avertisements 2

‘ওসি প্রদীপ পা দিয়ে চেপে ধরে সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন’

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৯:৫৯ পিএম, ৮ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ১১:২২ পিএম, ৬ মার্চ, বুধবার,২০২৪

Text

গুলি করার পরও তিনি বেঁচে ছিলেন মেজর (অব:) সিনহা মো. রাশেদ খান। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিকভাবে পা দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।

বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে সিনহাকে বহনকারী পিকআপ হাসপাতালে দেরিতে পৌঁছানোর পেছনেও দায়ী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘সেনাবাহিনী মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকাণ্ডের একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। কমিটি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছে।’

কমিটির কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসপি মাসুদ সিনহা হত্যার সঙ্গে জড়িত। তিনি ঘটনার শুরু থেকে তদন্তের কাজে অসহযোগিতা ও বাধা দিয়ে আসছেন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার পরপরই সিনহার পরিবার এসপি মাসুদকে বদলির দাবি জানায়। সেনাসদরও সুষ্ঠু তদন্তের এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে তাকে বদলি করা দরকার বলে মত পোষণ করে।

মন্ত্রণালয়ের ওই প্রতিবেদনে সেদিনকার ঘটনার বিবরণও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ‘গত ৩১ জুলাই ২০২০ তারিখ আনুমানিক ৯ টা ২৫ মিনিটের সময় টেকনাফ থানার আওতাধীন মেরিন ড্রাইভ এলাকায় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী কর্তৃক গুলিবর্ষণে বিএ-৬৯৩১ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হন।’

প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, ‘মেজর (অব.) সিনহা গত ৩ জুলাই ২০২০ তারিখে ঢাকা থেকে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন ছাত্রছাত্রীসহ ‘জাস্ট গো’ নামে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একটি ট্রাভেল ভিডিও তৈরির নিমিত্তে কক্সবাজার আগমন করেন এবং নীলিমা কটেজ নামক একটি রিসোর্টে অবস্থান করে একমাস যাবত কক্সবাজারস্থ বিভিন্ন স্থানে শুটিং করেন।’

এতে বলাহয়, ‘৩১ জুলাই ২০২০ তারিখে রাত্রিকালীন শুটিং শেষে মেজরসহ (অব.) সঙ্গীয় সাহেজুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে মারিশবুনিয়া পাহাড় থেকে নেমে নিজস্ব প্রাইভেটকার করে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা করেন।’ পথিমধ্যে শামলাপুরের পূর্বে বিজিবি চেকপোস্টে তাদেরকে তল্লাশি করার জন্য থামানো হয় এবং পরিচয় প্রাপ্তির পর ছেড়ে দেয়া হয়। আনুমানিক ৯ টা ২৫ মিনিটের সময় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্ট অতিক্রমের সময় ইন্সপেক্টর লিয়াকত এপিবিএনের ফোর্সসহ মেজর (অব.) সিনহার গাড়ি থামায়। মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থামিয়ে তাদেরকে পরিচয় দিলে এপিবিএন সদস্যরা প্রথমে তাদেরকে যাওয়ার জন্য সংকেত দিলেও ইন্সপেক্টর লিয়াকত তাদের পুনরায় থামায় এবং তাদের দিকে পিস্তল লক্ষ্য করে গাড়ি থেকে নামতে বলে। সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দিকে গমন করে।

মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই ইন্সপেক্টর লিয়াকত খুব কাছ থেকে মেজর (অব.) সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। ঘটনার আনুমানিক ২০-২৫ মিনিট পর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম ও অমানবিকভাবে পা দিয়ে চেপে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া মেজর (অব.) সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করে বলে জানা যায়।’

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ‘ওসি প্রদীপ কুমার দাস ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ মিনিট মেজর (অব.) সিনহার আহত দেহ ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল এবং তিনি তখনও জীবিত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, উক্ত পুলিশ চেকপোস্টটি এপিবিএন কর্তৃক পরিচালিত এবং ঘটনার সময় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ঘটনাস্থলে উপস্থিতি ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা এবং পূর্বপরিকল্পনার ইঙ্গিত বহন করে বলে প্রতীয়মান।

পরবর্তী সময়ে রাত ১০ টার সময় একটি পিকআপ সহকারে মেজর (অব.) সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। আনুমানিক এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পরে পিকআপটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

উল্লেখ্য, স্বাভাবিক সময়ে উক্ত দূরত্ব অতিক্রমে ১ ঘণ্টা সময় লাগলেও অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করে মেজর (অব.) সিনহাকে বহনকারী পিকআপ হাসপাতালে পৌঁছানোর পেছনেও দায়ী ব্যক্তিদের দুরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা ছিল বলে প্রতীয়মান।’

এতে বলা হয়, ‘উক্ত ঘটনার অব্যাবহিত পরবর্তী সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাসদস্যদের পক্ষ হতে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের মাধ্যমে একটি যৌথ তদন্ত আদালত গঠনের নিমিত্তে পত্রালাপ করা হয়। ফলশ্রুতিতে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার সঠিক কারণ নিরূপণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার জনাব মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে (যুগ্ম সচিব)’ আহ্বায়ক করে ৪ সদস্যের একটি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে যৌথ তদন্ত কমিটি মেজর (অব.) সিনহা হত্যা-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। একই সঙ্গে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার কারণ উদ্ঘাটনের নিমিত্তে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত আদালত গঠিত হয়। যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এখানে উল্লেখ্য যে, স্থানীয় সূত্র এবং বিভিন্ন মাধ্যম হতে মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কক্সবাজারের এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ঘটনার তদন্তের শুরু থেকেই অসহযোগিতা ও বাধা প্রদান করে আসছেন বলে জানা যায়।’

এছাড়াও ‘উপরোল্লিখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে নিহত মেজর (অব.) সিনহার বোন কর্তৃক টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকতসহ মোট ৯ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। যার তদন্তভার র‌্যাবের উপর ন্যস্ত করা হয়। র‌্যাব কর্তৃক উক্ত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জন আসামিকে (৩ জন বেসামরিক ও ৬ জন পুলিশ সদস্য) পর্যায়ক্রমে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষে এপিবিএনের তিনজন সদস্য এবং ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। একই সঙ্গে তিন বেসামরিক ব্যক্তিও ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছে বলে জানা যায়।

এখানে উল্লেখ্য, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস কোনো প্রকার জবানবন্দি প্রদান করেনি। সব আসামিরা বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে রয়েছে। বর্তমানে মামলাটি র‌্যাবের অধীনে তদন্তাধীন আছে। পুলিশ কর্তৃক আটককৃত মেজর (অব.) সিনহার সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথ এবং সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা দায়ের করা হয়। উক্ত মামলাগুলোতে সিফাত এবং শিপ্রা বর্তমানে জামিনে আছেন।’

উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় গত ৫ জুলাই তার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি করা হয়।

সিনহার মৃত্যুর পর ঘটনাটিকে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল পুলিশ। পুলিশের পক্ষে নন্দলাল রক্ষিতের মামলাও হয়েছিল তার ভিত্তিতে।


অন্যদিকে সিনহার বোন শারমিন সরাসরি হত্যার অভিযোগ এনে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনকে সিনহা হত্যা মামলায় আসামি করতে আদালতে আবেদনও করেছিলেন নিহত সিনহার বোন। তবে বিচারক তা খারিজ করে দেন। ওই ঘটনার জেরে গত সেপ্টেম্বর মাসে কক্সবাজার থেকে রাজশাহী বদলি করা এসপি মাসুদ হোসেনকে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2