যখন খুশি বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোর নতুন আইন নিয়ে উদ্বেগ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:০৮ এএম, ২৪ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বাংলাদেশে গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে এক মাসে তিন দফা দাম বাড়িয়েছে সরকার। চলতি ফেব্রুয়ারি মাস থেকে গ্যাস ও বিদ্যুতের নতুন দাম কার্যকর হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে প্রকাশ্যে গণশুনানি ছাড়া সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে।
বিইআরসি আইন ২০০৩ সংশোধন করে জ্বালানি তেলের মতো গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষমতা এখন সরকারের হাতে নিয়ে নিয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইন সংশোধন করে গ্যাস বিদ্যুতের দাম ইচ্ছামতো বাড়ানোর ক্ষমতা পেল সরকার। জাতীয় সংসদের অধিবেশন আইন সংশোধনের বিল পাশের আলোচনায় একজন সংসদ সদস্য এই সংশোধনীকে কালো আইন হিসেবেও অভিহিত করেছেন।
দাম বাড়ছে যখন-তখন
সরকারের দাবি, বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য আইনের সংশোধন আনা হয়েছে। কিন্ত দেখা গেছে ডিসেম্বর মাসে অধ্যাদেশ জারি করে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ এবং শিল্পের গ্যাসের দাম ১৪-১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে।
আবার জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বিইআরসি আইনের সংশোধনী বিল জাতীয় সংসদে পাশের তিন দিনের মধ্যেই পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশের মতো বাড়ানো হয়। এ দফায় প্রান্তিক গ্রাহকদের বিদ্যুতের মূল্য ইউনিট প্রতি ২০ পয়সা বাড়ানো হয়েছে।
গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণে বিইআরসি আইনের সংশোধনকে দুঃখজনক হিসেবে উল্লেখ করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এটাতো খুবই দুঃখজনক, সাংঘাতিক রকমের দুঃখজনক। দেখা যাচ্ছে মন্ত্রণালয় যে পদ্ধতিতে মূল্য নির্ধারণ করছে তাতে তারা সন্তুষ্ট না। আমিতো এ কারণে অসন্তুষ্ট, দুঃখিত এবং সাংঘাতিক রকমের নেতিবাচক একটা জিনিস হলো যে আমরা এই প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে গেলাম।’
প্রশ্ন করার সুযোগ নেই
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি কিছুটা হলেও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সুযোগ ছিল বলে অনেকে মনে করেন। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের প্রকৃত তথ্য প্রাপ্তি এবং ভোক্তাদের প্রশ্ন করা এবং কথা বলার সুযোগ ছিল।
ইজাজ হোসেন বলেন, যেসব সংস্থা বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিতরণের সাথে জড়িত তাদের খরচ যুক্তিসঙ্গত কিনা কিংবা সেখানে কোনো অপচয় আছে কিনা সেটি পর্যবেক্ষনের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান থাকা দরকার। এটা না থাকলে যেটা হবে তারা এখন যাই করুক না কেন সেটা আর প্রশ্ন করার কেউ থাকলো না।
বিইআরসি আইন ২০০৩ অনুযায়ী জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারনের এখতিয়ার ছিল কমিশনের। বিদ্যুৎ বা গ্যাস কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির আবেদন করলে সেটি গণশুনানির মাধ্যমে যাচাই বাছাই, বিশেষজ্ঞ মতামত এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে যুক্তি তর্ক উপস্থাপনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। প্রতিষ্ঠানগুলো কোথায় কোন খাতে কিভাবে অর্থ ব্যায় করছে সেটিও প্রকাশ্যে আলোচনা হতো। ভোক্তাদের পক্ষ থেকে সেখানে যুক্তি তুলে ধরা এবং প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ ছিল।
কমিশনে দাম বাড়ানোর আবেদন করা হলে যাচাই বাছাই করে সর্বোচ্চ তিনমাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়ার বিধান ছিল বিইআরসি আইনে। ২০০৩ সালের আইনে বছরে একবার দাম বাড়ানোর যে সুযোগ ছিল সেটি ২০২০ সালে সংশোধনী এনে প্রয়োজনে বছরে একাধিক বার মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
পদ্ধতি অনুযায়ী বছরে একাধিকবার দাম সমন্বয়ের সুযোগ বিইআরসি আইনে থাকার পরেও কেন সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে আইনে সংশোধনী এনেছে সে প্রশ্ন অনেকের।
এই সংশোধনী বিদ্যুৎ গ্যাসের মূল্য বাড়াতে সরকারের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা দেবে বলেই সমালোচনা করা হচ্ছে।
ড. ইজাজ হোসেন বলেন, ‘আমি মনে করি এখন যে ফর্মুলায় এসে গেছি তাতে আমরা একটা ভীতির মধ্যে পড়ে গেছি যে এরপরের মাসে কত হবে? এর পরের মাসে নাও হতে পারে। কিন্তু তার পরের মাসে দশ পার্সেন্ট হতে পারে, তারে পরের মাসে বিশ পার্সেন্টও হতে পারে। এখন ইচ্ছামতোই তারা বাড়াতে পারে। ‘
'কালো আইন'
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে সরকার বিইআরসিকে পাশ কাটিয়ে একক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এখন বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম নির্ধারণেও একই পদ্ধতি কার্যকর হবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সরকারের 'অস্বচ্ছতা' রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি তেলে যখন ভর্তুকি দেয়া হয়েছে তখন সেটি ব্যাপকভাবে প্রচার করে দাম বৃদ্ধি করা হলেও দীর্ঘ সময় জ্বালানি তেল বিক্রি করে বিপিসি হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করলেও তখন জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি সরকার। এখন বিদ্যুৎ গ্যাসের ক্ষেত্রে একই পরিস্থিতি তৈরি হবে কিনা সেই আশঙ্কা করছেন ভোক্তারা।
সংসদে বিইআরসি আইন সংশোধনের বিলটি পাশের আগে আলোচনায় সরকার বিরোধী কয়েকজন সংসদ সদস্য বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন। এই সংশোধনী বিলকে কালো আইন উল্লেখ করে বিলটি প্রত্যাহারের দাবি তোলেন সিলেট দুই আসনের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। বক্তব্যে তিনি বলেন, জনগণের কাছে যখন সরকার আস্থা হারায় তখন নিজেদের সুরক্ষার জন্য সরকার কালো আইনের আশ্রয় নেয়।
তিনি বলেন, ‘তাহলে আজকে আমরা কি ধরে নেব যে সরকার জনগণের আস্থা হারিয়েছে এবং অসৎ ব্যবসায়ী ও মুনাফাখোরদের সুরক্ষার জন্য এই কালো আইনের আশ্রয় নিচ্ছে।’ বিইআরসি আইন সংশোধন বিলটি পাশের প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান।
সরকার কী বলছে?
আইনে সংশোধনীর সমালোচনার জবাবে বিদ্যুৎ জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমরা নতুন একটা ধারা সংযোজন করেছি। এটি কোনো ইনডেমনিটি আইন বা কালো আইন নয়।
বিইআরসিকে বাদ দিয়ে আইনটি করা হচ্ছে- এমন সমালোচনার জবাবে প্রতিমন্ত্রী সংসদে বলেন, ‘আইনটা ভাল করে পড়ে দেখেন ভেতরে। বিইআরসি আইন সাথে সাথেই আছে। এটা বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য।’
সমালোচনা হচ্ছে, আইন সংশোধনের মাধ্যমে এ মুহূর্তে এলপিজি ছাড়া সব ধরনের জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ এখন সরকারের হাতে।
তাহলে বিইআরসি আইন সংশোধনের উদ্দেশ্য সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং ইচ্ছামতো গ্যাস বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করা কিনা? এমন প্রশ্নে সরকারের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নয়।
তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রণ সরকার করতে চাইলে তো করত ই। তাহলে তো এটার দরকারই ছিল না। আমার মনে হয় সে উদ্দেশ্যে নয়। জনগণের সরকার যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটার জন্য একটা বিশেষ ক্লজ সংযুক্ত করা হয়েছে ‘
এ দফায় নির্বাহী আদেশে সরকার গৃহস্থলি গ্যাস ও সিএনজির মূল্য বৃদ্ধি করেনি কিন্তু হোটেল রেস্তোরা ও বাণিজ্যিক গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। একই সাথে বেড়েছে সব শ্রেণীর গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম। ফলে এই গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাড়তি চাপ পড়বে সব শ্রেণি ভোক্তা ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়।
এদিকে গ্যাসের উচ্চমূল্য ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই কার্যকরের কথা বলা হলেও গ্যাস সঙ্কট রয়েই গেছে। সম্প্রতি স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু গ্যাস বিদ্যুতের সঙ্কট এবং এর উচ্চ মূল্য নিয়ে চিন্তিত শিল্প কারখানার উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সাধারণ ভোক্তা প্রত্যেকেই।
শিল্প মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি হলো গ্যাসের মূল্য ২৫ টাকায় পুননির্ধারণ করা। এছাড়া আমদানি না হওয়া পর্যন্ত নতুন দাম যেন কার্যকর না হয়। সেই সাথে আমদামি খরচ কমলে সে অনুযায়ী দাম কমানোরও দাবি রয়েছে ব্যবসায়ীদের।