ভূমধ্যসাগরে ডুবল তরুণের ইতালি যাবার স্বপ্ন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২ ফেব্রুয়ারী,
বুধবার,২০২২ | আপডেট: ১২:৪০ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
ইতালী যেতে ভূমধ্যসাগরে ডুবল সাজ্জাদ আহমেদ (২৪) নামের এক তরুণের রঙ্গীন স্বপ্ন। তার বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভিমখালী ইউনিয়নের ফেকুল মাহমুদপুর গ্রামে। সাজ্জাদের মা রহিমা খাতুন তার ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে পুত্রশোকে বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করছেন। বিলাপের মাঝে হঠাৎ সংজ্ঞা হারান তিনি।
দানা-পানি ছেড়ে পুত্রশোকে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন দুখিনী মা। বার-বার বিলাপ করে বলছেন ‘তোমরা আমার ফুয়ারে আইন্যা দেও (আমার ছেলেকে এনে দাও)। আমার ফুয়া অখন কই আছে?’ এছাড়া আর কোনো কথা বলছেন না তিনি। শুধু বিলাপ করেই কাঁদছেন। স্বজ্জনরা ও প্রতিবেশীরা তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেরাও চোখ মুছে ফিরছেন।
এ দিকে পুত্র হারিয়ে শোক ও কঠিন মানসিক আঘাত নিয়ে পিতা নূরুল আমিন নির্বাক হয়ে গেছেন। সরকারের কাছে তিনি ও তার পরিবার জোর দাবি জানিয়েছেন, মৃত ছেলে সাজ্জাদকে তাদের কাছে শেষবারের মতো ফিরিয়ে দিতে। প্রিয় সন্তানকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানাতে চান তারা।
জানা গেছে, দালালের মাধ্যমে প্রথমে সাজ্জাদকে লিবিয়া পাঠানো হয়। সেখান থেকে স্বপ্নের দেশ ইউরোপের ইতালিতে নৌ-পথে যাবার পথে গত ২৫ জানুয়ারি তীব্র ঠান্ডায় ভূমধ্যসাগরের বুকে নৌকাতেই মারা যান জামালগঞ্জ উপজেলার ভিমখালি ইউনিয়নের ফেকুল মামুদপুর গ্রামের নূরুল আমিনের ছেলে সাজ্জাদ আহমেদ (২৪)।
চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে সাজ্জাদ আহমেদ নূরুল আমিন ও রহিমা খাতুন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। সাজ্জাদ আহমেদের পরিবারের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৩ ডিসেম্বর লালুখালি গ্রামের ফয়জুর রহমানের মাধ্যমে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকায় তাকে লিবিয়া পাঠানো হয়। সেখানে পৌঁছার পর অন্য আরেকজন দালালের মাধ্যমে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার জন্য আরো ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়।
ছেলেকে লিবিয়া হয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য পিতা নূরুল আমিন জমি বিক্রি করে দালালের হাতে আরো ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন। গত ৩ ডিসেম্বর পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ছাড়েন ২৪ বছর বয়সী স্বপ্নবাজ তরুণ সাজ্জাদ আহমেদ।
গত ২২ জানুয়ারি রাতে বাবাকে ফোন করেন সাজ্জাদ। তার কথা অস্পষ্ট। কেঁপে কেঁপে কথা বলছিল ছেলে সাজ্জাদ। অবশ্য বেশি কথা বলতে পারেনি ছেলেটি। ফোন লাইন কেটে যায়। ছেলের ফোনের পরেই বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয় বাবা নূরুল আমিনের।
এরপরই লালুখালি গ্রামের দালাল ফয়জুর রহমানের কাছে ফোন দিয়ে ছেলের বিষয়ে জানতে চান তিনি। পরে ২৬ জানুয়ারি রাতেই তিনি তার ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েন। ছেলের মৃত্যুর পর লিবিয়া থেকে ইতালি নেওয়ার দালাল নিহতের বাবাকে ৩ লাখ টাকা ফিরিয়ে দেন। এখন তার একমাত্র প্রত্যাশা - ছেলের মুখ শেষবারের মতো স্ত্রীকে নিয়ে দেখতে চান। চোখের জলে বিদায় জানাতে চান প্রিয় সন্তনকে।
স্বজনরা জানান, ২৮০ জন লোক নিয়ে লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে সাগর পথে স্পিডবোট ছেড়েছিল। তখন ভূমধ্যসাগরে খুব ঠান্ডা ছিল। ঠান্ডায় জমে গিয়ে নৌকাতেই মারা যান সাজ্জাদ আহমেদসহ বাংলাদেশি ৭ যুবক।
ইতালির কোস্টগার্ডের সদস্যরা তাদেরকে উদ্ধারের পরই বিষয়টি জানাজানি হয়। পরিবারের লোকজনও জানতে পারেন।
সাজ্জাদ আহমেদের পিতা নূরুল আমিন বলেন, দালাল ফয়জুর রহমান ও রফিক মিয়ার কথায় আশ্বস্ত হয়ে প্রথমেই ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকায় ছেলেকে লিবিয়া পাঠাই। পরে লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠাতে আরো ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। পরে শুনেছি ছেলে সাগরে অনেক কষ্টে ঠান্ডায় মারা গেছে। লিবিয়া থেকে ইতালি নেয়ার দালাল ৩ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। আমার ছেলের মতো আর কোনো বাবার যেন বুক খালি না হয়। আমি আমার মৃত ছেলের লাশ চাই, তাকে শেষ দেখা দেখতে চাই অঝোরে কাঁদলেন।
স্থানীয়রা জানান, ইউরোপের স্বপ্ন নিয়েই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল। এখন তার মা-বাবা প্রিয় সন্তানের শেষবারের মতো মুখটি দেখার আশায় বুক বেঁধে আছেন। শোকাহত মা-বাবার শেষ ইচ্ছেটি পূরণ করতে আমরাও সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।
দালাল ফয়জুর রহমানের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস জানায়, অবৈধভাবে নৌকাযোগে লিবিয়া থেকে ইতালির ল্যাম্পে পদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন একদল অভিবাসনপ্রত্যাশী। যাত্রাপথে ঠান্ডায় প্রাণ হারান সাত জন। ওই নৌকায় যাত্রী ছিলেন ২৮৭ জন, তাদের মধ্যে ২৭৩ জনই বাংলাদেশী।
এ ব্যাপারে জামালগঞ্জ থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মীর আব্দুন নাসের বলেন, মর্মান্তিক এই ঘটনাটি আমি বিভিন্নভাবে জেনেছি। গতকাল আমি নিজেই নিহতের পরিবারের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছি। পরিবারের সবাই এখন শোকে কাতর। নিহতের বাবা জানিয়েছেন, ৩ লাখ টাকা তিনি ফেরত পেয়েছেন। দালালের উপর তার কোনো অভিযোগ নেই। লাশ চিহ্নিত হওয়ার পর বাংলাদেশে লাশ আনার জন্য সরকারিভাবে প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি সাজ্জাদের লাশ তার মা-বাবার কাছে বাড়িতে ফেরত আসবে।