avertisements 2

খুলনা শহরের প্রথম ইমারতের স্থাপনা চার্লির কুঠিবাড়ি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ০১:১১ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২৪

Text

 ছবি: সংগৃহীত 

খুলনা শহরের ডাকবাংলোর অদূরে হুগলি বেকারির মোড় থেকে পশ্চিমমুখী যে রাস্তাটি রেলওয়ে মার্কেটের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে, সেটি ধরে এগোতে থাকলে হাতের ডানে রেলওয়ে স্কুল। সেটি পার করে এগোলে হাতের ডানে একটি পুরনো স্থাপনায় চোখ আটকে যায়। সারি সারি দোকানঘর ওই পুরনো স্থাপনাটিকে প্রায় আড়াল করে ফেলেছে। দুই দোকানের মধ্যখানের একচিলতে রাস্তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে স্থাপনাটি উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।

তবে স্থাপনাটির অবস্থা খুবই খারাপ। ভেঙে পড়ছে। বোঝাই যায়, পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থেকে এর একেবারে দৈন্যদশা। রেলওয়ের মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি হলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ বা সংরক্ষণের পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ নেই।

অথচ এটাই খুলনা শহরের প্রথম ইমারতের স্থাপনা। এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অসীম হলেও পাশের দোকানদারও জানেন না, এটাই খুলনা শহরের প্রথম ভবন।

স্থানটি এখন গাছগাছালি, লতা-গুল্মে পূর্ণ। স্থাপনাটির ইট-সুরকি, পলেস্তারা খসে পড়ছে।

কোথাও কোথাও দেয়ালের ইট আলগা হয়ে ঝরে পড়ছে। বর্ষার পানি জমেছে চত্বরে, দেয়াল ভিজে স্যাঁতসেঁতে। বাড়িটির দোতলায় ওঠার সিঁড়ি থাকলেও সিঁঁড়ির সঙ্গে দোতলার মেঝে সংযোগকারী পাটাতন ভেঙে পড়েছে। বাড়িটির বয়স হয়েছে ২২৯ বছর। অবশ্য এই দীর্ঘ সময়ে বাড়িটি একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে।

ইতিহাস বলছে, ইংরেজ চার্লি সাহেব বাড়িটি ১৭৯৫ সালে তৈরি করেছিলেন। বাড়িটিকে নীলকুঠি হিসেবে ব্যবহার করা হতো, যে কারণে স্থাপনাটি চার্লি সাহেবের কুঠি বা চার্লির বাড়ি বলে পরিচিত।

হ্যাঁ, ১৭৯৫ সালের কথা। ভৈরব-রূপসার তীরে খুলনা শহর গড়ে ওঠেনি, খুলনা তখন নিতান্ত একটি সাধারণ গ্রাম। কিছু কাঁচা স্থাপনা। গুটিকয়েক জনবসতি। খুলনা তখন যশোর জেলার দক্ষিণের একটি অংশ। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি তার শাসনকাজ শুরু করেছে। কলকাতার সঙ্গে নদীপথে খুলনার খুব ভালো যোগাযোগ। আসাম ও পূর্ব বাংলা থেকে লিভারপুল ও অন্যান্য স্থানে কলকাতা হয়ে যাওয়ার সহজ পথ ছিল এই খুলনা। ধীরে ধীরে খুলনায় বন্দর গড়ে ওঠে। ১৭৮১ সালে কম্পানির রায়মঙ্গল লবণ এজেন্সির সদর দপ্তর খুলনার কয়লাঘাটায় স্থানান্তরিত হয়। বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কাজের জন্য ওই ১৭৮১ সালেই খুলনায় প্রথম থানা স্থাপিত হয়।

রায়মঙ্গল এজেন্সির স্থানীয় প্রধান ছিলেন ঈওয়ার্ট (ঊধিত্ঃ)। ব্যবসা দেখভালের জন্য ঈওয়ার্টের একজন প্রতিনিধি খুলনা কেন্দ্রে ছিলেন। নাম চার্লস। ডাকনাম চার্লি। এই চার্লি ইট-কাঠ-লোহার পাকা স্থাপনাটি গড়ে তোলেন। চার্লি তাঁর কুঠির পূর্বদিকে ভৈরবের কূলে হাট বসান। এটিকে বলত চার্লি সাহেবের হাট।

এই কুঠিবাড়িতে বসেই চার্লি তাঁর নীল চাষ এবং সাহেবের হাট পরিচালনা করতেন। এই বাড়িটি একসময় নীলকরদের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সময় গড়ায়, অনেক পরিবর্তন হয়। স্থানীয় জমিদার, গাতিদারদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধ-সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৬ সালে পুরনো থানাকে ঢেলে সাজিয়ে নতুনভাবে নয়াবাদে খুলনা নামে নতুন থানা স্থাপিত হয়। যশোর জেলা সদর থেকে অধিক দূরত্বের খুলনার বিরোধ নিষ্পত্তি সহজতর করতে ১৮৪২ সালে খুলনা মহকুমা স্থাপিত হয়, যা বাংলার প্রথম মহকুমাও বটে।

১৮৮৪ সালে কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারিত হয়। চার্লির কুঠিবাড়ি ও সংলগ্ন এলাকা রেল এলাকা হিসেবে অধিগ্রহণ করা হয়। তখন থেকেই চার্লির বাড়িটি ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কম্পানির (আইজিএনআরসি) কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ওই কম্পানির এজেন্ট ওয়ার্ডসন চার্লির বাড়িতে বসে দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৪৭-এর পর নেভিগেশন ও রেলওয়ে পৃথক দুটি প্রতিষ্ঠান করা হয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে চার্লির বাড়িটি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আঞ্চলিক কার্যালয় করা হয়। ২০০১ সালে খুলনা সিটি করপোরেশন এই বাড়িটিকে ব্যবহার-অযোগ্য বা পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।

বাড়িটির প্রাঙ্গণ এখন রেলওয়ে মার্কেটের ময়লা-আবর্জনা ফেলার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফাঁকা ভাঙা বাড়িতে বখাটে, ভাসমান মাদকসেবী ও বিক্রেতাদের নিরাপদ আনাগোনা। বিআইডব্লিউটিসি আঞ্চলিক কার্যালয়ের সাইনবোর্ডের স্থলে এখন একটি গাছের সঙ্গে লাগানো আছে বাংলাদেশ রেলওয়ের সাইনবোর্ড। তাতে লেখা : ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব সম্পত্তি। কৃষিকাজে ব্যবহারসহ সংরক্ষণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিল্ড কানুনগো, খুলনা। আদেশক্রমে : নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বিভাগীয় ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা, পাকশী।’ নাগরিক নেতা অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির খুলনা শহরের প্রথম স্থাপনাটি সংরক্ষণের জোর দাবি জানিয়ে বলেন, শহর খুলনায় গড়ে ওঠার এই স্মৃতিটি ধরে রাখা একান্ত জরুরি।
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2