হিন্দু না মুসলিম বিরোধ নিষ্পত্তি
সেই নিহত যুবকের ঠাঁই হলো কবরস্থানে, দাফন সম্পন্ন
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৫ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:২৪ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
পটিয়া-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মনসা বাদামতল এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়া ২৯ বছর বয়সী যুবককে (রতন দাশ) মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
সোমবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি শেষে পটিয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক বিশ্বেশ্বর সিংহ নিহত যুবকের লাশটি দাফনের নির্দেশ দেন। তার ধর্মীয় শিক্ষক মাওলানা ক্বারি মোহাম্মদ আকরাম হোসাইনের জিম্মায় মুসলিম রীতিনীতি অনুযায়ী লাশটি দাফনের নির্দেশ দেন আদালত।
যুবকটির ধর্মীয় শিক্ষক ক্বারী আকরাম হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, আমার ছাত্র আহমাদের লাশটি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘর থেকে বুঝে নেব। পটিয়া আদালতের সকল ডকুমেন্ট আমাদের সঙ্গে আছে।
সোমবার রাত ১০টার সময় চট্টগ্রামের পুরাতন রেল স্টেশন চত্বরে নামাজে জানাজা শেষে নগরীর স্টেশন রোড এলাকার চৈতান্যগলি (২২ মহল্লা) কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে। জানাজা পড়িয়েছেন হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিমের প্রতিনিধি হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর মুহাম্মদ ইদ্রিস।
এদিকে সোমবারের রায়ের পর যুবকের মা সন্ধ্যা রানী দাশ একুশে পত্রিকাকে বলেছেন, এ রায়ের বিপক্ষে তিনি উচ্চ আদালতে যেতে চান।
এর আগে, গত ৩০ জানুয়ারি পটিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মার্চের ১৩ তারিখের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সিনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট বিচারক বিশ্বেশ্বর সিংহ। কিন্তু গত ১৩ মার্চ আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি হাইওয়ে থানা পুলিশ। সেদিন তারা আবারো অধিকতর তদন্তের জন্য সময়ের আবেদন করে আদালতে একটি চিঠি দিয়েছেন। পটিয়া হাইওয়ে পুলিশের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গত ২০ এপ্রিল পরবর্তী শুনানির এ নির্দেশ দেন।
গত ২৯ জানুয়ারি দুপুর ২টার দিকে পটিয়া উপজেলার মনসা বাদামতল এলাকায় তেলবাহী লরির চাপায় পিষ্ট হয়ে মোটরসাইকেল আরোহী ওই যুবকের মৃত্যু হয়।
এদিকে, নিহত যুবকের মা সন্ধ্যা রানী দাশ শুরু থেকেই দাবি করে আসছিলেন রতন দাশ হিন্দু ছিলেন। তাই হিন্দু ধর্মের নিয়ম মেনে শেষকৃত্য চিতায় সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু তার সহপাঠীদের দাবি ছিল, তিনি ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর চট্রগ্রামের লালখান বাজার এলাকার একটি মাদরাসায় মওলানা হারুন এজাহারের কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এরপর থেকে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন ও ইসলাম ধর্মের সব নিয়মকানুন মেনে চলতেন। তাই তারা মুসলিম হিসেবে তার লাশ দাফন করতে আগ্রহী। এজন্য তারা সব ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে হাইওয়ে থানার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছি আদালত সব ডকুমেন্টস দেখা বিচার-বিশ্লেষণ করে রায়টি দিয়েছেন তাকে মুসলিম রীতিমতো দাফন কাফন সম্পন্ন করতে জানিয়েছেন হাফেজ ক্বারী আকরাম হোসাইন।
জানা যায়, নিহত যুবক তার মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় মুসলিম হওয়ার পরও তার মাকে নিয়ে নগরীর একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। করতেন আগ্রাবাদ এলাকায় একটি মোবাইল এক্সোসরিস প্রতিষ্ঠানে চাকরিও। আর তার মৃত্যুর পরে এখানেই বাধে বিপত্তি। তার মৃত্যুর প্রায় তিন মাসে ধরে আদালতের রায়ের অপেক্ষায় নিহত যুবকের পরিবার ও সহপাঠীরা।
এদিকে হলফনামা সূত্রে জানা গেছে, নিহত ওই যুবকের নাম রতন দাশ (২৯)। বাড়ি মিরসরাই উপজেলার পূর্ব মায়ানী গ্রামে। তার বাবার নাম মনোরঞ্জন দাশ ও মাতার নাম সন্ধ্যা রানী দাশ। নিহত যুবক দুই বছর আগে মুসলিম হিসেবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নাম পরিবর্তন করে আহমাদ নাম হয়েছেন। যার নোটারী নম্বর-১১০৫৪৪। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার বেশ কিছু ছবিও রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে পরিবার ও তার সহপাঠীদের মধ্যে বিপত্তি ঘটলে উভয়পক্ষ আর হাইওয়ে পুলিশ আদালতের দ্বারস্থ হন।
নিহত যুবকের সহপাঠী শফিউল বাশার জুয়েল কালের কণ্ঠকে বলেন, সে মনে প্রাণে ইসলাম ধর্ম মেনে মুসলিম হয়েছে। আমরা সহপাঠীরা তার মৃত্যুর পর সে যে মুসলিম হয়েছে তার সব ধরনের কাগজপত্র সংগ্রহ করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছি। সোমবার বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালতে নির্দেশ দিয়েছেন তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে মুসলিম ধর্মীয় মোতাবেক দাফন করতে। আমরা আমাদের বন্ধুকে কবরস্থ করতে পেরে শুকরিয়া আদায় করছি। রাত ১০টার সময় চট্টগ্রামের পুরাতন রেল স্টেশন চত্বরে নামাজে জানাজা শেষে নগরীর স্টেশন রোড এলাকায় চৈতন্যগলি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলাটির দায়িত্বভার হাতে নিয়েছি আমি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। এরপর যেখানে যেখানে যাওয়া লাগছে সেখানে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি হিন্দু ও মুসলিম দুই পক্ষই লাশটি নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। পরবর্তীতে আমি সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য আরো সময়ের প্রয়োজন মনে করে ১৩ মার্চ আদালতে সময়ের আবেদন করেছি। আদালত আমাদের আবেদনটি মঞ্জুর করে ২০ এপ্রিল নির্ধারন করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই গত ২৮ মার্চ আমি তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছি। সোমবার সকলের উপস্থিতিতেই আদালতের বিচারক নিহত যুবকের হিমঘরে পড়ে থাকা লাশটি তার ধর্মীয় শিক্ষক ক্বারি আকরাম হোসাইনের কাছে হস্তান্তর করে মুসলিম নিয়ম অনুযায়ী দাফন কাফন সম্পন্ন করতে। বিকেলে আদালতের বিচারকের নির্দেশনার কাগজপত্র হাতে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে গিয়ে রাত ৯টার দিকে হাসপাতালের সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে লাশটি তার সহপাঠীদের মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমি নিজে সরাসরি উপস্থিত থেকে দাফন কাফন সম্পন্ন করে আদালতে আরো একটা রিপোর্ট জমা দেব।
রায়ের পর আদালত চত্বরে মুসলিম পক্ষের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ কফিল উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, মৃত্যুর পর হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্বে হিমঘরে পড়ে থাকা যুবকের লাশটি তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন কাফন সম্পন্ন করতে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন। তবে আমি উভয় পক্ষকেই অনুরোধ করছি কেউ যেন এ রায় নিয়ে উল্লাসে মেতে না উঠে। কারণ তার মায়ের চাপা কষ্টটা আরো বেড়ে যাবে। হাজার হলেও সে মা। কারন মৃত্যুর আগে নিহত যুবক তার ইচ্ছায় মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
অপরদিকে, সড়ক আইনে নিহত যুবকের মা সন্ধ্যা রানী দাশের দায়ের করা মামলাটি প্রধান আসামি ঘাতক ট্রাকচালক শাহাদাত হোসেন সিকদার প্রকাশ বাবুল ড্রাইভার (৪২) গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আদালতে জামিন আবেদন করলে আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সে সাতকানিয়া উপজেলার পুরান নগর এলাকার আবুল হোসেন সিকদারের ছেলে। এখনো সে কারাগারে আছে এবং তেলবাহী গাড়িটি ও আটক আছে পটিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশের কাছে।
উল্লেখ্য, রতন দাশ নামের এ যুবকের মরদেহটি তার বন্ধুরা মুসলিম দাবি করা ও তার মা হিন্দু দাবি করা নিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি পটিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট বিশ্বেশ্বর সিংহ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যতদিন পর্যন্ত সে মুসলমান নাকি হিন্দু এটার পরিচয় শনাক্ত না হবে ততদিন পর্যন্ত মরদেহটি চমেক হাসপাতালের হিমঘরে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গত ১৫ মার্চ হাইওয়ে পুলিশের সময়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত দ্বিতীয় বারের মতো আরো এক মাস সময় বাড়িয়ে দিয়ে আগামী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।