সাংবাদিক হত্যা: বাবুর ‘আলাদিনের চেরাগ’ সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি পান্না
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ জুন,সোমবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:২৩ এএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ছবি: সংগৃহীত
সাংবাদিক নাদিম হত্যা মামলার প্রধান আসামি মাহমুদুল আলম বাবু ছিলেন গ্রামের খুদে মুদি দোকানি। স্কুল শিক্ষক পিতার ছেলে বাবুর জীবনে ছিল না কোনো চাকচিক্য।
কিন্তু হঠাৎ করেই পেয়ে যান ‘আলাদিনের চেরাগ’। নিকটাত্মীয় (চাচাত ভাই) বড় ভাই মোখলেছুর রহমান পান্না পুলিশের ডিআইজি হওয়ার পর বদলে যেতে থাকে চেয়ারম্যান বাবুর জীবনযাত্রা। ডিআইজি পান্না পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত আইজিপি হলে বাবুর প্রভাব আরও বাড়তে থাকে। খবর বাংলানিউজের
এক সময় জাতীয় পার্টি, তারপর যুবদল করা বাবু হঠাৎ খোলস পাল্টে ২০১২ সালে নাম লেখান আওয়ামী লীগে। চাচাত ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যানের পদ বাগিয়ে নেন।
তারপর থেকে সাধুরপাড়ায় বাবুর কথাই যেন আইন ছিল। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ তার অঙ্গুলি হেলনে চলত। সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আর চেয়ারম্যানের পদ ব্যবহার করে বাবু নামে-বেনামে শত কোটি টাকার মালিক বনে যান।
সবই ভালো চলছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে গত ১৫ জুন জামালপুরের বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যার পর।
১৪ জুন রাতে নাদিম হামলার শিকার হওয়ার পরও এলাকায় ছিলেন চেয়ারম্যান বাবু। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে। নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু ‘বিশেষ জায়গায়’ বিলিয়েছিলেন টাকাও।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। নাদিম হত্যাকাণ্ডের পর ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে বাংলানিউজসহ দেশের অন্যান্য গণমাধ্যম। এরপর বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। একইসঙ্গে ক্ষিপ্ত এলাকাবাসীও মুখ খুলতে শুরু করে।
গত তিন দিন সরেজমিনে ঘুরে সাধুরপাড়া, ধাতুয়াকান্দা, আইরমারী, কামালের বার্ত্তী, খানপাড়া, মোল্লাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে মিলেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, চেয়ারম্যান বাবু নিজের বাড়ির পাশে প্রতিষ্ঠিত পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের ব্যবহার করতেন ব্যক্তিগত কাজে। নিজের মতের বাইরে কেউ ‘না’ বলবে, তা শুনতে রাজি ছিলেন না তিনি। কেউ মতের বাইরে গেলেই নেমে আসত নির্যাতনের খড়্গ।
বাবু নিজের বাসবভবনের তিনতলায় তৈরি করেন টর্চার সেল। সেই সেলে নিয়মিত মদ, জুয়ার আড্ডা বসত। বিরোধীপক্ষ এবং চাঁদা ও দখলবাজিতে বাধাদানকারীদের টর্চার সেলে চলত নির্যাতন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে, আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাবু বিভিন্ন সময়ে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে এবং পরে ছাড়িয়ে দিয়েও টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।
বাবুর এই ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি এলাকায় অনুপস্থিত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীও। ওই শিক্ষার্থী মাহমুদুল আলম বাবুর ভয়ে এলাকায় আসেন না।
তাদের অভিযোগ, থানা পুলিশকে দিয়ে ধরপাকড় বাণিজ্য ছিল বাবুর আয়ের অন্যতম উৎস। স্থানীয় বিচার-সালিশে তার কথাই ছিল শেষ কথা। তাতেও চলত বাণিজ্য।
চেয়ারম্যান বাবু নিয়ন্ত্রণ করতেন বিশাল বালু সিন্ডিকেট। তার দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও কোনঠাসা হয়ে পড়েন। একের পর এক জমি কিনে অঢেল সম্পত্তির মালিক হতে থাকেন বাবু।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চেয়ারম্যান হওয়ার পর উপজেলার ব্র্যাক রোডে দুই জায়গায় জমি কেনেন মাহমুদুল আলম বাবু। এর একটিতে বাড়ি করে বসবাস করতেন তিনি। ঘরের শোভাবর্ধন করেন প্রায় কোটি টাকার ফার্নিচার দিয়ে। এ ছাড়া উপজেলার বাগানবাড়ির নামাপাড়া এলাকায় ৪০ লাখ টাকা দিয়ে ১০ শতাংশ জমিও কেনেন তিনি।
আরও জানা যায়, চেয়ারম্যান হওয়ার পর বাবু ফসলি জমি কেনেন ২৬ বিঘা। গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায় ১১ শতাংশ জমির ওপর ঘর রয়েছে তার। কামালের বার্ত্তী এলাকায় অনেক জমি কেনেন তিনি। সেখানে তোলেন ওই এলাকার একমাত্র তিনতলা বাড়ি। করেছেন অনেকগুলো মার্কেট।
জমি কেনার পর সাংবাদিক নাদিম হত্যার এই প্রধান আসামির চোখ যায় দখলবাজিতে। জায়গা-জমি, গাছগাছালি কিছুই তার দখল থেকে রেহাই পায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দ্বিতীয় মেয়াদে চেয়ারম্যান হওয়ার পরই তার নজর পড়ে সাধুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষী একটি কাঁঠাল গাছের ওপর। মূলত একটি বিলাসী পালঙ্ক তৈরির খায়েশ থেকেই গাছটি কেটে নেন তিনি। বর্তমানে এটিও বকশীগঞ্জে আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে। খাটটি তৈরিতে শুধু মজুরি খরচই পড়ে আড়াই লাখ টাকা। এ কথা তিনি নিজেই প্রচার করতেন।
কামালের বার্ত্তী কেবি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের একাংশ দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন বাবু চেয়ারম্যান। সরেজমিনে এসবের পাশাপাশি অভিযোগ পাওয়া গেছে আরও জমি দখলের। একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মাস্টারের ৩৩ শতাংশ জমি দখল করেন বাবু।
গ্রামের সাজু নামে এক যুবক জানান, তার শুধু ভিটেমাটিটুকুই আছে। সেটির ওপর নজর পড়ে বাবু চেয়ারম্যানের। দখল নিতে হুমকি-ধমকি ও নির্যাতন করে আসছিলেন। আইরমারী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আজমল হকের জমি দখল করে অনুগত একজনকে বাড়ি করে দিয়েছেন।
বাবু গ্রেপ্তারের পর সাধুরপাড়ায় স্বস্তি
শনিবার (১৭ জুন) সকালে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু গ্রেপ্তারের পর এলাকার মানুষ দীর্ঘদিনের ভয় কাটিয়ে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। এই প্রতিবেদকের কাছে তারা তুলে ধরেন তাদের কার্যত জিম্মিদশার কথা।
সম্রাট নামে এলাকার প্রতিবন্ধী এক যুবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আজ সাধুরপাড়ার স্বাধীনতা দিবস। বাবুর টর্চার সেল নির্যাতনের শিকার কামালের বার্ত্তী গ্রামের শয্যাশায়ী হুমায়ুন কবীর কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার ওপর চালানো নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেন।
তিনি বলেন, বাবু চেয়ারম্যানের কারণেই আমি আজ স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী। বাজারে তার বাড়ির তিনতলায় একটি টর্চার সেল রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন লোকজনকে ধরে নিয়ে যেতে। নির্যাতনের পর ১০-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিত। এ ছাড়া ওই টর্চার সেলে নিয়মিত মাদকের আসর বসত।
সাবেক এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি আরও বলেন, বাবুর বাড়ির পাশে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা তার নানা অপকর্মে সহযোগিতা করতেন।
বাবু চেয়ারম্যানের ভয়ে প্রশাসন নীরব। মাঝে মাঝে জরিমানা করলেও থেমে নেই তার অবৈধ বালু ব্যবসা। সম্প্রতি বালু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আবদুল গণি মারধরের শিকার হন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর এই অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনায় আছে বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী। সাংবাদিক হত্যার মিশনে অংশ নেওয়া রেজাউল করিম, মনির ড্রেজারের মালিক মনির, বাবুর ছেলে রিফাত, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক রাকিব উল্লাহ, ধাতুয়াকান্দার বিল্লাল, বালুগাঁওয়ের ছমাদ, শাহরিয়ার সাঈদসহ অনেক সদস্য রয়েছে এই বাহিনীতে।
সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আক্কাছ আলী বাংলানিউজকে বলেন, বাবুর কারণে গত ১০ বছর ধরে এই ইউনিয়নের মানুষ জিম্মি ছিল। সবই সাংবাদিক নাদিম সাহসিকতার সঙ্গে সংবাদে তুলে ধরত, সেজন্যই তাকে জীবন দিতে হলো। এই ইউনিয়নসহ অত্র অঞ্চলের মানুষ তার ভয়ে চুপ ছিল, আমিও তার ভয়ে যেতে পারিনি। সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি পান্নাকে ব্যবহার করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করেনি বাবু।
সাধুরপাড়া ইউনিয়ন নারী সদস্য ও বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকারী সদস্য আমেনা পারভীন বলেন, সাধুরপাড়া ইউনিয়নের আইড়মারি ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম। আমাকে কমিটি থেকে জোর করে বাদ দেয়। আমি সংরক্ষিত সদস্য হওয়ার পরও পরিষদে যেতে পারি না। প্যানেল চেয়ারম্যান করে গাজী আমর আলীকে। দুজনকে প্যানেল চেয়ারম্যান করার কথা থাকলেও করে একজনকে, যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা আমার সঙ্গে থাকার পরও আমাকে বাদ দিতে পারে।
সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি পান্নার ভাই হওয়ায় বাবুর অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেত না বলেও মন্তব্য করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এ নেত্রী।
যা বলছেন জামালপুরের পুলিশ সুপার
সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডে ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু প্ল্যানমেকার ও বাস্তবায়নকারী বলে মন্তব্য করেছেন জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ।
গত শুক্রবার একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।
চেয়ারম্যান বাবুর আত্মীয় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা- পরিবারের এমন অভিযোগের বিষয়ে এসপি নাছির বলেন, প্রথম থেকে বাবুর নাম আমি বলেছি, তিনি প্ল্যানমেকার। প্রত্যেকটা জায়গায় বলেছি। আরও মাস্টারমাইন্ড থাকতে পারে, তারাও বের হয়ে আসবে।
চেয়ারম্যান বাবুর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যা বললেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি পান্না
চেয়ারম্যান বাবু আপনার ক্ষমতা ব্যবহার করে এলাকায় অত্যাচার চালিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান পান্না বলেন, ঘটনাচক্রে আমি তার ভাই (চাচাতো ভাই)। এটা কি আমার জন্যে এখন কাল হয়ে দাঁড়াল? গত ৩-৪ বছর ধরে আমি ৪-৫ বার শুধু এলাকায় গিয়েছে। ওর (বাবু চেয়ারম্যান) সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু আপনি (পান্না) গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পান্নার পক্ষে নির্বাচনী সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন এ ঘটনা সত্যি কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমি একদিনের জন্যে শুধু গিয়েছিলাম। নিজের আত্মীয় হলে সবাই তো পক্ষে থাকে। অন্যরা ছিল, আমিও ছিলাম।