avertisements 2

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি: তদন্তের গতিপথ বদলে দিয়েছিলেন দুই মন্ত্রী

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ অক্টোবর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৪:০৫ এএম, ১৬ অক্টোবর, বুধবার,২০২৪

Text

ছবি : সংগৃহীত 

২০২০ সালের ১ নভেম্বর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছোট সম্মেলন কক্ষে উচ্চ পর্যায়ের একটি সভা আয়োজন করা হয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সভার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ততদিনে ওই ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ করে এনেছে। কিন্তু ঠিক ওই মুহূর্তে তদন্তের গতিপথ বদলে দেয়ার জন্য তদন্তকারী সংস্থাটির ওপর চাপ প্রয়োগ করেন দুই মন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের তৎকালীন দুই সচিব। তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেশী অপরাধীদের নাম বাদ দেয়ার নির্দেশ দেন তারা। যদিও সিআইডির তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, প্রতিবেদন থেকে দেশী অপরাধীদের নাম কোনোভাবেই বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ তাদের অনেকেরই সরাসরি সংশ্লিষ্টতার তথ্যপ্রমাণ ও আলামত এরই মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে।

এরপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে চাপ প্রয়োগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয়। সিআইডির নেতৃত্বে আনা হয় পরিবর্তন। পাশাপাশি মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত ফরেনসিক প্রতিবেদন ও অন্তর্বর্তী তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) হাতে তুলে দেয়ার জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়। এতে সম্মতি না জানালে তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির তিন কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বদলি করে দেয়া হয়। আর নতুন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিনকে।

তার ওপর দেশী অপরাধীদের নাম বাদ দিতে তৎকালীন সিআইডি-প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জোর চাপ প্রয়োগ করা হয়। একই সঙ্গে তদন্তের ফলাফলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে গঠন করা হয় তিন সদস্যের কমিটি। ওই কমিটির মাধ্যমে তদন্তের ফরেনসিক ও অন্তর্বর্তী অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে দেয়া হয় বিএফআইইউর কাছে। বহুল আলোচিত রিজার্ভ চুরির তদন্ত ও মামলার কার্যক্রম সেখানেই থমকে যায়। এর পর থেকে এ পর্যন্ত ৭৯ বার সময় নিয়েও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সিআইডি।

রিজার্ভ চুরির মামলার শুরু থেকে সাত বছর তদন্ত করেছেন রায়হান উদ্দিন খান। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির মামলা তদন্ত শুরুর পর দেশী-বিদেশী অপরাধীদের অপরাধসংশ্লিষ্ট সব তথ্য ধারাবাহিকভাবে সংগ্রহ করা হয়। বিশেষ করে ২০২০ সালেই বিদেশী প্রায় সব তথ্য আমাদের হাতে চলে আসে। সে সময়ই পুলিশ প্রতিবেদন দেয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি শুরু হয়। আমাদের সংগৃহীত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই ফিলিপাইনের আদালতে রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোর সাজা হয়েছিল। পাশাপাশি সে সময় রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া ১০১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা হয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘ওই সময়ই ফিলিপাইনের অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং কাউন্সিল (এএমএলএসি) আমাদের জানিয়েছিল, আমরা যদি বাংলাদেশের আদালতে দেশী-বিদেশী অপরাধীদের চিহ্নিত করে পুলিশ প্রতিবেদন দিতে পারি এবং আরসিবিসি ব্যাংকের বিষয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করাতে পারি তাহলে পুরো অর্থ উদ্ধার সহজ হয়ে যাবে। সে অনুযায়ী আমরা রিজার্ভ চুরি মামলার পুলিশ প্রতিবেদন দেয়ার কাজ শুরু করি। কিন্তু স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে আসা চাপ এবং ফরেনসিক প্রতিবেদনের অনুমোদন না পাওয়ায় সে কার্যক্রম স্তিমিত করে দেয়া হয়। পরে ২০২৩ সালে ফরেনসিক প্রতিবেদন অনুমোদন হলে আমরা চূড়ান্তভাবে রিজার্ভ চুরির পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু সে সময়ও বাংলাদেশী অপরাধীদের নাম বাদ দিতে বলা হয়। তাতে সম্মতি না দিলে আমাকে বদলি করা হয়। সে পর্যন্ত রিজার্ভ চুরির তদন্তে সংগ্রহ করা সব আলামত ও তথ্য দুই স্তরের নিরাপত্তার মাধ্যমে সংরক্ষিত রেখে তদন্তভার নতুন কর্মকর্তার কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যেই ফিলিপাইন ও ভারত থেকে বিদেশী অপরাধীদের নিয়ে তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণ হাতে পেয়ে যায় সিআইডি। সে অনুযায়ী অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হলেও তা জমা দিতে দেয়া হয়নি। উল্টো দুই মন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের সভা করে দেশী অপরাধীদের নাম বাদ দিতে চাপ দেয়া হয়। মামলার গুরুত্বপূর্ণ ফরেনসিক প্রতিবেদন নিয়ে যাওয়া হয় খোদ অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের হাতেই, যদিও ওই প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার এখতিয়ার ছিল শুধু আদালতেরই।

তৎকালীন তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার তদন্ত গুছিয়ে আনার শেষ পর্যায়ে এর গতিপথ বদলে দিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন রিজার্ভ চুরিতে অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২ কর্মকর্তা ও সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। সহায়ক ভূমিকা নেন স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী। তাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তরের কিছু কর্মকর্তার পক্ষ থেকেও বাংলাদেশী অপরাধীদের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়ার বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়।

এতে কাজ না হলে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিএফআইইউ থেকে সিআইডির তৎকালীন প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমানকে জানানো হয়, পরের রোববার অর্থাৎ ১ নভেম্বর রিজার্ভ চুরির তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে তদন্তসংশ্লিষ্টদের উপস্থিত থাকতে বলা হয়। সে সময় বিএফআইইউকে সিআইডি-প্রধান জানান, সভাসংক্রান্ত কোনো লিখিত চিঠি সিআইডি পায়নি। জবাবে বিএফআইইউ থেকে জানানো হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিষয়টি ফোন করে জানাবেন। ওইদিন বিকালে আসাদুজ্জামান খান কামাল ফোন করে সিআইডি-প্রধানকে উচ্চ পর্যায়ের ওই সভায় অংশ নেয়ার নির্দেশনা দেন।

এরপর ১ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছোট সম্মেলন কক্ষে এ সভায় অংশ নিতে যান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রায়হান উদ্দিন খান, তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল এবং সিআইডি প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান। সভাকক্ষে সে সময় উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, বিএফআইইউ-প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, বিএফআইইউর সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ, বিএফআইইউর যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুর রব, পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের প্রতিনিধি সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মইনুর রহমান চৌধুরী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পিএস দেওয়ান মাহবুব। সবাই উপস্থিত হলে সভায় প্রবেশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

সভা শুরুর মিনিট দুয়েকের মধ্যেই জননিরাপত্তা বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন বলেন, ‘এখানে শুধু ইউনিটপ্রধানরা থাকবেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও তদারক কর্মকর্তা থাকতে পারবেন না।’

জবাবে সিআইডির তৎকালীন প্রধান জানান, ‘তদন্ত অগ্রগতির বিষয়গুলো তদন্তকারী কর্মকর্তা ও তদারক কর্মকর্তা ভালো জানেন। তারা না থাকলে এ বিষয়ে অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা সম্ভব হবে না।’

এতে সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘এখন অন্য বিষয়ে কথা বলব। পরে তদন্ত নিয়ে যখন কথা বলব তখন তারা আসবেন।’

রায়হান উদ্দিন খান, মোস্তফা কামাল ও বিএফআইইউ কর্মকর্তা আব্দুর রবকে সভা থেকে বের করে দেয়া হয়।

বৈঠক শেষে নিজ কার্যালয়ে ফিরে তৎকালীন সিআইডি-প্রধান রিজার্ভ চুরি মামলার তদন্তসংশ্লিষ্টদের ডেকে পাঠান। তাদের বলা হয়, দেশী কাউকে চার্জশিটভুক্ত করা যাবে না বলে সভায় তার ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে।

সে সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রায়হান উদ্দিন খান ও তদারক কর্মকর্তা মোস্তফা কামাল জানান, দেশী অপরাধীদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া ফিলিপাইনের এএমএলএসির পক্ষ থেকেও বলা হয়, বাংলাদেশের আদালতে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রকৃত অপরাধীদের যুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়ে দেশী-বিদেশী অপরাধীদের জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করানো গেলে আরসিবিসি ব্যাংক থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফেরত পাওয়া সম্ভব।

পুরো বিষয় শুনে তৎকালীন সিআইডি প্রধান তদন্তসংশ্লিষ্টদের প্রকৃত অপরাধীদের সব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগপত্র প্রস্তুত রাখতে বলেন।

এরপর ২০২২ সালের ২২ আগস্ট সিআইডি-প্রধান হিসেবে যোগ দেন মোহাম্মদ আলী মিয়া। তার যোগদানের পরই সিআইডি কার্যালয়ে রিজার্ভ চুরি মামলার অন্যতম অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের যাতায়াত বেড়ে যায়।

তিনি যোগদানের পর কয়েক দফায় রিজার্ভ চুরি মামলার তদন্তসংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। দেশী অপরাধীদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয়ার নির্দেশনাও দেন তিনি। পাশাপাশি মামলার গুরুত্বপূর্ণ নথি ফরেনসিক রিপোর্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সরবরাহ করতে বলেন। এমনকি এক বৈঠকে মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, ‘আতিউর রহমান স্যার যেভাবে বলে, সেভাবেই অভিযোগপত্র প্রস্তুত করতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে ড. আতিউর রহমানের সেলফোনে যোগযোগের চেষ্টা করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা ও কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ফরেনসিক রিপোর্ট (শুধু আদালতের জন্য প্রস্তুতকৃত) পেতে আদালতে আবেদন করা হয়। যদিও তাতে সাড়া দেননি আদালত। পরে বিধিবহির্ভূতভাবে ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল ফরেনসিক রিপোর্ট সরবরাহের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে চিঠি দেয় বিএফআইইউ। সংস্থাটির অতিরিক্ত পরিচালক কামাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে সিআইডির চূড়ান্ত ফরেনসিক রিপোর্ট ও হালনাগাদ অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন সরবরাহ করতে বলা হয়।

মামলার তদারক কর্মকর্তা তৎকালীন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রায়হান উদ্দিন খান এতে অসম্মতি জানান। তাদের বক্তব্য ছিল মামলাটি আদালতের নির্দেশে তদন্তাধীন। এ কারণে ফরেনসিক রিপোর্ট ও তদন্তের অগ্রগতি প্রতিবেদন আদালত ছাড়া অন্য কোথাও দেয়ার সুযোগ নেই। এমন মন্তব্য দেয়ার পর তাদের দুজনকেই সিআইডি ছাড়তে হয়।

সম্প্রতি মো. হুমায়ুন কবির অতিরিক্ত ডিআইজি (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) হিসেবে আবার সিআইডিতে ফিরে এসেছেন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ চুরি মামলার তদন্তে চাপ থাকলেও আমরা সঠিকভাবে তথ্য সংগ্রহ ও সার্বিক অনুসন্ধান এগিয়ে নিয়েছি। বিশেষ করে রিজার্ভ চুরি মামলার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আইন অনুযায়ী যেটা সঠিক, আমরা সেটাই করেছি।’

মামলার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অন্য সংস্থার কাছে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খানকে ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট বন্ধের দিনেই জয়পুরহাটে বদলি করা হয়। যদিও সেখানে মূলত সিআইডির সর্বোচ্চ পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের দায়িত্ব পালনের কথা। তার এ শাস্তিমূলক পদায়নের পর মামলার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিনকে। পাশাপাশি রিজার্ভ চুরির তদন্ত নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দেন সিআইডি তৎকালীন প্রধান মোহাম্মদ আলী। সে কমিটির প্রধান করা হয় বিশেষ পুলিশ সুপার এসএম রফিকুল ইসলামকে।

এরপর নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ফরেনসিক রিপোর্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দিয়ে আসার নির্দেশনা দেন মোহাম্মদ আলী। পরে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন ফাহিমের করা ফরেনসিক রিপোর্টটি বিএফআইইউর কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তী তদন্ত কর্মকর্তাকে দেশী অপরাধীদের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দেয়ার জন্য চাপ দেন তৎকালীন তদন্ত তদারক কমিটির প্রধান বিশেষ পুলিশ সুপার এসএম রফিকুল ইসলাম। তবে চাপ থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় তদন্তকারী কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিনও দেশী অপরাধীদের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেননি।

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমেরিকার আদালতে করা মামলাটির কমিউনিকেশন ফোকাল পয়েন্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই দেশের আদালতে চলমান মামলায় ফরেনসিক রিপোর্ট সরবরাহের কথা বলা হয়। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে ফরেনসিক রিপোর্টের নির্দিষ্ট কিছু অংশ বিএফআইইউর কাছে দেয়া হয়। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। তদন্ত শেষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিজার্ভ চুরির মামলার তদন্ত অগ্রগতি নিয়ে সবশেষ গত ১৪ জুলাই সিআইডি সদর দপ্তরে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আজমালুল হোসেন কিউসি, বিএফআইইউর তৎকালীন প্রধান মাসুদ বিশ্বাস। সেই বৈঠকে আজমালুল হোসেন কিউসি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ইয়াসিনকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সন্দেহভাজনদের নাম বাদ দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দাখিল করতে বলেন। সে সময় তদন্ত কর্মকর্তা জানান, আলামত ও তথ্য সংগ্রহের শেষ পর্যায়ে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সন্দেহভাজনদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়া সম্ভব নয়।

পরে তৎকালীন সিআইডি-প্রধান মোহাম্মদ আলী তদন্ত কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের রিজার্ভ চুরির সংশ্লিষ্টতার কী প্রমাণ আছে? জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘আগের তদন্তকারী কর্মকর্তা রায়হান উদ্দিন খান ধারাবাহিকভাবে সব তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে রেখে গেছেন। সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন বেশকিছু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে।’

তখন মাসুদ বিশ্বাস তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেন, ‘পারলে দেশী অপরাধীদের নাম দিয়ে চার্জশিট দেন দেখি। প্রধানমন্ত্রীই (শেখ হাসিনা) তাদের নাম বাদ দিয়ে দেবেন।’

যদিও এতে তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা অসম্মতি জানান। রিজার্ভ চুরি মামলার প্রতিবেদন দাখিলের ৭৯তম দিন ছিল গত ১০ সেপ্টেম্বর। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিনের জন্য আবেদন করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2