ওমিক্রনের চূড়া থেকে কি নেমেছে বাংলাদেশ?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ১২:১৪ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
গত তিনদিন ধরে দেশে দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত) ভাইরাসটিতে নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৩৪৫ জন। তার আগের দিন ৫ ফেব্রুয়ারিতে ৮ হাজার ৩৫৯ এবং তার আগেরদিন (৪ ফেব্রুয়ারি) ৯ হাজার ৫২ জনের শনাক্ত হওয়ার কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। ৪ ফেব্রুয়ারিতে শনাক্ত হওয়া এই রোগীর সংখ্যা গত ২২ জানুয়ারির পর সর্বনিম্ন। ওই দিন ৯ হাজার ৬১৪ জনের শনাক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিল অধিদফতর। ২৩ জানুয়ারি শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ৯০৬ জনে দাঁড়ায়। আর মূলত দেশে অতি সংক্রমণশীল ওমিক্রনের তান্ডব শুরু হয় মধ্য জানুয়ারি থেকেই।
২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের প্রায় দুই বছর ধরে চলা এ মহামারির সংক্রমণচিত্রে ঊর্ধ্বগতি-নিম্নমুখী চিত্র দেখেছে দেশ। তবে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দেখা গিয়েছে গত বছরের জুন জুলাই ও আগস্ট মাসে। ডেল্টার তান্ডবে সেসময়ে দেশ একদিনে সর্বোচ্চ রোগী আর সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখেছে। তবে আগস্টের শেষদিকে এসে সংক্রমণ কমতে শুরু করে, এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই চলে আসে। শনাক্তের হার কমে আসে ১ শতাংশের কাছাকাছি। তবে বছর শেষে নতুন ত্রাসের জন্ম দেয় করোনার অতিসংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। ডেল্টার তুলনায় পাঁচ থেকে ছয়গুণ বেশি সংক্রমণক্ষমতা নিয়ে ওমিক্রন ছড়াতে থাকে বাতাসের গতিতে। আর চলতি বছরের মধ্য জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ ফের ঊর্ধ্বমুখী থেকে গত ৪ ফেব্রুয়ারিতে একদিনে শনাক্ত নেমে আসলো ১০ হাজারের নিচে।
ওমিক্রনের শুরুতে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, অতিসংক্রমণশীল এই ভ্যারিয়েন্টের গত বছরের ভয়ংকর ডেল্টাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটাকে সত্যি করে করোনা মহামারিকালের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ রোগী শনাক্তের হার রেকর্ড হয়েছে এই ওমিক্রন সুনামিতে।
ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর গত ৬ জানুয়ারি দৈনিক রোগী শনাক্ত হাজার ছাড়ায়। এর দুই সপ্তাহের মাথায় ২০ জানুয়ারি দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে ১৬ হাজার পর্যন্ত হয়। আর গত ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নতুন শনাক্ত রোগী সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের উপরে। সেইসঙ্গে গত ২৮ জানুয়ারি ডেল্টার শনাক্তের হারের রেকর্ডকে পেছনে ফেলে সেদিন রোগী শনাক্তের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর আগে গত বছরে ডেল্টার সময়ে ২৪ জুলাই শনাক্তের সর্বোচ্চ হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
যদিও গত তিনদিন ধরে সংক্রমণের এই নিম্নমুখিতাকে এটা প্রকৃতপক্ষে নিম্নমুখী কিনা তা বলার সময় এখনও আসেনি। বর্তমান পরিস্থিতিকে ধরে রাখতে আরও বেশি করে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি করোনার নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিলেও সতর্ক থাকতে হবে। গত ১ সপ্তাহে সংক্রমণের যে চিত্র ছিল, গত দুই দিনে আমরা কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতা দেখছি। প্রকৃতভাবে নিম্নমুখী কি না, এটি এখনও বলার সময় হয়নি।
আর সংক্রমণের ‘নিম্নমুখিতায় আমরা যেন আত্মতুষ্টিতে না ভুগি’ সে বিষয়ে সর্তক করে নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যেন আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেই। সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরার এবং আরও বেশি করে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে।’
ওমিক্রনে সংক্রমণের চূড়া পার করলো কিনা বাংলাদেশ প্রশ্নে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্বজুড়েই ওমিক্রনের সংক্রমন যেভাবে শার্পলি উঠেছে, ততোটাই দ্রুত নেমে গেছে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে। ওমিক্রনের চূড়া থেকে নেমে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
ওমিক্রনের চূড়া দ্রুত ওঠা-নামা করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমিতো ভেবেছিলাম, আরও হয়তো এক সপ্তাহ থাকবে, কিন্তু নেমে এখন সেটা নেমে যাচ্ছে। মৃত্যু আজ কিছুটা কমেছে, কিন্তু তারপরও মৃত্যু নিয়ে কথা বলার সময় এখনও আসেনি। মৃত্যু যে বাড়ছিল, সেটা হলো, দুই থেকে তিন সপ্তাহ আগে থেকে ওমিক্রন বাড়ছিল। তার ইফেক্ট (প্রভাব), কমার ইফেক্ট দেখতে আরও সপ্তাহ খানেক লাগবে।’
তবে সংক্রমণ কমে আসায় স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার কোনও সুযোগ নেই উল্লেখ করে এই মহামারী বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দেশেতো এমনিতেই স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে শিথিলতা ছিল আগে থেকেই, এরপর ওমিক্রনের গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকজন পরিচিত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে- যাদের সবাই চেনেন। কিন্তু আবার যেহেতু শনাক্তের হার কমে যাচ্ছে, তাই আবারও শিথিলতা আসতে পারে।’
আর এই শিথিলতা নিরসনে ‘অর্গানাইজড অ্যাপ্রোচ বা ইনস্টিটিউটশনাল অ্যাপ্রোচ’ রেখে সরকারকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, যে কোনও প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে, জোর দিতে হবে। রেস্টুরেন্ট, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, গণপরিবহন, বাস-রেলওয়ে স্টেশনসহ যেখানে ভিড় বেশি হয়, সেখানের জন্য বলবো সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কাজ করতে হবে, বিনা পয়সায় মাস্ক বিতরণ করতে হবে।
ওমিক্রনের চূড়া নেমেছে, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখিতাও কমেছে বলে মনে করছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা। তিনিও বলেন, ‘ওমিক্রনের চূড়া পার হয়েছে দেশে। কারন মধ্য জানুয়ারিতে তার ল্যাবে যেভাবে শনাক্তের হার ছিল সেটা গত কয়েকদিনে কমে এসেছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখিতা সারা দেশে যেমন কমেছে তেমনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজেও কমেছে অনেক।’
‘মধ্য জানুয়ারির ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। সে সময় দৈনিক শনাক্তের হার ৪৫ থেকে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত পেয়েছি, কিন্তু আজ (রবিবার) পেয়েছি ১৮ শতাংশের মতো অথবা এর চেয়েও কম। গতকাল ছিল ২০ থেকে ২২ শতাংশ। সংক্রমণের হার কমছে, ভালো কমছে’, মন্তব্য ডা. নুসরাত সুলতানার। তার ভাষ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও দেখা গেছে যেভাবে ওমিক্রনের শনাক্ত বাড়ছিল, সেভাবেই কমেছে।
গত জানুয়ারির প্রথম থেকে ওমিক্রনের ঊর্ধ্বমুখিতা ছিল, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এসে সেটা ‘শেষের দিকে দেখা যাচ্ছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তবুও আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে সঠিকভাবে। আর দেশে টিকাদান কর্মসূচিতে টার্গেট হলো ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ। এই সংখ্যা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের প্রতিটি মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কারণ ঘরে ঘরে যেসব বয়স্করা আছেন, যারা অন্য জটিলরোগে আক্রান্ত তাদের জন্য আমাদের সাবধান থাকা উচিত।’
গত দুই বছরে বয়স্কদের বাসার বাইরে যাওয়ার সংখ্যা অনেক কমে গেছে, যারা বাইরে যাচ্ছেন তাদের মাধ্যমে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন জানিয়ে ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ‘তাই যারা বাইরে বের হচ্ছেন তাদের সঠিকভাবে নাক মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে, থুতনিতে ঝুলিয়ে বা ব্যাগে রাখলে হবে না। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে সঠিক নিয়মে।’