avertisements 2

ছাগল দেশে, প্রশিক্ষণ বিদেশে

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৫ অক্টোবর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৩৪ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪

Text

বিশ্বখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা স্থানীয় জাতের কালো ছাগল বাংলাদেশের নিজস্ব জাত। এই অঞ্চলে পশুপালনের একেবারে শুরুর সময় থেকে এ ছাগল এখানে ছিল। এবার সেই ছাগলের বিষয়ে ‘উঁচু স্তরের অভিজ্ঞতা’ নিতে সরকারের ১৬ কর্মকর্তা যাবেন বিদেশ সফরে। এ জন্য খরচ হবে প্রায় দেড় কোটি টাকা। বিদেশে প্রশিক্ষণের এ কার্যক্রম নেওয়া হবে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল এর জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন গবেষণা প্রকল্পের’ আওতায়। শেষ দিকে থাকা এ প্রকল্পের জন্য দ্রুত বিদেশ সফর করতে চান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

দেশি এই ছাগলের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে (জীবনরহস্য উন্মোচন) দেশের বিজ্ঞানীরা সফলতা পেয়েছেন বছর চারেক আগেই। দুই যুগ ধরে গবেষণাও চলছে এ ছাগলের ওপর। ছাগলের জিন নিয়ে গবেষণার সুযোগ আছে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি পর্যায়েও দেশি-বিদেশি ছাগলের বিজ্ঞানভিত্তিক বাণিজ্যিক খামার আছে বেশ কয়েকটি।

আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু প্রকল্পের মূল কাজ দেশি ছাগলের জাত সংরক্ষণ, তাই দেশীয় পদ্ধতির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনাই বেশি প্রয়োজন। এর জন্য বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই। আধুনিক যুগে ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। এ নিয়ে বিভিন্ন প্রকাশনাও এখন হাতের নাগালে। একান্ত প্রয়োজন হলে ভার্চুয়ালি বিভিন্ন দেশের সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেও তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগানো যায়।

নাট-বল্টুর কেজি কোটি টাকানাট-বল্টুর কেজি কোটি টাকা
দেশে ছাগলের ওপর প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এ এম ইয়াহিয়া খন্দকার। দেশি ছাগলের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। যদিও প্রকল্প পরিচালক বলছেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে।

কারা যাবেন বিদেশে
বিএলআরআই দুই ভাগে কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। চারজনকে দুই মাসব্যাপী উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হবে। জনপ্রতি ২১ লাখ টাকাসহ মোট খরচ হবে ৮৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া ৬ জন করে দুই দফায় ১২ জন যাবেন শিক্ষাসফরে। তাঁদের মধ্যে থাকবেন বিএলআরআইয়ের ৬ জন, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৪ জন, পরিকল্পনা কমিশনের একজন এবং আইএমইডির একজন। জনপ্রতি খরচ হবে ৫ লাখ টাকা।

নাট-বল্টুই কোটি টাকা, পুরো মেশিন কত? নাট-বল্টুই কোটি টাকা, পুরো মেশিন কত? 
বিএলআরআই বলেছে, কর্মকর্তাদের বিদেশে দুধ-বাচ্চা উৎপাদনক্ষমতার জন্য জিন চিহ্নিত করা; ছাগলের টাইপ তৈরির কৌশল, অ্যাডভান্স ব্রিডিং ডেটা ম্যানেজমেন্ট কৌশল; প্রাণিপুষ্টিবিষয়ক আধুনিক ল্যাবরেটরি কলাকৌশল এবং ডিজিজ রেজিস্ট্যান্স জিন চিহ্নিত করার কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তুরস্ক, স্পেন, ইতালি ও মিসরের মধ্যে এক বা একাধিক দেশে যাবেন। তবে দেশ এখনো নির্দিষ্ট হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে অন্যান্য অঞ্চলে ছাগলের চাহিদা খুবই কম। আর ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল শুধু এ অঞ্চলেই মেলে। ছাগল দেশে, প্রশিক্ষণ বিদেশে

পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন
২০১৮ সালেই দেশে এ ছাগলের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচনে সফলতা পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএলআরআইয়ের একদল গবেষক। পরে চট্টগ্রামের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরাও এ সফলতা পেয়েছেন। জীবের অঙ্গসংস্থান, জন্ম, বৃদ্ধি, প্রজনন, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াসহ সব জৈবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় এর জিনোমে সংরক্ষিত নির্দেশনা দ্বারা। এতে ছাগলের ওজন বৃদ্ধির হার, দুধ উৎপাদন, বাচ্চা উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ও মাংসের গঠনসংক্রান্ত জিন আবিষ্কার করার পথ সহজ হয়। ছাগল নিয়ে অনেক গবেষণা দেশেই হয়েছে। প্রাণীর জিন বিষয়ে কাজের সুযোগও আছে।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে বিলাসী ভ্রমণসরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে বিলাসী ভ্রমণ
দেশি ছাগলের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচনের গবেষক দলের অন্যতম সদস্য বর্তমানে বিএলআরআইয়ের মহিষ গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. গৌতম কুমার দেব। তিনি বলেন, ‘প্রাণীর জিন নিয়ে গবেষণার মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে আমাদের দেশে। কয়েকজন গবেষকও কাজ করছেন। বিএলআরআইও শুরু করতে যাচ্ছে। তবে আমাদের জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের গবেষণার ধারাবাহিকতা আর হয়নি।’

দলের প্রধান গবেষক ড. এ এম ইয়াহিয়া খন্দকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কেউ গবেষণা করতে চাইলে এই জিনোম সিকোয়েন্সিং অনেক কাজে লাগবে। তবে আরও গবেষণা প্রয়োজন, তার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ দেশি ছাগল নিয়ে অভিজ্ঞতার জন্য বিদেশ সফরের উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল দেশি প্রাণী। এর জন্য অন্য দেশে কীভাবে প্রশিক্ষণ হবে? আবার ছাগল ও ভেড়া একই ধরনের প্রাণী। ভেড়া নিয়ে দেশে পর্যাপ্ত গবেষণা আছে, তা কাজে লাগতে পারে। বিদেশ থেকে শেখার কিছু নেই। এখন অনলাইনের যুগ, যেকোনো ইনোভেশন দেশে প্রয়োগ করে দেখলেই চলে, তা উপযোগী কি না। আমাদের দেশে প্রকল্পে কাজের চেয়ে বিদেশ সফরে বেশি নজর থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রাণীর জিন গবেষণায় দেশেই অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ খাতে আমরা যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছি। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ বিএলআরআইকে নিয়েই করেছিলাম, যেন এগিয়ে যেতে পারি। কিন্তু তারা এখন মনে করে, নিজেরাই সব করবে।’

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের পরিপত্র জারিসরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের পরিপত্র জারি
প্রকল্প পরিচালক ও বিএলআরআইয়ের ছাগল গবেষণাবিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ছাদেক আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রকল্পের বিদেশ সফর নিয়ে এখনো সরকারের বিধিনিষেধ রয়েছে। তাই সফর এখনো হয়নি। তবে আমরা মন্ত্রণালয়ে জানাব, মন্ত্রণালয় অনুমতি দিলেই বিদেশে পাঠানো হবে। এখনো কোনো দেশ ঠিক হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ জুনে শেষ হবে। তার আগেই এটা করতে হবে।’

ছাদেক আহমেদের দাবি, দেশে যে ধরনের জিনগত কাজের সুযোগ আছে, ছাগলের ওপর গবেষণা তার ব্যতিক্রম। প্রশিক্ষণার্থীরা বিদেশে গিয়ে ছাগলের ওপর সেই ব্যতিক্রম কিছু শিখবেন।

সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধে রিটসরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধে রিট
বিএলআরআইয়ের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় গরু-ছাগলের ওপর জ্ঞান অর্জনে বিদেশ সফরের ব্যবস্থা রয়েছে, প্রকল্পটি চলমান। তবে করোনার কারণে সেখানেও সফর শুরু হয়নি।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশে মোট ছাগলের শতকরা ৯০ ভাগই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের। বছরে প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার টন ছাগলের মাংস উৎপাদিত হয়, যা গবাদিপশুর মোট উৎপাদিত মাংসের প্রায় ২৫ শতাংশ।

প্রকল্পে কী থাকবে, অগ্রগতি কত দূর 
২০১৯ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল গত জুনে। সময় বাড়ানোয় তা শেষ হবে আগামী জুনে। ৩১ কোটি টাকার এ প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজই প্রশিক্ষণসংক্রান্ত। গত জুন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৪ কোটি টাকা। অগ্রগতি ৪৬ শতাংশ। আট মাসের মধ্যেই প্রকল্প শেষ করতে হবে। ছাগলের ওপর ১২টি বিশদ গবেষণা হবে এ প্রকল্পের মাধ্যমে।

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের পরিপত্র জারিসরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের পরিপত্র জারি
প্রকল্পের মূল লক্ষ্যের মধ্যে আছে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন এবং ছাগলের সমাজভিত্তিক উন্নয়ন, পুষ্টি ও রোগব্যাধিসংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়ন এবং এ খাতে মানবসম্পদ উন্নয়ন।

জনগণের অর্থে এমন কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান  বলেন, জনগণের অর্থ ব্যয় করে দেশি প্রাণীর ওপর বিদেশে প্রশিক্ষণের মতো কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যৌক্তিকতাসহ এটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। এ ধরনের সিদ্ধান্ত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণের সঙ্গে যায় না। তা ছাড়া এখন বিশেষ সময়ে সরকার বিদেশ সফরের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। তাই এ সময়ে এটির যৌক্তিকতা একেবারেই নেই। এ সফর আয়োজন করা হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করা হবে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2