avertisements 2

করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অসহায় সবাই

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:৩৩ পিএম, ১২ এপ্রিল,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৫৭ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪

Text

করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অসহায় সবাই। রোগী, স্বজন, ডাক্তার, সাধারণ মানুষ সবার মাঝেই বিরাজ করছে অসহায়ত্ব। রোগীর ভিড় হাসপাতালে হাসপাতালে। কিন্তু সিট নেই। এম্বুলেন্সে অপেক্ষা রোগীর। স্বজনদের আকুতি একটি সিটের। কিন্তু সিট সে তো সোনার হরিণ। ধানমণ্ডির বাসিন্দা রোজিনা চৌধুরী (৪৮) করোনা পজেটিভ হয়েছিলেন তিনদিন আগে।

গত শনিবার থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। অক্সিজেনের মাত্রা বিপদসীমায় নেমে আসছিল। প্রয়োজন হয় হাসপাতালে ভর্তির। তাই স্বজনরা বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করে কোথাও ভর্তির ব্যবস্থা করতে পারেননি। পরে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আয়েশা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে একটি সিটের ব্যবস্থা হয়। সেখানে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপোর্ট না থাকায় তার শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউ সাপোর্ট দেয়ার পরামর্শ দেন। তারপর থেকে রোজিনা চৌধুরীর স্বজনরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ বেসরকারি আরো কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেও আইসিইউ ব্যবস্থা করতে পারেননি। গত শনিবার রাত থেকে গতকাল দিনভর আইসিইউ এম্বুলেন্স ভাড়া করে একের পর হাসপাতালে আইসিইউ’র সন্ধান করে ব্যর্থ হন। পরে রোজিনা চৌধুরীর জায়গা হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ বেডে। স্বজনরা জানিয়েছেন, কোথাও মিলছে না আইসিইউ। রোগীর অবস্থাও খারাপ। তাই মুগদা মেডিকেলে ভর্তি করে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সাপোর্ট নিয়ে আইসিইউ সন্ধান করা হবে। শুধু রোজিনা চৌধুরীই না করোনা আক্রান্ত রোগী, স্বজন ও দায়িত্বরত চিকিৎসকরা এমন অসহায় সময় পার করছেন প্রতি মুহূর্তে। রোগী নিয়ে ছুটছেন স্বজনরা। মিলছে না হাসপাতালের শয্যা। চিকিৎসকদের চোখের সামনে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে আইসিইউ দিতে পারছেন না।

মুগদা হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে রোজিনা চৌধুরীর জন্য একটি সিটের ব্যবস্থা হলেও ঢাকার সরকারি সব হাসপাতাল ঘুুরে একটি সিটের ব্যবস্থা করতে পারেননি কুমিল্লার বাসিন্দা করোনা পজেটিভ রোগী রাশেদ হাসানের স্বজনরা। রাশেদের ছেলে রুহুল আমিন বলেন, আমার বাবার কিডনি ও ডায়াবেটিসের সমস্যা ছিল আগে থেকে। ৩-৪ দিন ধরে আবার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। দুইদিন ভালো থাকলেও গত শনিবার থেকে বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। তাই হাসপাতালে ভর্তির জন্য কুমিল্লা থেকে শনিবার মধ্য রাতে ঢাকায় এসেছি। কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে কোনো সিট পাইনি। সব হাসপাতাল থেকে সিট খালি নাই বলে জানিয়ে অপেক্ষা করতে বলা হয়। এ রকম রোগী নিয়ে অপেক্ষা করার সুযোগ না থাকায় আমরা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটেছি। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে এসেছি। জানি না এখন এই হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারবো কিনা। অপেক্ষা করছি যদি কোনো সুযোগ হয়।

করোনার দ্বিতীয় ধাপে দ্রুতই রোগীদের অবস্থা জটিল হচ্ছে। তরুণ থেকে শুরু করে বয়স্কদের শারীরিক অবস্থা নিমিষেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়। রোগীতে ঠাসা হাসপাতালগুলোতে গিয়ে সুবিধা করতে পারছেন না স্বজনরা। তাই রোগী নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে স্বজনদের। সবারই প্রত্যাশা যদি একটা সিট পাওয়া যায়। তাহলে হয়তো প্রিয় মানুষটিকে অন্তত একটু চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে।

সরজমিন গতকাল ঢাকার মুগদা জেনারেল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেছে, ৫-১০ মিনিট পরপর এই দুই হাসপাতালে এম্বুলেন্সে করে রোগীরা আসছেন। তারপর জরুরি বিভাগে গিয়ে স্বজনরা খোঁজ নিচ্ছেন সিট হবে কিনা। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা মোট দুই ঘণ্টা পর্যন্ত মুগদা হাসপাতালে অন্তত অর্ধশতাধিক করোনা পজেটিভ রোগীর দেখা মিলেছে। এসব রোগীদের ৯০ শতাংশ একাধিক হাসপাতাল ঘুরেছেন। কোথাও সিটের ব্যবস্থা করতে না পেরে এখানে এসেছেন। বাকি ১০ শতাংশ রোগীরা আগে থেকেই সিটের ব্যবস্থা করে এখানে আসেন। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন উত্তরার বাসিন্দা মিনারা বেগম। তিনি সরকারি শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। অবস্থার অবনতি হওয়াতে তার আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। পরে তার স্বজনরা মুগদা হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থা করে গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসেন। মিনারা বেগমের এক স্বজন জানান, মুগদা হাসপাতালে চাকরি করেন আমাদের এক আত্মীয়। তার প্রচেষ্টায় একটি আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা হয়েছে।

দুপুর আড়াইটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে গিয়ে দেখা যায় অন্যরকম চিত্র। হাসপাতালের নতুন ভবনের জরুরি বিভাগের সামনে ৪টি এম্বুলেন্সে অপেক্ষা করছেন শ্বাসকষ্টের রোগীরা। সবার মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরানো। চারজন রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল। রোগীদের স্বজনরা জরুরি বিভাগ থেকে টিকিট সংগ্রহ করেন। তারপর টিকিট নিয়ে দায়িত্বরত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা রোগীর স্বজনদের ভেতরে প্রবেশ করতে না দিয়ে সিট খালি না থাকার কথা জানান। নিরাশ হয়ে স্বজনরা রোগী নিয়ে ছুটে যান অন্য গন্তব্যে। ততক্ষণে সেখানে আরো দুটি এম্বুলেন্স রোগী নিয়ে এসে হাজির।

নরসিংদী থেকে আসা রোগী রহমত আলীর (৬৫) মেয়ে সুবর্ণা কলি বলেন, বাবার শারীরিক অনেক সমস্যা রয়েছে। এরমধ্যেই কয়েকদিন আগে জ্বর, কাশি ও শরীরে ব্যথা শুরু হয়। স্থানীয় এক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে প্রাথমিকভাবে কিছু ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল। ওই চিকিৎসক করোনা পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। তারপর নমুনা পরীক্ষা করালে তার করোনা পজেটিভ আসে। গত শনিবার রাত থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়াতে ভোর বেলা নিয়ে যাই নরসিংদী সদর হাসপাতালে। কিন্তু শ্বাসকষ্ট বেশি হওয়াতে তাকে ভর্তি না নিয়ে ঢাকায় আনার পরামর্শ দেয়া হয়। ঢাকায় প্রথমে মুগদা হাসপাতাল, পরে কুর্মিটোলায় নিয়ে যাই। কিন্তু দুই জায়গায় বলা হয় সিট নাই। তারপর এখানে নিয়ে এসেছি। আমার ভাই ভর্তির চেষ্টা করেছে। কিন্তু সিট নাই বলে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, এ রকম পরিস্থিতিতে কোথায় গিয়ে সিট পাবো। ভোর থেকে এখন দুপুর বয়ে যাচ্ছে এখনো ভর্তির ব্যবস্থা হয়নি।

ঢামেকে, তিতাস থেকে আসা আরেক রোগীর স্বজন হালিম জানান, পরিচিতজনদের দিয়ে আগেই বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছি। কোথাও সিট খালি নাই। এখানে নিয়ে এসেছি কারণ বড় হাসপাতাল। কোনোভাবে যদি একটা সিটের ব্যবস্থা হয়। এতদূর থেকে নিয়ে এসেছি। এখন ভর্তি করাতে না পারলে আবার ফিরে যেতে হবে। বেসরকারি দুই একটি হাসপাতালে খোঁজ নিয়েছি। সর্বত্র একই অবস্থা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, গাইনি ও সার্জারি করোনা ইউনিটে কয়েকটি সিট ছাড়া আর কোনো সিট খালি নাই। এসব ওয়ার্ডে শুধুমাত্র সার্জারি ও গাইনির রোগীদের ভর্তি নেয়া হয়। আইসিইউ, এইচডিইউ, কেবিন রোগীতে পূর্ণ।

একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ৭৮ জনের: দেশে করোনায় মৃত্যুতে প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটা একদিনে মৃত্যুতে রেকর্ড। এর আগে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ছিল শনিবার ৭৭ জন। এ নিয়ে দেশে মোট মারা গেছেন ৯ হাজার ৭৩৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৮১৯ জন। এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছেন ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৪ হাজার ২১২ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৫৯০ জন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনার নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

এতে আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ২৯ হাজার ২৯৮টি। অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ২৯ হাজার ৩৭৬টি। এখন পর্যন্ত ৫০ লাখ ২ হাজার ৮৬৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৪ দশমিক ২০ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪২ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ৫৩ জন পুরুষ এবং নারী ২৫ জন। এখন পর্যন্ত পুরুষ ৭ হাজার ২৭৯ জন এবং নারী মৃত্যুবরণ করেছেন ২ হাজার ৪৬০ জন।

বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, মারা যাওয়াদের মধ্যে ৬০ বছরের উপরে ৪৮ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১৬ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ৭ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৬ জন এবং শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে ১ জন।

বিভাগ বিশ্লেষণে দেখা যায়, মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ঢাকা বিভাগেই রয়েছেন ৪৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০ জন, রাজশাহী বিভাগে ৪ জন, খুলনা বিভাগে ৪ জন, রংপুর বিভাগে ১ জন এবং সিলেট বিভাগে ২ জন। ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেছেন ৭৭ জন। একজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।

টিকার নিবন্ধন ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে: দেশে তৃতীয় দিনে টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে নিয়েছেন ২৩ হাজার ৭২ জন। এ পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭১৭ জন। অন্যদিকে সারা দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরুর ৫২তম দিনে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন ২৩ হাজার ৬৫৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় নিয়েছেন ৩ হাজার ৬৩২ জন। এ পর্যন্ত দেশে মোট প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন ৫৬ লাখ ২৭ হাজার ১০৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৪ লাখ ৮৯ হাজার ১২৫ জন এবং নারী ২১ লাখ ৩৭ হাজার ৯৮২ জন। টিকা নেয়ার পর সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে মোট ৯৪৮ জনের। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকা নিতে অনলাইনে মোট নিবন্ধন করেছেন ৭০ লাখ ৩৯ হাজার ৬৭৩ জন।

গত ২৭শে জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে টিকাদান কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে গণটিকাদান শুরু হয় ৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে। আর দ্বিতীয় ডোজ শুরু হয় ৮ই এপ্রিল থেকে। সুত্র: দৈনিক মানবজমিন

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2