avertisements 2

পদ না থাকলেও রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকে ৭ হাজার ২১৫ জনের পদোন্নতি

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৪ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২৫ | আপডেট: ০৩:৫৭ এএম, ১৫ জানুয়ারী, বুধবার,২০২৫

Text

ছবি : সংগ্রহীত

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। এর মধ্যে ৭ হাজার ২১৫ জনই পদোন্নতি পেয়েছেন সুপার নিউমারারি (পদ ছাড়াই পদায়ন) ভিত্তিতে।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। এর মধ্যে ৭ হাজার ২১৫ জনই পদোন্নতি পেয়েছেন সুপার নিউমারারি (পদ ছাড়াই পদায়ন) ভিত্তিতে। নজিরবিহীন এ পদোন্নতি দেয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোর অর্গানোগ্রাম বা জনবল কাঠামো ভঙ্গ করে। পদ না থাকলেও এত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ইতিহাসে এর আগে কখনই এভাবে গণপদোন্নতির ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যাংকগুলোয় এখন শৃঙ্খলা আরো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে মহাব্যবস্থাপক (জিএম), উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম), সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম), সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও), প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) ও সিনিয়র অফিসার (এসও) পদে। এর মধ্যে কেবল ১ হাজার ৬৭ জনকে এসপিও থেকে এজিএম বানানো হয়েছে। এজিএম হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহী পদের প্রথম ধাপ। বেতন-ভাতা ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি এজিএম হওয়া প্রত্যেক কর্মকর্তা ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা ঋণ পান। ক্রয়কৃত গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে পান ৪২ হাজার টাকা। এছাড়া এজিএমদের জন্য ব্যক্তিগত কক্ষও (রুম) বরাদ্দ থাকে। পদের অতিরিক্ত পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কক্ষ ও চেয়ার-টেবিল দিতেই ব্যাংকগুলো এখন হিমশিম খাচ্ছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় গণপদোন্নতির এ ঘটনা এমন সময় ঘটল যখন এগুলো ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতি পার করছে। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক তথা ৫০ শতাংশই এখন খেলাপি। মূলধন ও সঞ্চিতি (প্রভিশন) ঘাটতিতে হাবুডুবু খাওয়া ব্যাংকগুলোর অস্তিত্বও টিকে আছে কেবল সরকারি ব্যাংক পরিচয়ে। এগুলোর খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকায়। আর রেকর্ডসংখ্যক পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পেছনে এ ব্যাংকগুলোর ব্যয় বাড়বে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।

গণপদোন্নতির প্রথম ঘটনাটি ঘটে রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালীতে। কর্মকর্তাদের চাপের মুখে গত ২৩ ডিসেম্বর ২ হাজার ১৯২ জন কর্মকর্তাকে সুপার নিউমারারির ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর মধ্যে কেবল সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) থেকে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদেই পদোন্নতি পান ৪৩৩ জন। পরের দিন (২৪ ডিসেম্বর) পদোন্নতির দাবিতে পরিচালকদের ঘেরাও করে রাখেন অগ্রণী ব্যাংক কর্মকর্তারা। প্রথমে রাজি না হলেও শেষ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের দাবির মুখে রেকর্ড ৩ হাজার ৭৭ জন কর্মকর্তাকে সুপার নিউমারারি বিবেচনায় পদোন্নতি দেয় অগ্রণী ব্যাংক পর্ষদ। এর মধ্যে ২১৬ জন কর্মকর্তাকে এসপিও থেকে এজিএম পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। প্রিন্সিপাল অফিসার (পিও) থেকে এসপিও করা হয় ৫৮৫ জনকে। আর সিনিয়র অফিসার (এসও) থেকে ৮২৯ জন প্রিন্সিপাল অফিসার পদে পদোন্নতি পান। এছাড়া আরো ১ হাজার ৪৪৭ জনকে পদোন্নতি দেয়া হয় সিনিয়র অফিসার পদে।

সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের পর চলতি মাসে গণপদোন্নতি দিয়েছে রূপালী ও জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে রূপালী ব্যাংক সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দিয়েছে ১ হাজার ৩৬৮ জনকে। এর মধ্যে পদ না থাকা সত্ত্বেও রেকর্ড ৮১ জনকে এজিএম থেকে ডিজিএম পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এজিএম করা হয়েছে ৩৮৫ জনকে। আর ৪১৯ জন এসপিও এবং ৪৮৩ জন পিও হয়েছেন। আর জনতা ব্যাংক সুপার নিউমারারি পদোন্নতি দিয়েছে ৫৭৮ জনকে। সব মিলিয়ে সুপার নিউমারারি ও যোগ্যতার ভিত্তিতে এ চার ব্যাংকে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি পয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদোন্নতি নিয়ে সচিবালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার প্রভাবই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে এসে পড়েছে। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি না পাওয়া সব কর্মকর্তাই নিজেকে বৈষম্যের শিকার বলে দাবি তুলেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়োগ দেয়া চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এক প্রকার জিম্মি করে কর্মকর্তারা গণপদোন্নতি বাগিয়ে নিয়েছেন। সরকারের দুর্বলতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার প্রভাবও এক্ষেত্রে কাজ করেছে বলে মনে করছেন তারা।

যদিও সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি বাগিয়ে নেয়া অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই গত ১৫ বছর নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। কেউ কেউ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী তথা অলিগার্কদের লুণ্ঠনের সহযোগীও ছিলেন। চেয়ারম্যান, পরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহীর আশীর্বাদ পেতে ব্যাংকিংয়ের রীতিনীতি না মেনেই তারা বেনামি ঋণের নথিপত্র তৈরি করেছেন।

গণপদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় এখন যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন তারা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির নেয়া পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পেয়েছেন। কিছু কর্মকর্তা যোগ্যতা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী কোনো পদে ৩০টি আসন ফাঁকা থাকে, সেখানে ৮০০ কর্মকর্তা প্রতিযোগিতা করছেন। এভাবে অনেক মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতির বাইরে থেকে যাচ্ছিলেন। এ কারণে আমরা সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে দুই হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছি। এদের মধ্যে অনেকেই ৬-৯ বছর একই পদে আটকে ছিলেন।’

মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘদিন একই পদে আটকে থাকলে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা চলে আসে। কাজ করতে নিরুৎসাহিত হন। আশা করছি, পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা নিজেদের তৎপরতা বাড়াবেন। ব্যাংকের উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের মোট জনবল ছিল ২ লাখ ৮ হাজার। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকে ৪৯ হাজার ১৮৩ জন কর্মরত ছিলেন। আর সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত তিন ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন ১৩ হাজার ২০৪ জন। এছাড়া বেসরকারি ও বিদেশী ব্যাংকগুলোয় ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৭৯ জন কর্মরত রয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য আমলে নিলে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক তথা সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের প্রতি চারজনের একজন গত ২০ দিনে পদোন্নতি পেয়েছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংকে গণপদোন্নতির ধাক্কা অন্য ব্যাংকগুলোয়ও লেগেছে। বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এখন সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতির দাবি তুলেছেন। দাবি আদায়ে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা পরিচালনা পর্ষদকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। যদিও ২০০৯ সালের পরের তিন বছরে লুণ্ঠনের শিকার হওয়া ব্যাংকটি এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে। গত ১১ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচানোর জন্য সরকার বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে। বিপুল অংকের এ অর্থ পেয়েও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেসিক ব্যাংক। উল্টো ব্যাংকটি এখনো প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬৫ শতাংশ এখন খেলাপি, যার পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা।

গণপদোন্নতির দাবি উঠছে সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয়ও। সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দিতে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা সভা-সমাবেশ করছেন। কর্মকর্তাদের দাবির বিষয়টি জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে ব্যাংকগুলোর পর্ষদ। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কেবল কৃষি ব্যাংকে ১ হাজার ৪০০ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। এর পরও সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দিতে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ বাড়ছে।

অগ্রণী ব্যাংকে গণপদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের ইতিহাসে কেবল ২০১৫ সালে অল্প কিছু কর্মকর্তাকে সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল। এর আগে কিংবা পরে কখনো এ ধরনের পদোন্নতি দেয়া হয়েছে বলে আমি শুনিনি। পদোন্নতি বেশি হওয়ায় আমরা এখন উপজেলা পর্যায়ের শাখাগুলোর ব্যবস্থাপক পদে এজিএমদের দিতে পারব। গাড়ি ঋণসহ অন্যান্য সুবিধাও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া হবে।’

এদিকে গণপদোন্নতির মধ্যেও অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে রূপালী ব্যাংকে। ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, মেধা ও যোগ্যতার নিরিখে রূপালী ব্যাংকে ৯ জন ডিজিএম, ৫৬ জন এজিএম, ১৩১ জন এসপিও ও ২৭৩ জন পিও পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এসব পদোন্নতির ক্ষেত্রে যোগ্যদের ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেয়া হয়। অযোগ্য অনেক কর্মকর্তা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়েছেন। এক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের মতো ঘটনাও ঘটেছে। এ লেনদেনের সঙ্গে ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত। এ নিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হলে সবাইকে ঢালাওভাবে সুপার নিউমারারি ভিত্তিতে পদোন্নতি দিয়ে দেয়া হয়েছে।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘এমনিতেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। এ পরিস্থিতিতে গণপদোন্নতি দিয়ে ব্যাংকগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এখন মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা নিজেদের কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলবেন। আর অযোগ্যরা একই কাতারে উঠে আসায় ব্যাংকের শৃঙ্খলাও বিনষ্ট হবে।’
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2