পথশিশুদের জীবন এখন অনিশ্চিত
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৫:৪০ পিএম, ২০ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৫৫ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
স্বপ্নার সরল ভাষ্য, ‘আমরা ভিক্ষা করি না ভাইয়া। রাস্তায় বেলুন বিক্রি করি। কিন্তু গত দুই দিন যে কী হইছে, বুঝি না। রাস্তাঘাটে লোকজন নাই। বেলুন বিক্রি করুম কার ধারে। কিন্তু বাসায় টাকা না নিয়া গেলে মা বকব। তাই আমার ছোট বোন (মিম) মানুষের কাছে হাত পাততে শুরু করছে। কী করমু, টাকা না পাইলে তো না খাইয়া থাকতে হইব।’ স্বপ্না বলে, ‘মানুষের বাসায় কাজ করে মা যে টাকা পায়, তাতে সংসার চলে না। তাই আমরা বেলুন বিক্রি করি। বেলুন বিক্রি করতে করতে উত্তরা চইলা আসি। প্রতিদিনই মাকে কিছু না কিছু দিতে হয়।’
কথা বলতে বলতেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে ছোট্ট মিম। টাওয়ারের সামনে ঘুমানোর জন্য বিছানা পাতে বড় বোন স্বপ্নাও। সঙ্গে সঙ্গেই নিরাপত্তাকর্মী এসে চোখ রাঙায়। বাধ্য হয়ে মিমকে নিয়ে স্বপ্না চলে যায় সড়কের উল্টো পাশে টপটেন ভবনের সামনে। সেখানেও এক নিরাপত্তাকর্মী তাদের উঠিয়ে দেয়। এরপর বোনকে নিয়ে স্বপ্না আশ্রয় নেয় সড়ক বিভাজকের মাঝখানে। সেখানেই বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে তারা।
এই শিশুদের কেউ ফুল বেচে, কেউ বেলুন বেচে চলত এত দিন। লকডাউনে তাদের খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। আশপাশে কোনো গাড়ি থামলেও সাহায্যের আশায় ছুটে যাচ্ছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় রাজধানীর উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে থেকে তোলা
এই শিশুদের কেউ ফুল বেচে, কেউ বেলুন বেচে চলত এত দিন। লকডাউনে তাদের খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। আশপাশে কোনো গাড়ি থামলেও সাহায্যের আশায় ছুটে যাচ্ছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় রাজধানীর উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে থেকে তোলা ছবি: আল-আমিন
তোমরা বাড়ি গেলে না কেন, জানতে চাইলে স্বপ্নার জবাব, ‘কাজ শেষ করতে রাত হইয়া গেছে। মা আইসা নিয়া যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু মা আসে নাই। আর গাড়ি না চলায় আমরাও যাইতে পারছি না। এ কারণে রাস্তায়ই থাকতাছি।’
এখানেই পাওয়া গেল দুই ভাই মারুফ ও ফারুককে। মা নেই। বাবা থেকেও না থাকার মতো। তারা দুজন দাদি সাবিয়া বেগমের সঙ্গে থাকে নগরের ফুলবাড়িয়া এলাকায়। তারা দুজনও কখনো ফুল, কখনোবা বেলুন বিক্রি করে। দিন শেষে যা আয় হয়, তা তুলে দেয় দাদির হাতে। তাতে কোনোরকম টেনেটুনে চলে যায় তাদের সংসার। কিন্তু গত তিন দিনের লকডাউনে তাদের সে আয়ে ভাটা পড়েছে। তাই তারাও সাহায্যের আশায় ঘুরছিল রাস্তায় রাস্তায়। তারা জানায়, তারা প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। এরপর তাদের মা মারা যায়। বাবা বিয়ে করে আলাদা সংসার শুরু করে। এরপর থেকে তারা দুজন থাকে দাদির সঙ্গে। বেলুন বা ফুল বিক্রি করে দৈনিক দুই শ থেকে আড়াই শ টাকা পাওয়া যায়। সেই টাকা তুলে দেয় দাদির হাতে। তাতে কোনোরকম চলে তাদের সংসার। এর মধ্যে কত দিন ধরে বেলুন বিক্রি বন্ধ থাকায় বেকায়দায় পড়েছে তারা।
ফারুক বলে, ‘বেলুন আনি টঙ্গী বাজার থেইকা। কিন্তু এখন বাজার বন্ধ, বেলুন আনা যায় না, তাই বিক্রিও করতে পারি না। এদিকে মানুষের বাসায় দাদির কামও বন্ধ। ঘরে চাউল-ডাউল নাই। সেই জইন্য সকালবেলা এইহানে আয়া বইছি। এর মাঝে কয়েকটা ভাই আইসা দুপুরে খাবার দিয়া গেছে। কিন্তু কেউ গেলবারের মতো চাউল-ডাউল দেয় নাই।’
এমন আরও গল্প শোনা গেল ইয়ামিন, শিপন, রাসেল, মরিয়ম, মুন্নি, মুক্তা ও রাবেয়ার কাছ থেকেও। তাদের কারও বাবা নেই, কারওবা মা। সবাই জীবিকার তাগিদে বা সংসারে হাল ধরতে নেমেছে রাস্তায়। কখনো বেলুন, কখনো ফুল বা খেলনা বিক্রি করে সংসারে দেয় তারা। কিন্তু লকডাউনে তাদের সবার সেই আয়ে ভাটা পড়েছে। আছে নিরাপত্তাঝুঁকি, করোনার ঝুঁকিও। এই সবকিছু উপেক্ষা করেই এরা রাস্তায় থাকছে সাহায্যের আশায়। কোনো গাড়ি বা কাউকে থামতে দেখলে ছুটে যাচ্ছে। খাবার, ত্রাণ বা অর্থ সাহায্যের জন্য কাকুতি–মিনতি করছে।
তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত ১২টা। তারা তখনো জমজম টাওয়ারের সামনে। কে, কোথায় থাকবে বা বাসায় যাবে কি না, জানতে চাইলে এই শিশুরা জানায়, তারা রাস্তাতেই থাকবে। দিন শেষে তাদের কারও হাতে একটি টাকাও নেই। খালি হাতে বাসায় ফেরা যাবে না। আর কেউ কেউ যানবাহন বা ভাড়ার টাকা না থাকায় রাস্তায় ঘুমানোর কথা ভাবছিল।
এর মধ্যে বেশ একটু ভাবগম্ভীর রাসেল বলে, ঘর ভাড়া দুই হাজার টাকা। মার একার আয়ে তা হয় না। তাই প্রতিদিনই মাকে কিছু না কিছু দিতে হয়। কিন্তু কোনো কারণে টাকা দিতে না পারলে মা মন খারাপ করে, চিন্তায় পড়ে যায়। তাই বাড়ি যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না সে।