তৃণমূলে বেপরোয়া ছাত্রলীগ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ জানুয়ারী,
বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০১:৪১ এএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
প্রায় চার বছর পর সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করা হলেও ছাত্রলীগের সমালোচনা ঘোচেনি। সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলেও বেপরোয়া কর্মকাণ্ড ছাড়েনি তৃণমূলের ছাত্রলীগ। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। সেই সঙ্গে গত এক মাসে সারাদেশে সংগঠনের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও হামলায় শিক্ষকসহ ২২ জন আহত হওয়ার মতো অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছে।
গত শুক্রবার শোভাযাত্রার শাড়ি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন চারজন। এর আগে ৩০ ডিসেম্বর বিজয় একাত্তর হলে মাস্টার্সের একজন শিক্ষার্থীকে মারধর করেন তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত হল ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক রাকিবুল হাসান। তাঁর মারধরের এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
প্রায় একই চিত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলে ট্রেনে সিট ধরে রাখা ও কথাকাটাকাটির মতো তুচ্ছ কারণ নিয়ে বারবার সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের নেতাকর্মী। প্রতিবারই পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির সামনেই নেতাকর্মী লাঠিসোটা, রামদা নিয়ে একে অপরের ওপর চড়াও হয়েছেন। গত বছরের ৩১ জুলাই স্থানীয় ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১২ বার। এতে ৫৬ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে শাটল ট্রেনের সিটে বসা নিয়ে তর্কাতর্কির জের ধরে দ্বিতীয়বারের মতো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ- ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও সিক্সটি নাইন। এতে উভয় পক্ষের আট নেতা আহত হন। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে ইটপাটকেলের আঘাতে আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শহিদুল ইসলাম। ৩ ডিসেম্বর রাতে এ এফ রহমান হলে দেয়াল লিখন মুছে দেওয়ার জের ধরে বাগ্বিতণ্ডায় জড়ায় ছাত্রলীগের ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও বিজয় গ্রুপ। এক পর্যায়ে তা গড়ায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায়। ওই সময় দুই পক্ষের নেতাকর্মীর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে স্লোগান ও মহড়া দেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
অন্যদিকে ৭ নভেম্বর বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সেখানকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কমিটি ঘোষণার পর টেম্পল সড়কে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কার্যালয়ে জড়ো হন পদবঞ্চিত ও কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়া নেতারা। কমিটি প্রত্যাখ্যান করে তাঁরা এক পর্যায়ে ছাত্রলীগসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সব সংগঠনের কার্যালয়ের ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। পদবঞ্চিত নেতাকর্মী এর পর লাগাতার আন্দোলন এবং বিক্ষোভও করেছেন। এর মধ্যে জেলার নতুন কমিটি বাতিলের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় ছাত্রলীগ কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে রাখেন বঞ্চিত অংশের নেতাকর্মী। পরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে পুলিশের সহযোগিতায় নতুন কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তালা ভেঙে কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন।
১৬ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচিতে যাওয়া নিয়ে বিরোধের জেরে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে কুপিয়ে জখম করেছেন অপর পক্ষের কর্মীরা। তাওহিদ আহমেদ নামের ওই ছাত্রলীগ কর্মীর মাথায় দুটি সেলাই দিতে হয়।
১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় অবস্থান নেন। এ সময় ক্যাম্পাসের অন্যতম প্রবেশমুখ নীলক্ষেতের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে থেকে মোবাইল ফোন ঘেঁটে বিএনপি সমর্থক বেশ কয়েকজনকে মারধর করে পুলিশে দেন স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর দুই দিন আগে মধ্যরাতে বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকায় যাওয়ার জন্য চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা সদরের বাস কাউন্টারে গেলে আসিফ নুর খান নামে ছাত্রদলের একজন নেতাকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
৬ ডিসেম্বর রাতে রাজশাহীতে আরিফুল আলম ওরফে জন নামে মহানগর যুবদলের একজন কর্মীকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাজীব হাসানের বিরুদ্ধে। একই দিন রাতে প্রতিবন্ধী একজন কিশোরীকে (১৭) ধর্ষণের অভিযোগে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সহসভাপতি মাহবুব আলম শিপুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
২ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের যৌথ সম্মেলনে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে বিরক্ত হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দেড় ঘণ্টার বেশি সময় মঞ্চে বসে থেকেও বক্তব্য দিতে পারেননি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগরের আমন্ত্রিত নেতারা। এ নিয়ে সভা মঞ্চেই ক্ষোভ ঝাড়েন ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, 'এমন ছাত্রলীগ চাই না।'
২৯ নভেম্বর চাকরির দাবিতে দলবল নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এফ এম আবদুল মঈনের কার্যালয়ে প্রবেশ করে তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস মিয়া। এ সময় সেখানে উপস্থিত কুমিল্লা জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক বিব্রত হন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন সমকালকে বলেন, ছাত্রলীগের মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক পরিবেশ সমুন্নত রাখা এবং শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রয়োজন অনুযায়ী যাতে ছাত্র রাজনীতি পরিচালিত হয়, সেটি নিশ্চিত করা। সে ক্ষেত্রে কেউ যদি সাংগঠনিক শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত হন, তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই শূন্য সহিষুষ্ণতা প্রদর্শন করা হবে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট সাংগঠনিক নির্দেশনা রয়েছে। এই নির্দেশনা সব নেতাকর্মীকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।
সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ছাত্রলীগ একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন। জন্মলগ্ন থেকেই গঠনতান্ত্রিক ধারায় ও সাংগঠনিক নিয়মে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এত বড় সংগঠনে অনেক সময় বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটে। তবে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটা মাত্রই সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর ভবিষ্যতে যেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, এ জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।