মুইজ্জুকে সরাতে ভারতের ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের তথ্য ফাঁস করল ওয়াশিংটন পোস্ট
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩১ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:১৮ পিএম, ৩ জানুয়ারী,শুক্রবার,২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুকে সরাতে ষড়যন্ত্র করেছিল ভারত। সম্প্রতি ভারতের এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের শেষের দিকে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট হন মোহাম্মদ মুইজ্জু। নির্বাচনে জয় পেয়েই তিনি জ্বালাময়ী ভাষণে তার দেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। তার অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিও ছিল এটি। আর শুরু থেকেই মুইজ্জু ভারতের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলার নীতি গ্রহণ করেন। বেইজিংয়ের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করার চেষ্টাও করেন।
এই পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের জানুয়ারি নাগাদ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র)–এর পক্ষে কাজ করা এজেন্টরা মুইজ্জুকে অপসারণের সম্ভাবনা নিয়ে মালদ্বীপের বিরোধী নেতাদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা শুরু করেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটি পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেন তারা। এই আলোচনায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট।
ডেমোক্রেটিক রিনিউয়াল ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক একটি অভ্যন্তরীণ নথি উদ্ধার করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। সেই নথিতে দেখা গেছে, মালদ্বীপের বিরোধী নেতারা মুইজ্জুর নিজ দলের সদস্যসহ ৪০ জন সংসদ সদস্যকে ঘুষ দিয়ে প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের প্রস্তাব দেন। নথিতে আরও দেখা গেছে, মুইজ্জুকে অপসারণ নিশ্চিত করতে ১০ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তা এবং তিনটি প্রভাবশালী অপরাধী চক্রকে অর্থ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। বিভিন্ন পক্ষকে ঘুষ দেয়ার জন্য র–এর এজেন্টরা ৮ কোটি ৭০ লাখ মালদ্বীপি রুপি (প্রায় ৬০ লাখ মার্কিন ডলার) সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিল। মালদ্বীপের দুজন সরকারি কর্মকর্তার মতে, এই অর্থ ভারতের কাছ থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা ছিল।
মাসব্যাপী গোপন আলোচনা সত্ত্বেও, ষড়যন্ত্রকারীরা মুইজ্জুকে অভিশংসনের জন্য যথেষ্ট সমর্থন জোগাড় করতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ভারত মুইজ্জুকে উৎখাতের এই পরিকল্পনায় সমর্থন বা অর্থায়নের দিকে আর এগোয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুইজ্জুকে অপসারণের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলেও এই ঘটনা এবং এর পটভূমি ভারতের সঙ্গে চীনের একটি বৃহত্তর, ছায়া প্রতিযোগিতার একটি বিরল দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। এশিয়ার কৌশলগত এলাকাগুলোতে এবং এর আশপাশের জলসীমায় প্রভাব বিস্তারের যে তীব্র প্রতিযোগিতা বেইজিং ও দিল্লির মধ্যে চলছে সেটি এই ঘটনায় আরও স্পষ্ট।
এই প্রতিযোগিতা বিশেষত ভারত মহাসাগরের ছোট ছোট দেশগুলোতে প্রসারিত হয়েছে, যেখানে এশিয়া মহাদেশের দুটি বৃহত্তম শক্তি তাদের পছন্দের রাজনীতিকদের সমর্থন করতে উদারহস্তে ঋণ, অবকাঠামো প্রকল্প এবং রাজনৈতিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সাহায্য সহযোগিতা প্রকাশ্যে এবং গোপনে দুভাবেই চলছে।
চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়াদিল্লির জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলগত সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। কয়েক দশক ধরে, ভারত মানবিক সহায়তা প্রদান এবং দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোকে সমর্থন করে এসেছে, এই আশায় যে তারা এমন নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ক্ষমতায়ন করবে যারা নিজেদের নয়াদিল্লির সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে যুক্ত থাকবে। এটিই ছিল ভারতের নীতি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত প্রায়ই এই গণতান্ত্রিক আদর্শগুলোর বিপরীত কাজ করেছে এবং নির্বাচিত নেতাদের ওপর আগ্রাসী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এমন সব স্থানীয় ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে, যেখানে সংশ্লিষ্ট শক্তিগুলোকে পাকিস্তানের কাছাকাছি এবং আরও সাম্প্রতিককালে আরও বেশি করে চীনের কাছাকাছি নিয়ে গেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
ভারত মহাসাগরের ১ হাজার ২০০ দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত দ্বীপপুঞ্জ মালদ্বীপ। মাত্র ৫ লাখ জনসংখ্যার একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এটি। গত ১০ বছরে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এলাকার একটি হয়ে উঠেছে এই দ্বীপপুঞ্জ। এখানকার দ্বীপগুলোর কয়েকটির আয়তন কয়েকটি ফুটবল মাঠের সমান বড়, এর ভেতর দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচল করে। এই সমুদ্রপথবর্তী দ্বীপে চীনের সম্ভাব্য স্থাপনা নির্মাণের বিষয়ে ভারতীয় কর্মকর্তারা সতর্ক করে যাচ্ছেন। তাঁদের আশঙ্কা এসব অবকাঠামো থেকে সামুদ্রিক ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ করা হতে পারে বা চীনা যুদ্ধজাহাজ এবং সাবমেরিনের আনাগোনাও দেখা যেতে পারে।
এ বিষয়ে র–এর সাবেক প্রধান হরমিস থারাকান ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, মালদ্বীপে একটি অবস্থান প্রতিষ্ঠা—ভারত, চীন বা যে কেউ তা করতে পারে, এটি ভারত মহাসাগরের একটি বৃহৎ অংশ এবং আরব সাগরের ওপর তাদের উল্লেখযোগ্য সক্ষমতা বাড়াবে।
দায়িত্বে থাকার সময় হরমিস থারাকান মালদ্বীপ সম্পর্কিত বিষয়ে কাজ করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান ঘটনাবলি সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন তিনি। হরমিস বলেন, ‘মালদ্বীপের মতো নিকটতম প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখা ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’