কোভিড-১৯, তারপর?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:১৭ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর,রবিবার,২০২০ | আপডেট: ১১:০৬ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
কোভিড-১৯ রোগটি সাথে আমাদের পরিচয় আট মাস। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও এই ভয়াবহ রোগটি সাহসের সাথে মোকাবেলা করছে। স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের পাশাপাশি আর্থ সামাজিক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দেশের মানুষ।
ঠিক এরকম একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে (নিউ নরমাল) সময়ে চিকিৎসা সেবা জগতের এক নতুন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের রোগ পরবর্তী বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও সমাধান।
কোভিড-১৯ রোগটি নতুন। এই রোগের লক্ষণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা জনসাধারণের পাশাপাশি চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মাঝেও নতুন। রোগটির ২০০৩ সালের সার্স কোভ-১ এবং ২০১২ সালের মার্স করোনাভাইরাসের কিছু উপসর্গ, জটিলতা ও উপশমের সাথে ধারাবাহিক মিল রয়েছে।
এমন কি ২০০৩ হতে ২০১৮ পর্যন্ত ১৫ বছরের পুঞ্জীভূত তথ্যগত অভিজ্ঞতা ও ফলোআপের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে যার আলোকে একই গোত্রের এই নতুন সার্স কোভ-২ ভাইরাসটির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা করে আমাদের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়ে নিচ্ছি।
বিশ্বে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মাঝে দেড় কোটির বেশি মানুষ সুস্থ হয়েছেন। যারা সুস্থ হয়েছেন তাদের অনেকেই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উপসর্গবিহীন অথবা মৃদু লক্ষণযুক্ত রোগীরা দুই সপ্তাহের মধ্যে এবং মাঝারি, তীব্র ও মারাত্মক লক্ষণযুক্ত রোগীরা চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে ওঠেন। রোগ পরবর্তী সময়ে এদের অনেকেরই একান্ত উদ্বেগের বিষয়, এরপর কি? সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব কি? এখন আমাদের কি করণীয়?
বস্তুত কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অধিকাংশরোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারেন। মাঝে মাঝে এই রোগটির কিছু ধারাবাহিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই প্রতিটি করোনা রোগীর এ ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি। এ কারণে কিছু সম্ভাব্য জটিলতা নিয়ে আজকের এই আলোচনা।
বক্ষব্যাধি বিষয়ক সমস্যা
করোনা রোগটি প্রাথমিকভাবে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ভাইরাসটি যদি ফুসফুসে ক্ষত সৃষ্টি করে (গ্রাউন্ড গ্লাস ওপাসিটি, সীমিত কনসলিডেশন ইত্যাদি) তাহলে আমাদের দেহ শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সেই ক্ষত পূরণ করে নেয় ও ফুসফুস স্বাভাবিকভাবে কাজ করে। অন্যদিকে আক্রান্ত ক্ষত যদি ব্যাপক হয় (যেমন- উভয়দিকের মারাত্মক কনসলিডেশন, এ আর ডি এস, ভাসকুলার থিকেনিং, ব্রংকিয়েকটেসিস ইত্যাদি)।
সেক্ষেত্রে কখনও কখনও এই ক্ষতগুলো পূরণ হবার পরও ফুসফুসে স্কার বা ফাইব্রোসিস, সহজ বাংলায় ‘দাগ’ থেকে যায়। রোগীর ফুসফুসের স্বাভাবিক কার্যক্রম অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যহত হতে পারে। রোগী অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠতে পারেন। এতে সাংসারিক ও দাপ্তরিক কাজকর্ম করা কষ্ট স্বাধ্য হয়ে পড়তে পারে।
পরবর্তীতে ঘন ঘন কফ, কাশি, বুকে ব্যাথা, ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষত যারা আগে থেকেই বিভিন্ন শ্বাসজনিত রোগ যেমন- অ্যাজমা, সিওপিডি ও অন্যান্য জটিল রোগে ভুগছিলেন তাদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে। তবে আতংকিত না হয়ে নিয়মিত বক্ষব্যাধি চিকিৎসকের পরামর্শ, ধারাবাহিক ফলোআপ এবং ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা এবং ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করলে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।
ব্রিটিশ থোরাসিক সোসাইটির পরামর্শ অনুযায়ী করোনা পরবর্তী তিন মাস পর অবশ্যই প্রত্যেক রোগীর একটি বুকের এক্সরে এবং পালমোনারি ফাংশন টেস্ট করে নেওয়া উচিত। পালমোনারি পুনর্বাসন একটি প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা পদ্ধতি হলে আমাদের দেশে স্বল্প প্রচলিত। করোনা পরবর্তী সময়ে এর ব্যাপক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
হৃদরোগ বিষয়ক সমস্যা
কখনও কখনও করোনাভাইরাস আমাদের হৃদযন্ত্রকেও আক্রান্ত করতে পারে। যেমন- ভাইরাল মায়োকারডাইটিস, ডায়ালেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি ইত্যাদি। এ সকল রোগীদের বুক ধড়ফড় করা, অস্থিরতা, বুকে ব্যথা এমনকি শ্বাসকষ্ট ও পায়ে পানি আসা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো মৃদু লক্ষণ এবং এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই লক্ষণের সঠিক চিকিৎসা সময়মতো না হলে রোগীর ক্ষতি হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজনে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
নার্ভ ও ব্রেইনের বিভিন্ন সমস্যা
অনেক সময় কোভিড রোগী শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার পাশাপাশি কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ নিয়েও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। যেমন- ব্রেইন স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধা। এ ছাড়া ভাইরাসের প্রভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভিন্ন ভাবে তীব্ররূপে ব্যবহৃত হয়ে ফুসফুসের ক্ষতি করে।
একই উপায়ে এটি বিভিন্ন নার্ভ এর ক্ষতি করে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে দুর্বল করে দিতে পারে। সার্স, মার্স ও অন্যান্য সাধারণ কয়েকটি ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমন রোগের (যেমন- গুলেন বারি সিন্ড্রোম, ট্রান্সভার্স মায়ালাইটিস, সিআইডিপি এনকেফালাইটিস ইত্যাদি) প্রাদুর্ভাব রিপোর্ট করা রয়েছে।
এ সকল রোগের ফলে শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের অসাড়তা, ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা, স্পর্শ বা অনুভুতি বোধের সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এই রোগগুলো ভাইরাস আক্রমণের জটিলতায় সৃষ্টি হয়। অন্য ভাইরাসের মতো সার্স কোভ-২ বা করোনাভাইরাস একইভাবে এ সকল জটিল নিউরোলজিকাল রোগ করতে পারে কিনা সেটি নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসে নাই।
রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তনালীর বিভিন্ন সমস্যা
কোভিড-১৯ আক্রান্তকালীন যখন রোগটির তীব্রতর অবস্থা থাকে তখন শরীরের বিভিন্ন রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা দেখা দেয়। এই রক্তনালী দ্বারা যে সব অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন থাকে সে সকল অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। যেমন- ফুসফুস, হার্ট, ব্রেন, কিডনি।
তাই চিকিৎসকরা প্রথম থেকেই রক্ত তরল করার বিভিন্ন ঔষধ ইনজেকশনের মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে মুখে খাওয়ার ঔষধের মাধ্যমে প্রয়োগ করে থাকে। এই রক্ত জমাট বাধার প্রক্রিয়া কতদিন স্থায়ী হবে সেটি এখনও গবেষণাধীন।
অন্যান্য প্রত্যঙ্গে প্রভাব
কোভিড রোগাক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সার্স কোভ-২ দ্বারা আকস্মিক কিডনি ও লিভার বিকল ইত্যাদি রোগের মোকাবেলা করে থাকেন। কিন্তু কোভিড রোগটি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হবার পর এই কিডনি বা লিভার বিকল হওয়ার ও সম্পূর্ণ আগের অবস্থায় ফিরবে নাকি কিছু ক্ষতি রয়ে যাবে- সেটা নির্ণয়ের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন রোগীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা প্রয়োজন। বিশেষত যারা আগে থেকেই কিডনি ও লিভারের বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন তাদের জন্য ব্যপারটি আরও গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
এ পর্যন্ত আলোচিত এসব মারাত্মক ও ভীতিকর রোগের বর্ণনায় আতংকিত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। বাস্তবতা হচ্ছে এই সমস্যাগুলো অল্প সংখ্যক ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে তবে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে এগুলো বেশি হতে পারে। সাধারণত কোভিড রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রোগ পরবর্তী সময়ে রোগীরা প্রচণ্ড দুর্বলতায় ভোগেন, কাজে অমনোযোগিতা, মানসিক বিক্ষিপ্ততা, মাথাব্যাথা ও মাথা ঘোরা, হাত-পা জ্বালাপোড়া ইত্যাদি সমস্যায় ভোগেন।
অনেকের ক্ষেত্রে নিকট অতীতের স্মৃতিভ্রম হয়, নতুন কিছু শেখা বা করার ক্ষেত্রে ধীরগতি, দ্বিধা, একাকিত্ব বোধ, মতিভ্রম ইত্যাদি হতে পারে। অনেকে আবার আইসিইউ বা কোভিড হাসপাতালের ভীতিকর স্মৃতিতাড়িত হয়ে উদ্বেগে ভোগেন। স্বজন হারানোর বেদনা বা অর্থনৈতিক চাপে বিষন্নতায় আক্রান্ত হন। বিভিন্ন রকম মানসিক অবসাদ অনেকের মধ্যে দেখা যায়।
এছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে ‘কাওয়াসাকি রোগের’ মতো একটি রোগের লক্ষণ, পুরুষদের ক্ষেত্রে সাময়িক বন্ধ্যাত্ব ও কিছু ক্ষেত্রে মহিলাদের গর্ভধারণজনিত জটিলতা সমস্যা হতে পারে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছেন।
সবশেষ কিছু কথা
কোভিড-১৯ রোগের বিস্তার ও এর ব্যাপকতা জানতে আমাদের আরও গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসাধারণের সচেতনতা। আপনি কোনো সমস্যার অনুভব করলে আপনার চিকিৎসককে জানান। তাকে বলতে ভুলবেন না আপনি কোভিড জয়ী রোগী। সেই সাথে নিজের জন্য গড়ে তুলুন স্বাস্থ্যসম্মত জীবন ব্যবস্থা। ধুমপান পরিহার করুন, নিয়মিত ফুসফুসের হালকা ব্যায়াম করবেন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
এছাড়া সুস্থ ও ইতিবাচক চিন্তার অভ্যাস গড়ে তুলুন। যেভাবে কোভিড জয় করেছেন একইভাবে অবশ্যই পরবর্তী যে কোনো জটিলতা সফলভাবে মোকাবেলা করবেন- এই বিশ্বাস রেখে চলতে হবে। সর্বোপরি মনে রাখবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষত রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ সবসময় রয়েছে আপনাদের পাশে বিশেষায়িত সেবা দান করার জন্য।
যেভাবে দেশে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আমরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করছি, একইভাবে কোভিড পরবর্তী চিকিৎসার মাধ্যমে দেশের চিকিৎসা সেবার মান উন্নত ও মানসম্মত রাখতে দেশবাসির কাছে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।