জলে ভাসা জীবন ওদের; নৌকায় জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যু!
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০২:২৯ এএম, ৮ জানুয়ারী,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:৩৩ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
আধুনিক সভ্যতায় মানুষ যেখানে উন্নত জীবনযাপন করছে, সেখানে তাদের জন্ম, বিয়ে, সংসার ও মৃত্যু- সবই নৌকায়। যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-ওখানে ওরা। নদী কিংবা সাগরে নৌকায় ভেসে ভেসে মাছ শিকার করে চলে তাদের সংগ্রামী জীবন-সংসার। যে নদীর পানিতে জীবন, সেখানেই আবার মরণ- এটাই তাদের নিয়তি। নিজস্ব কোনো ভূমি না থাকায় মৃত্যুর পর আবার এই মানুষেরই দেহ পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
ব্যতিক্রম জীবনযাপানে অভ্যস্ত এ মানুষগুলো মুসলমান হলেও মানতা সম্প্রদায় নামে পারিচিত। মাছ শিকার করে মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র হলেও দেশের অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামেও এদের কারো কারো ভূমিকা আছে।
কিন্তু সেই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার স্বাদ কতটুকুই বা ভোগ করছে এরা? শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ কোনো মৌলিক চাহিদাই জুটছে না এদের ভাগ্যে। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা,পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান কিংবা বিশুদ্ধ পানির সুবিধা।
স্বাধীনতার প্রায় ৩৭ বছর পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার পেলেও নাগরিক হিসেবে কতটুকুই বা সুবিধা ভোগ করতে পারে এরা? এদের ভোটে যাঁরা জনপ্রতিনিধি, তাঁরাই বা কতটুকু খোঁজ রাখেন এদের।
প্রাকৃতিক ঝড়- ঝাপটা উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে রাত-দিন একাকার করে নদীতে মাছ ধরে কোনোমতে জীবন চলে এদের। সচেতনতা ও সুযোগের অভাবে এদের সন্তানগুলো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। সামান্য অক্ষরজ্ঞানও অর্জন করতে পারে না তারা। বড় হয়ে তাদের বেছে নিতে হয় মা-বাবার মাছ ধরার সেই পেশাকেই। শিক্ষার সুযোগ পেলে এদের মধ্য থেকেও কেউ হয়তো বা আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারত। ভূমিকা রাখতে পারত দেশ ও জাতির উন্নয়নে।
মানতা সম্প্রদায়ের বিয়ে ও তালাকের বিষয়ে রয়েছে চমকপ্রদ তথ্য। এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়! আবার দাম্পত্য কলহের কারণে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে ওই বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় গেলেই তালাক হয়ে যায়। এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় যাওয়ার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সে বধূ নয়, তালাকপ্রাপ্তা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কারো কারো বিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমেও হচ্ছে।
মানতা সম্প্রদায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় দিন দিন এদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাছ শিকারের সময় নৌকায় শিশুসন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে পানিতে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা হলেও বিষয়টি অমানবিকও বটে।
বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ তাদের অন্যতম রীতি। বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় বসবাসকারী ৩০টি মানতা পরিবারের সরদার কাশেম জানান, তিনি এ পর্যন্ত পাঁচটি বিয়ে করেছেন। একাধিক বিয়ে করলে লাভ হয় তাদের। কারণ মাছ শিকারে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি পটু। তার পাঁচ স্ত্রী মাছ ধরে বিক্রীত টাকা সবই তুলে দেন তার হাতে। পাঁচ স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মুলাদী, হিজলা, বানারীপাড়া, শরীয়তপুর, মাদারীপুরের কালকিনি, উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর পানপট্টি, চরমনতাজ, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, পাটুয়া, বদনাতলী, উলানিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোতে এ সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার লোক নৌকায় বসবাস করছে।
অবহেলিত মানতা পরিবারগুলো সব মৌলিক ও নাগরিক সুবিধা পাওয়ার জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার কাছে দাবি জানিয়েছে।