পুতুলখেলার বয়সেই ‘মা’
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ অক্টোবর,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০২:৫৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
বছর দু’-এক আগেও নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন ফারজানা আক্তার (১৫)। ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল তার। তবে, বাবা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় পড়ালেখা আর এগোয়নি। বরং ফারজানার পরিবার বোঝা কমিয়েছে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হয়েছে। এরপর বছরখানেক পরেই ফারজানা মা হলো। তার মেয়ে মরিয়মের বয়স এখন পাঁচ মাস। ফারজানার কোলে মরিয়মকে দেখে মনে হবে, এক শিশুর কোলে আরেক শিশু, পুতুলের কোলে আরেক পুতুল। পুতুলখেলার বয়সেই মা হয়েছেন ফারজানা! এমন পরিণতির কারণ—অভাব-দরিদ্রতা, অতঃপর বাল্যবিয়ে। দেশে বাল্যবিয়ে কিছুটা কমলেও, প্রান্তিক উপকূলীয় এলাকায় আজও এমন চিত্র অহরহ দেখা যায়।
ফারজানার জন্মনিবন্ধন নেই। ভোটার হওয়ার বয়স হয়নি। তাই, জাতীয় পরিচয়পত্রও নেই। তার নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই। বাবা-স্বামী-শ্বশুরবাড়ির পরিচয়ই তার পরিচয়। অবশ্য ‘মা’ হওয়ায় পর তার ডাকনামটা বদলেছে। তার নতুন নাম, ‘মরিয়মের মা’। বরগুনা সদরের পোটকাখালী আশ্রয়ণে ফারজানার বাবার বাড়ি। এখানেই তিনি জন্মেছেন, হেসে-খেলে শৈশব কাটিয়েছেন। অতঃপর লাল সিল্ক শাড়িতে বউ সেজে বাবার ঘর ছেড়েছেন। চলে গেছেন স্বামীর ঘরে। তার বাবা ফোরকান জেলে, মা চম্পা বেগম গৃহিণী, স্বামী মাসুম মিয়া অটোরিকশার চালক। বর্তমানে এই শিশুবধূর স্থায়ী ঠিকানা বরগুনা সদরের বদরখালির শ্বশুরালয়।
বাবার বাড়ি, ঘরের পাশের খাকদোন নদী ঘিরে ফারজানার হাজারো স্মৃতি। বিয়ের পর খুব কমই যাওয়া হয়েছে সেই স্মৃতির কাছে। কারণ, কিশোরী ফারজানা যে এখন মা-বউ। শ্বশুরবাড়ি, ঘর-সংসার, গৃহস্থালির নানা কাজের ভার তার কাঁধে। মরিয়মের জন্মের পর এ বছরের আগস্টের শুরুতে বাবার বাড়ি বেড়াতে এলেন ফারজানা। মেয়েকে কোলে নিয়ে স্মৃতিময় সেই নদীর পাড়ে হাঁটছিলেন। ছোট্ট মরিয়মকে দেখাচ্ছিলেন, কোন ঘরে ওর মা জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে, কোন উঠোনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হয়েছিল। অবশ্য অবুঝ মেয়েকে বলা ফারজানার কথাগুলো যে ‘জীবনপোড়া জবানবন্দি’। পোড়া স্মৃতি মনে করে ফারজানা জানান, বড় ভাই ইসমাইল টাকার অভাবে পঞ্চম শ্রেণির পর আর পড়ালেখা করতে পারেননি। ছোট ভাই ইউসুফের বয়স মাত্র তিন বছর। তার পড়ালেখা কতটা হবে, তাও বলা যাচ্ছে না। শুধু অভাবের কারণে নিজের শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হলো না। বিয়ের একমাত্র কারণও ছিল ‘দরিদ্রতা’।
এমন উদাহরণ আরও আছে। ফারজানার বান্ধবী সুমি। বয়স কেবল ১৪। সংসারজীবনের খুনসুটি বোঝার সময়ই আসেনি তার। তবু এখন শ্বশুরালয়ের সংসার-চাষাবাদ-গবাদিপশুসহ সবকিছু সামলাতে হচ্ছে। সেখানে যেতে হয়েছে জীবনের প্রয়োজনে। বাবার ঘরের অভাব আর সমাজে কুপ্রথার প্রভাব সুমিকে শিক্ষিত হতে দেয়নি। সুমির বাবা আশ্রাব আলি (৫৫) রিকশাচালক। সুমি ছাড়াও তার আরও দুই মেয়ে আছে। তাদেরও পাত্রস্থ করার চিন্তা তাড়া করে আশ্রাবকে।
শিশুবধূ সুমির মা সুফিয়া বেগমের কাছে প্রশ্ন ছিল, এত কম বয়সী মেয়ের বিয়ে দিলেন কেন? জবাব এল, ‘ডাঙর (বড়) মাইয়া ঘরে রাইখা লাভ কী? এতে বিপদ বাড়ে। তাছাড়া, ঘরে তিনবেলা ভাতের জোগান দেওয়াই কষ্টের। মাইয়া বিয়া দিতে পারলে কিছু খোরাকি (খাবারের খরচ) তো কমে।
তিনি বলেন, ধার-কর্জ করে মেয়েটার বিয়ে দিছি। প্রায় ৪০ হাজার টাকা এখনো দেনা আছি। ধরেন, আরও ১০ বছর পর মাইয়ার বিয়া দিলে তখনও তো খরচ হইত, আরও বেশি খরচ লাগত। বিয়া না দিলে অহেতুক ১০টা বছর মাইয়ার পেছনে খরচ লাগত।
রাষ্ট্রীয় এত প্রচেষ্টার পরও নানা কারণে আজও প্রচলিত বাল্যবিয়ে। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে এই কুপ্রথার ইতি হয়নি এখনও। সরকারের কড়া নজরদারির কারণে বর্তমানে বাল্যবিবাহ হচ্ছে খুবই ঘরোয়া আয়োজনে, ঢাকঢোল না পিটিয়ে, চুপিসারে। এখন বাল্যবিয়ে এমনভাবে হয়, যাতে পাড়া-পড়শিও টের না পায়।
বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, খুলনাসহ উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রান্তিক গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ছয় থেকে আট সদস্যের পরিবারে কর্মক্ষম মানুষ মাত্র দুই-একজন। গ্রামে কর্মপরিসর স্বল্প, আয়ের সুযোগও অল্প। পরিবারের নারী সদস্যদের কাজের সঠিক পারিশ্রমিক নেই উপকূলে। ফলে, পরিবারে আসে দরিদ্রতা। এর খেসারত দিতে হয় কোমলমতি শিশুদের। বেশিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কন্যাশিশুরা।
বাল্যবিয়ের কারণে প্রান্তিক উপকূলের লাখ লাখ মেয়ে শৈশব হারাচ্ছে। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে বয়সের মেয়েটির স্কুলে থাকার কথা, সেই বয়সে সে সন্তান-সংসার সামলাচ্ছে। সংসারের কাজের ভারে কিশোরীদের শরীর ভেঙে পড়ছে। শরীরে বাসা বাঁধছে নানা রোগ। অল্প বয়সে আসা সন্তানও বেড়ে উঠছে অপুষ্টি নিয়ে।
একইভাবে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের ছেলেদেরও বর সাজতে হচ্ছে ১৬-১৮ বছর বয়সে। বিয়ের আগে ছেলের পরিবারের সঙ্গে দফারফা হয় মেয়ের বাবার। ছেলের পরিবার রাজি হলেই ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা যৌতুক পেলে সম্পন্ন হচ্ছে বিয়ে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় ৬-৭ হাজার খরচ হলে বাকিটা থাকে ছেলের হাতে, পুঁজি হিসেবে।
অপুষ্টি আর অশিক্ষার পাশাপাশি আরও নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে শিশুবিয়ের ফলে। বাল্যবিয়ের শিকার পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ, শ্বশুরবাড়ির অন্যদের সঙ্গে মনোমালিন্য, আর্থিক টানাপোড়নসহ পারিবারিক সমস্যা লেগেই থাকছে। বয়স-মেধার পরিপক্বতার আগেই সংসার শুরুর কারণে এসব হচ্ছে। দুরন্তপনার রেশ কাটতে না কাটতেই কাঁধে সংসারের বোঝা উঠলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। আবার স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য বেশি হলেও সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে চিন্তাধারায় ও পরিবার পরিকল্পনায়। সংসার ভাঙার ঘটনাও অহরহ।
একসময় প্রান্তিক চর অঞ্চলে ঘরে ঘরে বাল্যবিয়ের প্রচলন ছিল। আইন-কানুনও প্রান্তিক জনপদে ছিল অনুপস্থিত। এর পর বিয়েতে ছেলে ও মেয়ের বয়স প্রমাণের কাগজপত্র আবশ্যক করা হলে বাল্যবিয়ে কমে আসে। তাছাড়া ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালানোর ফলে অভিভাবকরাও কিছুটা সচেতন হয়েছিল। তবে, করোনা মহামারির পর বাল্যবিয়ে আবার বেড়েছে। দরিদ্রতার ধাক্কায় অভিভাবকদের সচেতনতাও হারিয়ে গেছে। করোনা মহামারির পাশাপাশি বিশ্বময় সংঘাত, ক্রমবর্ধমান সংকট, জলবায়ু বিপর্যয়, আয়-রোজগারে ধাক্কা এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়াও বাল্যবিয়ে বাড়ার অন্যতম কারণ।
উপকূলীয় অঞ্চলের বাল্যবিয়ে প্রসঙ্গে কথা হলে বরগুনা পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, আমাদের সমাজে বাল্যবিয়ের সমস্যা তথা অভিশাপ আজকের নয়। বাল্যবিয়ের সমস্যা সারা দেশে থাকলেও উপকূলীয় চরাঞ্চলে এর প্রবণতা বেশি। এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমরা মনে করি, আরো অনেক বলিদান সম্পন্ন হওয়ার আগেই দ্রুত প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
এ বিষয়ে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জাগোনারীর প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি বলেন, সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর নানা কর্মসূচি চলমান থাকার পরেও বাল্যবিবাহ অব্যাহত আছে। বেশিরভাগ বিয়ে গোপনে হচ্ছে বলে এর সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এতে প্রসূতির মৃত্যুর হার ও অপুষ্টিজনিত সমস্যা প্রকট হচ্ছে। জোরদার সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করতে পারলে সমাজ থেকে বাল্যবিবাহ নিরোধ সম্ভব।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের প্রচলন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি, যা বিশ্বের মধ্যে অষ্টম সর্বোচ্চ। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনিসেফ’ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ তরুণীর বিয়ে হয় তাদের শৈশবে। উপকূলের জনপদে বাল্যবিয়ে একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রান্তিক চর-দ্বীপ-গ্রামে শিশুদের সংকট যেন অফুরন্ত। নিজের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে জানা নেই এসব শিশুর। পরিবারের অন্যদের কাছেও ‘শিশু অধিকার’ শব্দদ্বয় হাস্যকর। আর্থিক টানাপোড়নের মধ্যে কিসের এত অধিকার? ওদের জীবনের বাস্তবতা, ‘বেঁচে থাকতে সংসার দরকার, পড়ালেখা নয়’।