গ্রহণ করেছে। প্রত্যাবাসনের জন্য দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে হবে।
গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় মিয়ানমারের উদ্দেশে টেকনাফ ছাড়ে প্রতিনিধিদল। ফিরে আসে বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে। আরআরআরসির মো. মিজানুর রহমান বলেন, ২০ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে রাখাইন রাজ্যের মংডুর আশপাশের পরিস্থিতি দেখে তাঁরা ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চাই।’
আরআরআরসি জানায়, রোহিঙ্গাদের আস্থা বৃদ্ধির জন্য এই সফরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মিয়ানমারের প্রতিনিধি আবারও কক্সবাজারে আসবেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
তিনি বলেন, ‘মংডু শহরে প্রচুর রোহিঙ্গা আছে। আমি যতটুকু তথ্য নিয়েছি, সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা ব্যবসা করছে। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে।’
তবে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেছেন। রাখাইন ঘুরে আসা ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘অনেক বছর পর আমাদের দেশ মিয়ানমার দেখার সুযোগ হয়েছে। সেখানে আমাদের ক্যাম্পগুলো দেখিয়েছে।’
তিনি বলেন, “আমরা জানতে চাইলাম, ক্যাম্প কেন? কার জন্য? তারা বলেছে, ‘আপনাদের জন্য।’ আমরা বলেছি, আমরা যদি সিকিউরিটি না পাই, নাগরিকত্ব কার্ড না পাই, তাহলে কী হবে? তখন তারা জানিয়েছে, এনভিসি (ন্যাশনালিটি ভেরিফিকেশন বা জাতীয়তা যাচাই) কার্ড নিতে হবে।”
মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ‘আমরা বলেছি, এনভিসি কার্ড অতিথিদের জন্য, আমরা এনভিসি কার্ড নেওয়া মানে আমরাও অতিথি বা মেহমানের মতো (বিদেশি বোঝাতে)। এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো জমির মালিক হতে পারব না, নাগরিকত্ব পাব না।’
রাখাইন রাজ্য সফরের সময় আলোচনা প্রসঙ্গে মোহাম্মদ সেলিম আরো বলেন, ‘আমরা দাবি করেছি, আমাদের গ্রামে আমাদের ভিটাজমি ফিরিয়ে দিতে, তখন আমরা নিজেদের টাকায় ঘর তৈরি করে থাকব। আমাদের শেষ কথা হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব, ভিটামাটি না দিলে আমরা মিয়ানমার ফিরে যাব না।’
প্রতিনিধিদলের সদস্য এবং ২৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা সুফিয়ান বলেন, ‘সেখানে গিয়ে আমরা আমাদের দাবি দিয়েছি। আমাদের নাগরিকত্ব দাবি করেছি, ভিটামাটি দাবি করেছি। সেগুলো ফেরত দিলে আমরা যাব, সেটা জানিয়ে এসেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের গ্রামের জায়গাগুলো ঘুরে দেখেছি। কিন্তু দাবি আদায়ের আগে সেখানে যাওয়ার মতো এখনো সুযোগ দেখছি না। আমরা এখানে (বাংলাদেশে) থেকেই ওই দাবি আদায় করে তারপর মিয়ানমার ফিরতে চাই।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রাখাইনের কর্মকর্তারা সফরকারী দলটির কাছে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। পুনর্বাসনের জন্য ১৫টি গ্রামের মধ্যে দুটি গ্রামে এরই মধ্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অন্যান্য দেশের সহায়তায় বাসস্থান তৈরি করেছে। প্রতিদিন ৩০ জন রোহিঙ্গাকে তারা গ্রহণ করবে। এরপর ট্রানজিট ক্যাম্পে তিন দিন রেখে গ্রামে পুনর্বাসন করবে।
পরিদর্শনকারী দল মিয়ানমারের মংডুতে গিয়ে দেখতে পেয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গারা এরই মধ্যে গ্রামে বসবাস করছে। টাউনশিপে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদল রাখাইনে ইতিবাচক ধারণা পেয়েছে। তবে তাঁরা তাঁদের বাসস্থানের পাশাপাশি নিজ গ্রামে প্রত্যাবাসন এবং নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে দাবি জানিয়েছে।
মংডু টাউনশিপের প্রশাসক বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার পর প্রতি পরিবারকে ‘মডেল ভিলেজে’ একটি করে ঘর, কৃষিকাজের জন্য জমি, সার, বীজ ইত্যাদি দেওয়া হবে। তিনি জানান রোহিঙ্গাদের দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ থাকবে। তারা পরবর্তী সময়ে সিটওয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পারবে। প্রতিদিন ৩০ জন করে সপ্তাহে পাঁচ দিনে ১৫০ জন রোহিঙ্গা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মিয়ানমারকে আট লাখ ৬২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছিল। মিয়ানমার ওই তালিকা থেকে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে বাছাই করে। এর মধ্যে প্রথম দফায় এক হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার পাইলট প্রগ্রাম হাতে নেয়। ওই তালিকার রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে গত ১৫ মার্চ মিয়ানমারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্পে তালিকাভুক্তদের মধ্যে ৪৮০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে ফিরে যান।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর প্রবল চাপ রয়েছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতেও (আইসিজে) রোহিঙ্গা জেনোসাইডের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। চীন এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করছে।