নীরব ঘাতক উচ্চ রক্তচাপ : কমিউনিটি পর্যায়ে প্রতিরোধই জরুরি
ড. মিহির কান্তি মজুমদার
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ মে,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৩৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আমাদের অধিকাংশ স্বাস্থ্য সমস্যা প্রকৃতপক্ষে সামাজিক সমস্যা, যা যথাসময়ে নিরসন না হলে স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন এর ব্যতিক্রম নয়। যেসব কারণে সাধারণত উচ্চ রক্তচাপ হয়, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস। যেমন বেশি ভাত বা কার্বোহাইড্রেট খাওয়া, উচ্চ চর্বি ও ট্র্যান্সফ্যাট যুক্ত খাবার খাওয়া, বেশি করে লবণ খাওয়া, ফল ও শাক সবজি কম খাওয়া ইত্যাদি। পাশাপাশি ধূমপান করা, কায়িক পরিশ্রম কম করা, ব্যায়াম না করা, ওজন বেশি বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া এসব অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টিতে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখে। এর বাইরে পারিবারিক ইতিহাস, অন্যান্য রোগের এবং কোন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদির কারণেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা যায়। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই উচ্চ রক্তচাপকে একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা গণ্য করে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর ১৭ মে তারিখ বিশ্ব হাইপারটেনশন দিবস পালন করা হয়।
উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কারণ উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও প্রায় অর্ধেক মানুষ জানেন না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। যারা জানেন তাদের প্রায় অর্ধেক অংশ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের চিকিৎসা এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস পরিত্যাগের উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। যারা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ ও চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন, তাদের একটা বড় অংশ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন না । এ সুযোগে উচ্চ রক্তচাপ নীরবে শরীরের হার্ট, কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে। যা পরবর্তী সময়ে নিরসন করা যায় না এবং নীরব ঘাতক হিসেবে অনেক রোগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।
পৃথিবীব্যাপী দিন দিন উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ১৯৭৫ সালে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫.৯৪ কোটি, ২০১৭ সালে তা অতিমাত্রায় বেড়ে ১২৮ কোটি অতিক্রম করেছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত এ সকল মানুষের অধিকাংশের বাস এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশে। বিশ্বে উচ্চ রক্তচাপের রোগীর হার সবচেয়ে আফ্রিকায় বেশি, এর পরেই আছে এশিয়া এবং সবচেয়ে কম আমেরিকা মহাদেশে। তবে এশিয়ায় পৃথিবীর প্রায় ৬০% মানুষ বাস করে, সে কারণে উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ বছরে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৩% নামিয়ে আনার আন্তর্জাতিক টার্গেট নির্ধারণ করেছিল। ২০৩০ আসতে আরো ৮ বছর সময় লাগবে, কিন্তু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যে গতিতে বাড়ছে, তাতে এ হার মোটেই কমার সম্ভাবনা নেই। বরং উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্তের হার আরও অনেক বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি।
বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাচিত্র আনুপাতিক হারে অনেকটাই বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি ৪ জন মানুষের মধ্যে কমপক্ষে ১ জন বা তার বেশি উচ্চ রক্তচাপের রোগী আছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশে ২০১১ সালে ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের ৩২% নারী এবং ২০% পুরুষের উচ্চ রক্তচাপ ছিল। ২০১৭-১৮ বছরে এ হার যথাক্রমে ৪৫% ও ৩৪%-এ উন্নীত হয়েছে। প্রতি বছর গড়ে বৃদ্ধির পরিমাণ ২%। এ ধারাবাহিকতায় বর্তমানের চিত্র আরও আশঙ্কাজনক সন্দেহ নেই। ৩৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে যে উক্ত উচ্চ রক্তচাপের রোগী নেই, তা কিন্তু নয়। বিডিএইচএস-এর উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৪ বয়সের ১৩% নারী-পুরুষের উচ্চ রক্তচাপ আছে এবং এদের প্রায় ১৮% উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ বা ওষুধ সেবন করেন না।
নিজের উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে ধারণা না থাকা, উদাসীন থাকা এবং কোন প্রকার ওষুধ সেবন না করার প্রবণতা এ দেশে বয়স্ক লোকের মধ্যে অনেক বেশি। ৩৫ বছরের ওপরের বয়সী নারীর ৫১% জানেন না, তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। প্রায় ৬% উচ্চ রক্তচাপ থাকার তথ্য জেনেও তা নিয়ন্ত্রণের কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেন না। প্রায় ২৮% উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন, কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে পারেন না। মাত্র ১৫% নারী উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। বিডিএইচএস-এর উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এ দেশে ৩৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষের ৬৭%-ই জানেন না, তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। জেনেও সম্পূর্ণ উদাসীন থাকেন ৫%, চিকিৎসা নিয়েও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না ২০%। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন এমন পুরুষ রোগীর সংখ্যা মাত্র ৯%। কাজেই উচ্চ রক্তচাপ থাকা সত্ত্বেও তা না জানা, জেনেও উদাসীন থাকা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারার পাল্লাই ভারী। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে মাত্র ১৫% নারী ও ৯% পুরুষ তা নিয়ন্ত্রণে রাখেন।
চিত্রটি আশঙ্কাজনক সন্দেহ নেই। এদেশে উচ্চ রক্তচাপের রোগীর সংখ্যা প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ খুবই কম সংখ্যক নারী-পুরুষ তা নিয়ন্ত্রণে রাখেন। এভাবে চলতে থাকলে হƒদরোগ, কিডনি রোগ, স্ট্রোক ও অন্যান্য মারণঘাতী অসংক্রামক রোগীর সংখ্যা এতো বৃদ্ধি পাবে যে গ্রামে গ্রামে হাসপাতাল তৈরি করেও রক্ষা পাওয়া যাবে না। সবাই যদি রোগী হয়, তবে উৎপাদন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিম্নগামী হবে। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে চলবো এবং উচ্চ রক্তচাপের মহামারী চলতে সহযোগিতা করবো- এ দুটো পাশাপাশি চলে না।
উচ্চ রক্তচাপ রক্ত প্রবাহের শিরার গাত্র শক্ত করে এবং সরু হতে সাহায্য করে। এতে দেহকোষে রক্ত ও অক্সিজেন প্রবাহ বিঘ্নিত হয়। হার্টে রক্তপ্রবাহ বিঘ্নিত হলে হৃদরোগের সৃষ্টি হয় এবং রক্তপ্রবাহ সাময়িক সময়ে বন্ধ হলেই রোগী হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়। এরূপ বিঘ্নিত রক্তপ্রবাহ মস্তিষ্কে স্ট্রোক ঘটায়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্টকে অতিরিক্ত পাম্প করতে হয়। সে কারণে হার্ট ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয় এবং প্রয়োজনীয় রক্ত পাম্প করতে পারে না। উচ্চ রক্তচাপ কিডনিতে রক্তনালী সরু ও দুর্বল করে মারাত্মক কিডনি রোগ সৃষ্টি করে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে শরীরের বিপাকক্রিয়া বিঘ্নিত হয়। এতে ট্রাইগ্লিসারাইড বেড়ে যায়, স্বাস্থ্যসম্মত কোলেস্টেরল (এইচডিএল) কমে যায়। এভাবে উচ্চ রক্তচাপের বহুমাত্রিক প্রভাব নীরবে বিভিন্ন মাত্রার মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
কাজেই, আমাদের সমাজে উচ্চ রক্তচাপের বৃদ্ধির মাত্রা এতোটাই প্রকট যে, এ মুহূর্তে লাগাম টানার কোন বিকল্প নেই। এটি স্বাস্থ্য বিভাগের একার কাজ নয়। কোন সামাজিক সমস্যা নিরসনে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সামাজিক সমস্যা আলাদা কিছু নয়। আমরা একটা চিকিৎসামুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উত্তরাধিকাসূত্রে পেয়েছি। প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম সেখানে গৌণ। এ অবস্থা অব্যাহত রাখার দিন শেষ। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না রাখার ভয়াবহতা সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে হবে। কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রাণিজ চর্বি ও ট্র্যান্সফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করা, ধূমপান না করা, লবণ কম খাওয়া, ফল ও শাক-সবজি খাওয়া, বেশি কার্বোহাইড্রেট না খাওয়া- উচ্চ রক্তচাপের এসব উৎস সম্পর্কে জানতে হবে ও জানাতে হবে। উচ্চ রক্তচাপ যেহেতু একটি সামাজিক সমস্যা, কাজেই সমাজ বা কমিউনিটি পর্যায়ে তা স্ক্রিনিং বা প্রাথমিক শনাক্তকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিশেষ করে কমিউনিটি পর্যায়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। উদ্দীপন নামের এনজিও গ্রাম পর্যায়ে ‘স্বাস্থ্য আপা’ নামে স্বাস্থ্য ভলান্টিয়ার তৈরি শুরু করেছে। গত ৮ মাসে উদ্দীপনের স্বাস্থ্যকর্মীরা কমিউনিটি পর্যায়ে অয়োজিত স্বাস্থ্য ক্যাম্প এবং দশ হাজারের বেশি সমিতি বৈঠকে ২ লক্ষাধিক ব্যক্তির রক্তচাপ ও গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করেছে। সেখানে ৪১% ব্যক্তির উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হয়েছে। দেশের ৩৬৬টি থানায় আয়োজিত উদ্দীপনের স্বাস্থ্য ক্যাম্পে ১০,২৫৯ জন পুলিশ সদস্যের ৪০%-এর শরীরে উচ্চ রক্তচাপের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। উদ্দীপনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ উদ্যোগের ব্যাপ্তি দ্রুত বাড়াতে হবে। বিদ্যালয় স্বাস্থ্য শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে মুখ্য ভূমিকায় আনতে হবে। তাহলেই বিশ^ হাইপারটেনশন দিবসের উদ্দেশ্য সফল হবে।
-----------------------------------------------------------------------------
লেখকঃ সাবেক সচিব